সম্প্রীতি-জননী

গতকালই চলে গেল তাঁর ১৭১তম জন্মবার্ষিকী। রামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয়কে তিনি শুধু আত্মস্থ করেননি, সেই মতের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছিলেন জীবনে ও কর্মে। সারদা-কথা লিখছেন বিতস্তা ঘোষাল

Must read

একদিন একজন তুঁতে মুসলমান কয়েকটি কলা আনিয়া বলিল, ‘মা, ঠাকুরের জন্য এইগুলি এনেছি, নেবেন কি’? মা লইবার জন্য হাত পাতিলেন; বলিলেন, ‘খুব নেব, বাবা দাও। ঠাকুরের জন্য এনেছ, নেব বই কি’। মায়ের সাংসারিক কার্যে সাহায্যার্থ নিকটবর্তী গ্রামের জনৈকা স্ত্রীভক্ত কাছেই ছিলেন। তিনি বলিলেন, ‘ওরা চোর, আমরা জানি, ওর জিনিস ঠাকুরেকে দেওয়া কেনো’? মা এ কথার কোন উত্তর না দিয়া মুসলমানটিকে মুড়ি মিষ্টি দিতে বলিলেন। সে চলিয়া যাইলে মা ওই স্ত্রীভক্তটিকে তিরস্কার করিয়া গম্ভীর ভাবে বলিলেন, ‘কে ভাল, কে মন্দ আমি জানি’।
এই যে ঘটনাটি ঘটছে সেই সময় ভারত ব্রিটিশ অধীনস্থ। কুসংস্কার, জাত-পাতের দ্বন্দ্ব, ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ, নারীকে অন্তঃপুরে বন্দি রাখা ও শিক্ষা তখনও বৃহত্তর অংশের জন্য নিষিদ্ধ। অনেক লড়াই করে রামমোহন সতীদাহ বন্ধ করেছেন, বিদ্যাসাগর বিধবাদের পুনর্বার বিবাহ ও নারী শিক্ষার জন্য চেষ্টা করছেন। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা ও ব্রাক্ষ্মধর্মাবলম্বী মেয়েরা বিদ্যালয়ে গেলেও তার সংখ্যা হাতে গোনা।
অন্যদিকে, এই সময়ই সব কিছু গোঁড়ামি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর মন্দির থেকে রামকৃষ্ণদেব বলছেন, যিনিই রাম তিনিই রহিম, তিনিই আবার যিশু, যা জল তাই পানি আবার তাই ওয়াটার। এই সময় থেকেই আবার স্বাধীনতার আন্দোলনে এগিয়ে আসছেন অজস্র বাঙালি। এই যে একই সঙ্গে এত বৈপরীত্য, সেইখানে দাঁড়িয়ে এমন উক্তি আমাদের ভাবতে বাধ্য করে, কে এই মা যিনি এভাবে অন্য ধর্মের এক মানুষকে শুধু স্নেহ আদর প্রশ্রয়-ই দিচ্ছেন না, অভয়ও দিচ্ছেন। তিনি আসলে সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে সবার প্রথম মা। যাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্বয়ং ঠাকুর বলছেন, ‘‘ও সারদা (Sarada Devi), সরস্বতী, জ্ঞান দিতে এসেছে। রূপ থাকলে পাছে অশুদ্ধ মনে দেখে লোকের অকল্যাণ হয়। তাই এবার রূপ ঢেকে এসেছে। ও (সারদা) (Sarada Devi) জ্ঞানদায়িনী, মহাবুদ্ধিমতী।”
তিনি রামচন্দ্র ও শ্যামাসুন্দরী মুখার্জির কন্যা সারদামণি। জয়রামবাটী, কামারপুকুরের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক, সংঘ-জননী তিনি। আপাতভাবে দেখে মনে হয় সাধারণ এক নারী, ইংরেজি জানা তো দূরঅস্ত্‌, বাংলা ভাষাতে লেখা-পড়ার শুরুই অনেক পরে। পাঁচ বছর বয়স হতে রামকৃষ্ণ ঘরনি তিনি, নিঃসন্তান, কিন্তু সারা বিশ্ব জুড়ে তাঁর ছেলে-মেয়ে। সেখানে ধর্ম-জাত, উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ নেই। সেখানে তিনি নির্ভয়ে বলছেন, “আমার শরত্ (স্বামী সারদানন্দ) যেমন ছেলে, এই আমজাদও তেমন ছেলে”।
এই আমজাদ হলেন ‘তুঁতে মুসলমান। এঁদের প্রকৃত পেশা ছিল রেশম কীটের চাষ। কিন্তু বিদেশি রেশমের প্রতিযোগিতায় ব্যবসা নষ্ট হয়ে গেলে এঁরা ডাকাতি পেশায় যুক্ত হন। এই আমজাদ স্থানীয় অঞ্চলে তখন তুঁতে ডাকাত রূপেই পরিচিত ছিল। তাঁর বাড়ি শিহড়ের কাছে শিরোমণিপুরে। মা ফতেমা বিবি, স্ত্রী মতিজান বিবি। মা এঁদের স্নেহ করতেন। এঁরাও জানতেন সবাই তাঁদের ঘৃণা করলেও মায়ের কাছে তাঁদের অবারিত দ্বার। আমজাদ যাতে ডাকাতি ছেড়ে দেন তাই মা সব জেনেও নিজের বাড়ি তৈরির কাজে লাগান। একদিন আমাজাদের কাজ শেষ হলে মায়ের ভাইঝি নলিনী উঠানে দাঁড়াইয়া তাহাকে দূর হইতে ছুঁড়িয়া ছুঁড়িয়া পরিবেশন করিতেছিল। মা তাহা দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন, “অমন করে দিলে মানুষের কি খেয়ে সুখ হয়? তুই না পারিস আমি দিচ্ছি”। খাওয়ার শেষে মা উচ্ছিষ্ট স্থানটি নিজেই ধুইয়া দিলেন।
