আজ থেকে প্রায় ১০ কোটি বছর আগের কথা, ভয়ঙ্কর অতিবিশাল জীবদের বসতি ছিল এই পৃথিবীতে, তারা ছিল যেমন হিংস্র তেমনই শক্তিশালী। কিন্তু এমন এক সময় এল যে তারা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল পৃথিবী থেকে। জীবগুলি হল ডাইনোসর (Dinosaur)। এই ডাইনোসর কথাটি এসেছে আসলে গ্রিক শব্দ ‘ডিনিয়োস’ অর্থাৎ ভয়ঙ্কর আর ‘সরাস’ অর্থাৎ টিকটিকি থেকে। এই শব্দটির প্রয়োগ হয় ১৮৪১ সালে, যখন এই জীবটির একটি জীবাশ্ম পাওয়া যায়। রিচার্ড ওয়ান নামক এক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। সর্বপ্রথম যে জীবাশ্মটি পাওয়া যায়, সেটি হল মেগালোসরাস নামক এক ডাইনোসরের। আজ অবধি এরকম প্রায় ১০,০০০ ডাইনোসরের জীবাশ্মের সন্ধান পাওয়া গেছে, যার মধ্যে প্রায় ৯০০ ধরনের ডাইনোসর প্রজাতি রয়েছে। ২০২১ সালে চিলিতে ডাইনোসরের এক অদ্ভুত জীবাশ্ম পাওয়া যায়, যার লেজটি ছিল ঠিক ব্লেডের মতন আর মুখের কাছটি চঞ্চুর মতো, এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘স্টেগোরাস এলেনগ্যাসেন’।
ট্রাইঅ্যাসিক যুগ
জীবাশ্ম বিচার করে বিজ্ঞানীরা বলেন ডাইনোসরের (Dinosaur) উৎপত্তি হয় আজ থেকে প্রায় ২৩-২৪ কোটি বছর আগে। তখন সমগ্র ভূখণ্ডকে ‘প্যানজিয়া’ বলা হত। এইসময় পৃথিবীর আবহাওয়া ছিল রুক্ষ ও শুষ্ক, বৃষ্টিপাতের পরিমাণও ছিল কম। এই যুগকে আমরা ‘ট্রাইঅ্যাসিক’ যুগ বলি। সাধারণত এই সময়কাল থেকেই ডাইনোসরেরা পৃথিবীতে পা রাখতে শুরু করে। প্রথমে আসা এই ডাইনোসরের আকার ছিল ২ মিটার মতো, যেমন ‘ইয়োর্যাপটার’। যাকে প্রায় সব ডাইনোসরের পূর্বপুরুষ বলা হয়। এরপর ধীরে ধীরে পৃথিবীর আবহাওয়া বদলাতে থাকে, ধীরে ধীরে ‘প্যানজিয়া’ টুকরো হতে থাকে আর এর মধ্যেই প্রায় ২০ কোটি বছর আগে এই ‘ট্রাইঅ্যাসিক’ যুগের অবসান হয়। এটা নিছকই একদিনের ঘটনা নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূমিকম্প, লাভা উদ্গীরণ— এইসব বাতাসে CO2, SO2-এর মাত্রা এতটাই বাড়িয়ে তুলেছিল যে এটি পৃথিবীর চারিদিকে একটি আস্তরণ তৈরি করেছিল, যা সূর্যরশ্মিকে পৃথিবীতে আসতে বাধা দিচ্ছিল। প্রথমে পৃথিবীর উষ্ণায়ন দেখা দিলেও পরবর্তীতে তাই ক্রমশ পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমতে থাকে এমনকী অতিরিক্ত CO2, SO2 সমুদ্রের জলে মিশে তাকে আম্লিক করে তুলেছিল। এইসময় যেসব প্রাণী পৃথিবীতে ছিল তাদের পক্ষে বেঁচে থাকা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়েছিল। যারা শীতলশোণিত প্রাণী ছিল তারা মারা যেতে থাকে, কিন্তু ডাইনোসরেরা ছিল উষ্ণশোণিত প্রাণী তাই তারা এই প্রবল আবহাওয়ার পরিবর্তন সহ্য করে টিকে যায়। মনে করা করা হয় প্রায় ৬ লক্ষ বছর ধরে ক্রমান্বয়ে লাভার উদ্গীরণ চলতে থাকে। ডাইনোসর ছাড়া প্রবল আবহাওয়ার পরিবর্তন সহ্য করে টিকে ছিল কিছু কুমির, কচ্ছপ-সহ আরও কিছু প্রাণী।
জুর্যাসিক যুগ
এরপর শুরু হয় জুর্যাসিক যুগ— যা আজ থেকে প্রায় ২০ কোটি বছর আগে থেকে শুরু হয়ে চলে ১৪ কোটি ৫০ লক্ষ বছর পর্যন্ত, আর এই সময় একমাত্র ডাইনোসরেরাই (Dinosaur) পৃথিবীতে রাজ করতে থাকে। এই সময় বিবর্তনের বদান্যতায় এদের আকৃতির পরিবর্তন ঘটে, তাদের আকার হয় বিরাট, এমনকী ডাইনোসরদেরই বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভব হতে থাকে এইসময়, যেমন টাইটানোসরাস— যাদের আকার ছিল ১৫ মিটার আর ওজন ছিল ১৫০০০ কিলোগ্রাম। এরা ছাড়াও ছিল ব্রন্টোসরাস, ব্রাকিওসরাস, ডিপ্লোডকাস, স্টেগোসরাস ইত্যাদি। এইসময় শুধু ডাঙার নয় উড়ন্ত ডাইনোসরদেরও দেখা যায়। এই যুগেই টুকরো হতে থাকা ‘প্যানজিয়া’ ভেঙে হয় লরেশিয়া আর গন্ডোয়ানাল্যান্ড।
