সেলফি মাহাত্ম্য ও অমৃতকাল

যেই না বাতাসে ভোট-ভোট ছোঁয়া অমনি আত্মপ্রচারের ঢাকে কাঠি। প্রতিবাদে প্রতিহত হয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্বী তোলানোর বাড়াবাড়িতে কিঞ্চিৎ ছেদ পড়লেও নার্সিসাস প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের অহেতুক উৎসাহে মিথ্যে গৌরব তুলে ধরার উদ্যোগ অব্যাহত। সবাইকে এ-বিষয়ে সতর্ক থাকার বার্তা দিলেন অধ্যাপক দেবনারায়ণ সরকার

Must read

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আত্মপরিচয় প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘অহংবোধ পৃথিবীর মধ্যে সকলের চেয়ে বড় চোর। সে স্বয়ং ভগবানের সামগ্রীও নিজের বলিয়া দাবি করিতে কুণ্ঠিত হয় না।’ ভারতবর্ষের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অহংবোধ ঠিক একই প্রকৃতির। সর্বত্র মোদিময়। প্রথমে, সেনাবাহিনীকে সেলফি পয়েন্ট স্থাপন করতে বলা হয়েছিল। তারপর আইএএস অফিসার এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন সরকারি আধিকারিকদের ‘রথযাত্রা’ বের করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এবারে সাম্প্রতিক সংযোজন, দেশের প্রতিটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে মোদির ব্যাকগ্রাউন্ড সংবলিত সেলফি পয়েন্ট করার নির্দেশ দিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ইতিমধ্যে মোদি সরকারের উদ্যোগে গত ১৫ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ভারত সংকল্প যাত্রা। বিশেষভাবে তৈরি বাস, সেগুলিকে সংকল্প রথ বলা হচ্ছে, দেশের নানা প্রান্তে ছুটেছে সেগুলি। তাতে মোদি সরকারের সাড়ে নয় বছরের কর্মকাণ্ডের প্রচারের ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হয়েছে। সেই রথের গায়ে থাকা প্রধানমন্ত্রীর ছবির সঙ্গেও নিরবিচ্ছিন্নভাবে সেলফি তোলা চলছে। সব মিলিয়ে সবকিছুতে প্রধানমন্ত্রী মোদিই সর্বেসর্বা এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে মোদির ছবি থাকতেই হবে। কার্যত, ভগবানের সামগ্রীরও দাবিদার মোদিই। সেই তালিকায় জুড়ে নেওয়া হল ভারতের সমস্ত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেও।

