আমাদের দেশে সর্বভারতীয় রাজনীতি এবং রাজ্য রাজনীতি— দুটি যেন আলাদা দুনিয়া। এই দুটি রাজনীতির ব্যাকরণ এবং প্রকরণ সবই আলাদা। আবার ভিন্ন হলেও এই দুটি রাজনীতির মধ্যে রয়েছে গভীর যোগসূত্র। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় একদা আমাকে বলেছিলেন, আমি দিল্লির রাজনীতিতে যেভাবে সফল ঠিক সেই ভাবে রাজ্য রাজনীতিতে কোনও দিন সেরকম সাফল্য পাইনি। যেটা আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরাট শক্তির জায়গা।
কোনও সন্দেহ নেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আত্মত্যাগ, আন্দোলন, রাজনীতির একাগ্রতা— সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় সফল নেত্রী হিসেবে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও ভুললে চলবে না যে ১৯৮৪ সালে তিনি প্রথম লোকসভার সদস্য হয়েই রাজনীতিতে সকলের নজর কাড়েন। সাতবার তিনি লোকসভার সদস্য হয়েছেন। সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। দিল্লির রাজনীতিও কলকাতায় বসে তিনি নিজের হাতের চেটোর মতো চেনেন। এহেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি আজ দিল্লির পটভূমিতে নিয়ে এসেছে এক বিরাট প্রাসঙ্গিকতা এবং প্রয়োজনীয়তা (NO TO BJP- NO TO MODI)।
পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে কংগ্রেস যেভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে, তা থেকে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বও কিন্তু বেশ কিছু বিষয় অনুধাবন করেছেন এবং নুতন করে ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছেন। একথা সত্য যে, নরেন্দ্র মোদির সরকার তথা বিজেপিকে পরাস্ত করতে গেলে বিরোধীদের সকলকে একত্রিত হতে হবে। ছোট ছোট কায়েমি স্বার্থ, ইগো, প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব, সেগুলিকে বর্জন করে আপাতত মোদি-বিরোধী মঞ্চে একত্রিত হতে হবে। তবেই ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বিরোধীদের সাফল্যের সম্ভবনা। এবারের বিধানসভা নির্বাচনের পর বিজেপি নরেন্দ্র মোদিকে কার্যত নির্বিকল্প এক চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহী। অন্যদিকে, বিশেষ করে কংগ্রেসের বিপর্যয়ের পর রাহুল গান্ধীর সর্বসম্মত গ্রহণযোগ্যতা অনেক কমে গিয়েছে এ-ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। তৃণমূল কংগ্রেস কখনওই মনে করে না যে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে কেন্দ্রে সরকার (NO TO BJP- NO TO MODI) গঠন করা জরুরি। বরং কংগ্রেসকে সঙ্গে রাখার আবশ্যিকতা শুধু তৃণমূল নয়, সমাজবাদী পার্টি থেকে শুরু করে ডিএমকের স্টালিন— সকলেই স্বীকার করেন। কিন্তু আজ যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়েছে, যেখানে লোকসভা নির্বাচনের আর মাত্র চার-পাঁচ মাস বাকি, সেখানে কিন্তু পরিণত নেত্রী হিসেবে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার দৌলতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিরোধী শিবিরের প্রধান কান্ডারি হিসেবে বিবেচনা করার দাবি উঠতে শুরু করেছে। বিজেপির রণকৌশলের একটা বড় অঙ্গ হচ্ছে কীভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তথা দলকে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে কালিমালিপ্ত করা যায়। কীভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানান ভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা যায়, নেতিবাচক আবহাওয়া তৈরি করা যায়, যাতে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দিবলয় তথা অন্য রাজ্যগুলিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত না হয়। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির এই রণকৌশল জানেন এবং তাঁর কাছে এখন পাখির চোখ হচ্ছে বিরোধীদের মধ্যে আসন সমঝোতা। এই কথাটি বহুদিন ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃত্ব মমতার এই প্রস্তাবে এতদিন সেভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। সোনিয়া গান্ধী অনেকটা চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ব্যস ওইটুকুই। তার মধ্যে রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনগুলো এসে যাওয়ায় কংগ্রেস অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে এই নির্বাচনগুলোকে কেন্দ্র করে। কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচনের জয়ের ফলে কংগ্রেসের মধ্যে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এসে যায়। ধারণা হয়েছিল যে কংগ্রেস বিপুলভাবে রাজ্যে বিধানসভাগুলিতে জিতবে। তারপর কংগ্রেসের নেতৃত্বে গোটা দেশ জুড়ে INDIA-র কাজকর্ম চরম আকার ধারণ করবে। বাস্তব সেটা হয়নি।
আরও পড়ুন- আদালত চত্বরেই এলোপাথাড়ি গুলি, পুলিশি ঘেরাটোপে খুন
এখন অনেকেরই মনে হচ্ছে যে বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যগুলিতে যদি আসন না-ও দিতে কংগ্রেস রাজি হত তাহলেও বিভিন্ন রাজ্যের বিরোধী নেতাদের নিয়ে গিয়ে এই রাজ্যগুলোতে বিজেপি এবং মোদির বিরোধী প্রচার গড়ে তোলা যেতে পারত। মূল ইস্যুটা এখন দাঁড়িয়েছে NO TO BJP, NO TO MODI (NO TO BJP- NO TO MODI). সেখানে একটা মতাদর্শগত ঐক্যই সব দলগুলির মধ্যে রয়েছে। সেটি হল বহুত্ববাদী, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরেপেক্ষ অসম্প্রদায়িক একটা স্বাধীন ভারতকে আবার ফিরিয়ে আনা। সহিষ্ণুতার অভাব রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তৈরি হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সকলে মিলে লড়াই করতে হবে।
এবারে ১৯ ডিসেম্বর INDIA-র যে বৈঠক দিল্লিতে হতে যাচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাতে আসছেন এবং বিরোধী অনেক নেতাও থাকছেন।
আশা করা যায় গোটা দেশে কীভাবে যতটা সম্ভব ১ : ১ আসন সমঝোতা তৈরি করা যায় এবং প্রচারে একটা সর্বসম্মত মঞ্চ সব রাজ্যের জন্য গড়ে তোলা যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। তারপর বিভিন্ন রাজ্যে, বিভিন্ন নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে যারা এই আসনভিত্তিক সমঝোতাটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। এখন যদি রাজ্যস্তরে বিজেপিকে প্রধান শত্রু হিসেবে অগ্রাধিকার না দিয়ে রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকেই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য করা হয়, তাহলে কিন্তু জাতীয়স্তরেও মোদি-বিরোধী জোটের ঐক্য গড়ে তোলা কঠিন হবে।
শেষ পর্যন্ত কী হবে সেটা ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত। শুধু এইটুকু বলা যায়— বেটার লেট দ্যান নেভার!