আরও পড়ুন- বাংলার মান বাঙালির সম্মান…
ক্রেটেসিয়াস
এর ঠিক পরেই আসে ক্রেটেসিয়াস যুগ। এই যুগেই ডাইনোসরদের সবচেয়ে বেশি বাড়বাড়ন্ত দেখা যায়। টি-রেক্সের আগমনও ঘটে এই যুগেই। এককথায় এই যুগে ডাইনোসরেরা ফুলে-ফেঁপে ওঠে। সাধারণত বলা হয় ডাইনোসরদের (Dinosaur) ইতিহাসে এই ক্রেটেসিয়াস যুগ ছিল সবচেয়ে বড় যুগ যা আজ থেকে ১৪ কোটি ৫০ লক্ষ বছর থেকে শুরু হয়ে চলেছিল প্রায় সাড়ে ৬ কোটি বছর পর্যন্ত। এইসময় লরেশিয়া আর গন্ডোয়ানাল্যান্ড আরও টুকরো হয়ে আজকের চেহারা নেয়, পৃথিবীর আবহাওয়া ক্রমে মনোরম হয়, বিভিন্ন ফুল ফুটতে থাকে, সমুদ্রের জলতল থাকে ওপরে, পৃথিবী কিছুটা উষ্ণ হয়। এইসময় সমস্ত ধরনের ডাইনোসরদেরই প্রায় দেখা যায়। যেমন— র্যাপটার, আরমার ডাইনোসর, বড় বড় তৃণভোজী ডাইনোসর, মাংসাশী ডাইনোসর, টাইটানোসরাস, আর্জেন্টিনোসরাস (ওজন ৭৭ টন) টি-রেক্স এবং ট্রাইসেরাটপ ইত্যাদি। এদের মধ্যে সবার শেষে আসে টি-রেক্স এবং ট্রাইসেরাটপ, আজ থেকে মাত্র ৬০-৭০ কোটি বছর আগে। এরা ছাড়াও এইসময় আরও কয়েকটি ডাইনোসরের কথা আমরা জানতে পারি, যেমন— অর্নিথোমিমিডাস যার গতি ছিল ঘণ্টায় ৮০ কিমি এ ছাড়াও যদি উড়ন্ত ডাইনোসরদের কথায় আসি তাহলে বলতে হয় কেটজেলকোঅ্যাটলাসের কথা, যার ডানার আকার ছিল ১০-১২ মিটার।
ধ্বংসের কারণ
সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে যে, দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা এই বিরাটাকায় প্রাণীগুলির রাজত্ব কেমন এক নিমেষে শেষ হয়ে গিয়েছিল। এর কারণ ছিল একটা ১০-১৫ কিলোমিটারের অ্যাস্ট্রয়েড। যার গতি ছিল প্রতি সেকেন্ডে ৩০ কিলোমিটার, যা একটি জেট প্লেনের প্রায় ১৫০ গুণ। এই বিশাল গতিসম্পন্ন অ্যাস্ট্রয়েডটি প্রায় ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীপৃষ্ঠে এসে পড়ে। এখনকার মেক্সিকোর ইউকাটান পেনিনসুলার কাছে এই অ্যাস্ট্রয়েডটি আছড়ে পড়ায় সেখানে ১৮০ কিমি একটি গর্তের সৃষ্টি হয়, শুধু তাই নয় এর ফলে যে ভয়ঙ্কর শক্তি উৎপাদিত হয়েছিল সেই তাপমাত্রায় প্রায় সমস্ত প্রাণী জ্যান্ত অবস্থায় সেদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। দাবানল, সুনামি, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত— সারাটা পৃথিবীর বুকে যেন আগুনের ঝড় উঠেছিল। এক লহমায় এই ডাইনোসরেরা পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনায় প্রায় সমস্ত ডাইনোসর প্রজাতিই ধ্বংস হয়ে যায়, যারা বেঁচে থাকে বিবর্তনের ফলে তারা পরিণত হয় পাখিতে।
অ্যাস্ট্রয়েড-এর ফলেই যে ক্রেটেসিয়াস যুগের অবসান ঘটে, সেটি জানা যায় পৃথিবীতে পাওয়া ইরিডিয়াম নামক ধাতু থেকে, যা সাধারণত অ্যাস্ট্রয়েড-এর অংশ কিন্তু পৃথিবীতে এটি তেমনভাবে পাওয়া যায় না। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীপৃষ্ঠে বেশ উচ্চমাত্রায় এই ধাতুটির সন্ধান পান যেখানে নাকি মনে করা হয়েছিল অ্যাস্ট্রয়েডটি এসে আছড়ে পড়ে। আর শুধু তা-ই নয় এই ইরিডিয়ামের কার্বন ডেটিং করেও দেখা গেছে যে সেটি প্রায় ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছরের পুরোনো।