আরও পড়ুন-আজ পরিষেবা প্রদান

সম্প্রতি ইউজিসির তরফ থেকে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাছে নির্দেশ গিয়েছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে একটি বিশেষ সেলফি পয়েন্ট তৈরি করতে হবে। সেই সেলফি পয়েন্টে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নানা সময়ের, নানা ভঙ্গির ছবি, কাট আউট রাখতে হবে। নরেন্দ্র মোদির সেই ছবির সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলবেন পড়ুয়া ও শিক্ষকরা। ইউজিসি তাদের নির্দেশিকায় উল্লেখ করেছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নানা সময়ের, নানা ভঙ্গির ছবি, কাট আউট থাকবে ওই সেলফি জোনের ব্যাকড্রপে, সেগুলি থ্রি-ডি এফেক্ট-সংবলিত হতে হবে। কোন কোন ছবি থাকবে তার একটি তালিকাও নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, জি-২০ সম্মেলন, চাঁদে অভিযান ইত্যাদির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ছবি রাখতে হবে। আর প্রধানমন্ত্রীর এই ছবির সামনে দাঁড়িয়েই সেলফি তুলবেন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া, শিক্ষক এবং অন্য অতিথিরা। সেলফি তোলার জন্য তাঁদের উৎসাহ দেওয়ার কথাও কতৃর্পক্ষকে মনে করিয়ে দিয়েছে ইউজিসি। প্রতিটি কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এই সেলফি পয়েন্ট তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সঙ্গত প্রশ্ন উঠেছে, পয়সা দিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে ছাত্র-ছাত্রীরা। তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দ থাকতেই পারে। সেখানে জোর করে কেন প্রধানমন্ত্রীর ছবির সঙ্গে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলার জায়গা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে করা হবে। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি তো বিজেপি দলের নেতা। আর প্রধানমন্ত্রী চাইলেই কি ইউজিসি এই জাতীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারে? সাধারণত শপিং মল, রেস্তোরাঁ, পার্ক— এমন সব বিনোদনের জায়গায় এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে সেলফি জোন। সবার চোখে পড়ার মতো কোনও গুরুত্বপূর্ণ জায়গা সেক্ষেত্রে বিশেষ আলো কিংবা ছবি দিয়ে সাজানো হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন অনেকেই। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তেমন কোনও স্থান আলাদা করে থাকার কথা নয়। সেক্ষেত্রে ইউজিসির নির্দেশ শুনে কার্যত চমকে গিয়েছে শিক্ষামহল। আসলে লোকসভা ভোটের আগে সারা ভারতের সমস্ত ক্ষেত্রে মোদির সেলফি প্রচার করার নির্দেশিকা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। অন্যান্য ক্ষেত্রগুলির সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনগুলিকেও এবার মোদির সেলফিতে ভরে দেওয়া শুরু হল, যা অভূতপূর্ব।
ইউজিসির এই তুঘলকি ফরমান ঘিরে মোদিকে তুলোধোনা করেছে বিরোধী শিবির। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জয়রাম রমেশের কটাক্ষ— ‘‘লোকসভা ভোটের আগের আমাদের ‘সেলফি-আচ্ছন্ন’ ও ‘আত্ম-আচ্ছন্ন’ প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারছেন, পায়ের তলায় জমি সরে গিয়েছে। তাই হারানো জনপ্রিয়তা ফেরাতে তিনি চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখছেন না। প্রথমে সেনাকে বলা হয়েছিল সেলফি-পয়েন্ট বানাতে। পরে তিনি ‘রথযাত্রা’ করতে বললেন আইএএস অফিসার ও প্রবীণ সরকারি আধিকারিকদের। এবার ইউজিসি নির্দেশ দিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালগুলিতে সেলফি পয়েন্ট তৈরি করতে।” তিনি আরও বলেন, ‘চন্দ্রযান-৩ কোভিড-১৯ ইত্যাদি সবটাতে তিনি নিজের ছবি সেঁটেছেন। ‘আত্ম-প্রচার করার অদম্য ইচ্ছায় উত্তর কোরিয়ায় একনায়কদেরও ছাপিয়ে গিয়েছেন মোদি।’

আরও পড়ুন-গান্ধীমূর্তির ধর.নামঞ্চে কুণাল, ছত্র.ভঙ্গ বিরো.ধীরা. কাল শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক কর্মপ্রার্থীদের

এ নিয়ে কড়া মন্তব্য দিয়েছে অন্যান্য অনেকের সঙ্গে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও। তিনি বলেছেন, ‘এ ধরনের নির্দেশিকা চাপিয়ে দেওয়া যায় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেলফি পয়েন্টের প্রয়োজন কী? আমরা এই ফরমান মানব না। ছবি যদি রাখতেই হয়, তাহলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থাকবে।’ তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনও জানিয়েছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আদতে ফটো-মন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদি আপনি কি জানেন, ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে সেলফি পয়েন্ট করতে বলেছে পিছনে আপনার ছবি দিয়ে।’ এ সম্পর্কে বেশ কিছু শিক্ষাবিদ অভিযোগ করেছেন যে, ইউজিসি অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি ‘দেবত্ব আরোপ’ করার অনুশীলন চালাচ্ছে বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার। দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এইভাবে করায়ত্ত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে মোদির সরকার— যেখানে ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ এবং সর্বোপরি মূল্যবোধ যেন একমাত্র মোদি ও গেরুয়া ছাড়া অন্য সব কিছু মূল্যহীন। মোদির অহংবোধ এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যেন তিনি স্বয়ং ভগবানের সামগ্রীও নিজের বলে দাবি করতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না।

Latest article