এর পর আমাজাদ অনেকদিন আসেন না। মা সারদা যে মনে মনে তাঁকে নিয়ে ভাবছেন বোঝা গেল একদিন হঠাৎ করে তাঁর মাথায় একটি ঝুড়ি নিয়ে আগমনে। ঝুড়িটি দাওয়ায় রাখা মাত্র মা অধীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এতদিন ছিলে কোথায়?’ আমাজাদ বলল, ‘ওই যে মা গরু চুরির দায়ে জেল খেটে এলুম। ছাড়া পেয়ে আজই বাড়িতে ঢুকে দেখি গাছে অনেক লাউ ঝুলছে। আর কি থাকতে পারি! লাউ নিয়ে চলে এলুম।’ এই যে গরু চুরি, জেল খাটা— এসব মা কানেই তুললেন না। আমজাদকে আপ্যায়ন করে বিদায় করলেন।
আমজাদই পরবর্তী কালে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়লে বাগবাজারে মাকে কেউ চিঠি দিয়ে ঘটনাটি জানিয়ে বলেন, ডাকাত সেই ডাকাতই রয়ে গিয়েছে। শুনে মা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আমি ভেবেছিলুম আমজাদ ডাকাতিটা জানে।’ অর্থাৎ এই ডাকাতি হচ্ছে অন্য পেশার মতোই একটা পেশা, যা ভালভাবে জানাটা জরুরি ছিল। আমজাদ তা ভালভাবে শেখেনি, তাই বারবার ধরা পড়ে যায়।
এই যে অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর ভালবাসা তা কিন্তু শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের সীমাকরণে বাঁধলে ভুল হবে। মনে রাখা দরকার সময়টাকে, যখন পারস্পরিক সম্প্রীতিবোধ তো দূরের কথা, অন্য জাতির ছায়া মাড়ালেও পাপ বলে মনে করা হত, গঙ্গাস্নান করে গোবর খেয়ে পুণ্য অর্জন বা জাত-যাওয়া থেকে ফিরে আসাতে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। সেইখানে দাঁড়িয়ে মা সারদা (Sarada Devi) শুধু যে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকে ছেলে-মেয়ের মর্যাদা দিচ্ছেন তাই নয়, তাঁদের নিজের হাতে মায়ের মতোই খেতে দিচ্ছেন, এঁটো পরিষ্কার করছেন। এই ঘটনা আমরা বারবার দেখেছি।
আমেরিকা থেকে আসা মার্গারেট নোবেল, সারা বুল, মিস ম্যাকলয়েড তো মায়ের অবিচ্ছিন্ন অংশই হয়ে উঠেছিল। রক্ষণশীল, হিন্দু পরিবারের বিধবা, কিন্তু আহার করেন এঁদের সকলের সঙ্গে। সিস্টার নিবেদিতা বলেন, মা, তুমি আমাদের কালী। মা বলেন, না না, তবে তো আমাকে জিভ বার করে রাখতে হবে। নিবেদিতা বলেন, তার কোনও দরকার নেই। তবু তুমি আমাদের কালী, আর ঠাকুর হলেন স্বয়ং শিব। মা মেনে নেন। নিজ হাতে রঙিন উলের ঝালর দেওয়া হাতপাখা বানিয়ে দেন নিবেদিতাকে।
এই যে ম্লেচ্ছ হবার ভয় দূর করে পরম ভালবাসায় নিজের খুকিকে আশ্রয় দিচ্ছেন মা, তা বিস্মিত করে। এই প্রসঙ্গেই আর একটি ঘটনার উল্লেখ করতে হয়। মা তখন উদ্বোধনে অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় রয়েছেন। একদিন এক পার্সি যুবক সেখানে উপস্থিত। তিনি মঠে অতিথি হয়ে কয়েকদিন ধরে বাস করছিলেন। এখন মায়ের কাছে এসেছেন তাঁকে দর্শন করে তাঁর কাছে দীক্ষা নিতে। মায়ের তখন দর্শন একেবারে বন্ধ। যুবক নিচে বসে রইলেন। তাঁকে দোতলায় যেতে দেওয়া হল না। মা কিন্তু কীভাবে জেনে গেলেন। তিনি একজনকে বললেন তাঁকে তাঁর কাছে ডেকে নিয়ে আসতে। তিনি এলে তাঁকে দীক্ষা দিলেন। এই পার্সি যুবকটি চিত্রজগতের বিখ্যাত অভিনেতা ও প্রযোজক বম্বের সোরাব মোদি।
আজকের ভারতবর্ষে এখনও যেখানে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তুঙ্গে, রাজনৈতিক সমীকরণ নির্ধারিত হচ্ছে জাত-ধর্মের ভিত্তিতে, শ্রমভিত্তিক বিভাজনে মানুষের পরিচয় নির্ধারিত হচ্ছে, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে বিষিয়ে দিচ্ছে একদল ধর্মান্ধ মানুষ, সেখানে বারবার ফিরে যেতে হয় সারদা মায়ের কাছে। যিনি তাঁর স্বামী যুগপুরুষ রামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয়কে শুধু আত্মস্থ করেননি, তা ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের মাঝে।
সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রেও সারদামায়ের বিকল্প পাওয়া দুষ্কর।

আরও পড়ুন- বিজেপি সরকারের পুরস্কার ফেরালেন র‍্যাট হোল মাইনার্সরা, নামমাত্র টাকায় কী হবে, ক্ষোভ

Latest article