ক্রিসমাসের প্রস্তুতি প্রায় শেষের মুখে। মাঝে একটা দিন। বাঙালিদের কাছে এটা কেক উৎসব হলেও খ্রিস্টানদের কাছে ঠিক তা নয়। খ্রিস্টান পাড়া বা তাঁদের হেঁসেল পর্যন্ত না পৌঁছলে বড়দিনের আসল ফ্লেভারটা পাওয়া যায় না। যদিও এই শহরের বাঙালি খ্রিস্টানদের কাছে বড়দিনের তাৎপর্য সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁরা তাঁদের ঐতিহ্যকে নিজের মনের মতো করে গড়ে নিয়েছেন যেখানে মিশে রয়েছে আপন মনের মাধুরী এবং নিখাদ বাঙালিয়ানা। আর সেই ঐতিহ্য গড়া এবং তা বয়ে নিয়ে চলার পুরোভাগে রয়েছেন খ্রিস্টান মহিলারা। বিদেশি আদবকায়দার মধ্যে বাঙালিয়ানার সুর ভরে বছরের পর বছর বড়দিন পালন করে চলেছেন এই শহরের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলারা। তাঁদের কাছে বড়দিন মানে শুধু একটা দিনের রীতি নয়। একমাসের দীর্ঘ প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতি মহামিলনের। মানুষের ঈশ্বরের। তাঁদের কাছে বড়দিন মানে শুধুই কেক, রোজ কুকিজ নয় পিঠে, পুলি, পাটিসাপটাও। নানা সম্মানীয় পেশার জুড়ে থাকা এই সব খ্রিস্টান অ্যাংলো মহিলারা কখন যে আদ্যপান্ত বাঙালি গিন্নি হয়ে উঠেছেন তা বলা মুশকিল। রয়েছেন নানা সম্মাননীয় পদমর্যাদায়, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। একাত্ম হয়ে গেছেন শহর কলকাতা এবং বাঙালি কালচারের সঙ্গে।
আরও পড়ুন-নামী আইটি সংস্থায় ৮ তলা থেকে ছিড়ে পড়ল লিফট, আহত ৯
এই শহরের সবচেয়ে প্রাচীন ক্যাথলিক পরিবারের মেয়ে হলেন অ্যাঞ্জেলিনা ম্যানথোস জসনানি। যাঁর জন্ম-কর্ম সবই এই কলকাতায়। এই শহরেই একটা সময় তাঁর বাবা, মা, কাকা, পিসি, ঠাকুমা চার্চের জন্য কাজ করতেন। অ্যাঞ্জেলিনার ঠাকুমার মা এসছিলেন সুদূর সুইজারল্যান্ড থেকে। মাদার টেরিজা যখন মিশনারিজ অফ চ্যারিটি গড়েন তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন অ্যাঞ্জেলিনার ঠাকুরদাও। একশো কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে তাঁর পূর্বপুরুষেরা এই দেশে বসবাস করতে করতে কখন বাঙালি হয়ে গেছেন নিজেরাই জানেন না।
অ্যাঞ্জেলিনার আরও একটি পরিচয় হল কলকাতার ক্যাথলিক অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট তিনি। প্রায় ১১৪ বছরের পুরনো এই অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারি মার্গারেট কোয়েলোর অনুরোধে অ্যাঞ্জেলিনা এই সংস্থার সঙ্গে জুড়ে যাওয়া। সেই থেকেই নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। ক্যাথলিক অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে অ্যাঞ্জেলিনা বললেন, ‘‘আমরা নানা ধরনের কাজ করি মানুষের জন্য, ক্যাথলিক অ্যাসোসিয়েশন মানেই শুধু খ্রিস্টান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের নারী, শিশু, কিশোর অথবা বৃদ্ধদের সেবা দিচ্ছি এমনটা নয়। প্রতিটি জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ মানুষের জন্য কাজ করি। যাঁরাই আসেন আমরা সকলকে সাহায্য করি।’
আরও পড়ুন-সম্প্রীতি-জননী
এক উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী হিন্দু পরিবারের পুত্রবধূ অ্যাঞ্জেলিনা পুরোদস্তর ব্যবসায়ী হয়েও ক্যাথলিক অ্যাসোসিয়েশনে সেবামূলক কাজে নিয়োজিত। কী ধরনের কাজ করেন তাঁরা সেই প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘‘এই অ্যাসোসিয়েশন থেকেই ছাত্রছাত্রীদের এডুকেশনাল এড প্রদান, বিভিন্ন ওল্ডেজ হোম, মিশনারিজ অফ চ্যারিটিজে আমরা যাই সাহায্য নিয়ে। একে অপরকে সাহায্য করি একসঙ্গে মিলে দরিদ্র, দুঃস্থ মানুষদের পাশে, অনাথ, অসহায়দের পাশে দাড়াই। নানা ধরনের কর্মসূচি চলে সারা বছর ধরে।’’ বাঙালি খ্রিস্টান মেয়েদের সামাজিক, আর্থিক অবস্থান এই রাজ্যে ঠিক কী রকম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এই মুহূর্তে এই ক্যাথলিক অ্যাসোসিয়েশনে যে কমিটি রয়েছে তার ৭০ শতাংশ মহিলা। মেয়েরাই সবসময় অগ্রাধিকার পেয়ে এসেছে। এই রাজ্যের খ্রিস্টান মেয়েরা কারও চেয়ে কোনও অংশে কম নেই। কী শিক্ষায়, দীক্ষায়, কী পেশায় তাঁরা সর্বত্র এগিয়ে। বেশিরভাগই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। আমাদের কোনওদিন নিজেদের আলাদা মনে হয়নি এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব এই রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেসের মাইনরিটি সেলের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশু, নারীদের নিয়ে কাজ করছি। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গেও কাজ করছি।’’
আরও পড়ুন-প্রজাতন্ত্র দিবসে কন্যাশ্রীর ট্যাবলো, এবারের অতিথি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট
এই বড়দিনের তাঁদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানালেন, ‘‘ক্রিসমাসের সময় দুঃস্থ, দরিদ্র মানুষের জন্য শীতবস্ত্র থেকে খাওয়া-দাওয়া ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রতিবছর দেওয়া হয়। বহু মানুষ স্বেচ্ছায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।’’ শুধু কেক, কুকিজ নয়, এই সময় চার্চের উদ্যোগে মেলা বসে, সেখানে পিঠেপুলি সব মেলে।
অ্যাঞ্জেলিনার মতোই এই শহরে রয়েছেন আরও অনেক সফল পেশাদার এবং চাকরিজীবী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা যাঁদের ক্রিসমাসের প্রস্তুতি শেষ। এই প্রসঙ্গে পেশায় শিক্ষিকা গ্লোরিয়া লিনগাম জানালেন, তিনি একমাস আগে থেকে ড্রাইফ্রুট ভিজিয়ে রাখেন তারপর ক্রিসমাসের দিন পুরো ফ্যামিলি একসঙ্গে মিলে কেক, কুকিজ বানান। এই সময় বাড়ি পরিষ্কার, সাজানো সবটাই নিজে হাতে করেন।
ব্যাঙ্ক ম্যানেজার গৌরী গোমস ট্রাডিশনাল টার্কি রোস্ট সবসময় না করলে মুরগির রোস্ট করেনই। কেক রোজ কুকিজ, পাই সবকিছু যত্ন করে তৈরি করেন।
আরও পড়ুন-বিজেপি সরকারের পুরস্কার ফেরালেন র্যাট হোল মাইনার্সরা, নামমাত্র টাকায় কী হবে, ক্ষোভ
এর সঙ্গে মাস জুড়ে চলে তাঁদের প্রস্তুতি পর্ব। তাঁরা মনে করেন ঈশ্বর স্বয়ং এইদিন আসেন তাঁদের বাড়ি তাই সেই খুশিতে ক্রিসমাসের আগে চারটে রবিবার চার্চে যান। একে বলা হয় অ্যাডভেন্ট। ওইদিন কিছু বিশেষ রিচুয়ালস থাকে চার্চে। একটা আন এন্ডিং ক্রিসমাস রিথ তৈরি করে রাখা হয়। তার চারপাশে চারটে এবং মাঝে একটা মোমবাতি জ্বালানো হয়। তার মধ্যে তিনটে মোমবাতি পার্পল, একটা পিঙ্ক এবং মাঝখানে সাদা মোমবাতি জ্বালানো হয়। সেই সঙ্গে চারটে রবিবার বিশেষ ভাবনায় প্রার্থনা হয় ঈশ্বরের সামনে। আশা, শান্তি, প্রেম এবং আনন্দ এই প্রার্থনার আসল উদ্দেশ্য। অনেকেই উপবাসও রাখেন এই দিনে। এরপর ক্রিসমাসের দিন মিডনাইট মাস এবং তারপর সেলিব্রেশন শুরু হয়। এই একমাস ধরে ক্যারল গাইয়ের দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান করে। ক্রিসমাসের দিন এই ক্যারল চার্চে পরিবেশিত হয়। বেঙ্গল ক্যাথলিক অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারি মার্গারেট কোয়েলো হলেন গোয়ান। কিন্তু তিনিও এ শহরে থাকতে থাকতে হয়ে গিয়েছেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কমিউনিটির একজন। অবসর নেওয়ার পর এখন এই অ্যাসোসিয়েশনই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। বছরভর এই দিনটার অপেক্ষায় থাকেন কারণ তাঁর ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিরা এই দিন তাঁর বাড়িতে আসে। ডিনার করেন তাঁরা। সেই নৈশভোজে থাকে ব্রেড, মিটলোফ, সুইস রোল, বেকড বিনস থেকে শুরু করে অনেক কিছু। এইরকম ভাবেই খ্রিস্টান বাঙালি গিন্নিদের বড়দিন হয়ে ওঠে অনেকটা বড়সড়।