বড়দিনের জন্যে কলকাতার পার্ক স্ট্রিট নানা রঙের আলোয় সেজে উঠেছে। ক্রিসমাসের উৎস খুঁজতে গিয়ে আমরা অবশ্য দেখি যে যিশুর বহু শতাব্দী আগে রোমানরা তাদের ‘স্যাটারনালিয়া’ উৎসব মহাসমারোহে বছরের ঠিক এ সময়েই পালন করতেন। এই উৎসবটিকেই পরে খ্রিস্টান চার্চ ক্রিসমাসে সঞ্চারিত করে। আবার অনেকে বলেন গ্রিক সৌর উৎসব ‘হেলিয়া’ই হল ক্রিস্টমাসের উৎস।
আরও পড়ুন-
প্রচুর লোক আবার প্রশ্ন করেন, যিশুখ্রিস্ট কি সত্যই এই দিনটিতে জন্ম নিয়েছিলেন? তখনকার দিনে জন্মের সার্টিফিকেট লাগত না অতএব কেউই জন্মের ঠিক দিনক্ষণ বলতে পারতেন না। আসলে ধর্মে সবই বিশ্বাসের ব্যাপার। বাইবেলে খ্রিস্টজন্মের নির্দিষ্ট সাল-তারিখের উল্লেখ নেই, ফলে গোড়া থেকেই এ বিষয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক শুরু হয়। ৩০০ খ্রিস্টাব্দের আগে যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন বিষয়ে খ্রিস্টানদের মধ্যে কোনও ঐকমত্যই ছিল না।
অনেকে বসন্তের একটি দিনকে এই উদ্দেশ্যে মানতেন, অনেকে আবার মধ্যপ্রাচ্যের ‘অদম্য সূর্যের দিন’ ২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টের জন্মদিন হিসেবে পালন করতেন। ক্রমশ অধিকাংশ খ্রিস্টান এই তারিখটিকেই মেনে নিলেন। ডিসেম্বরের ২১-২২ তারিখে সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয়, ঠান্ডায় জমে যাওয়া ইউরোপের মানুষের কাছে বছরের কঠিনতম সময়ের অবসান ঘটে, বাকি শীতটা পার করে দেওয়া যাবে। এই স্বস্তি থেকেই শীতের উৎসব এসেছিল।
আরও পড়ুন-সংসদে সাসপেনশন ইস্যুতে আজ বৈঠকে খাড়গে-ধনকড়
৩৭৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি পূর্ব গোলার্ধের চার্চগুলি তাতে সায় দেয়নি। কিছু পণ্ডিত দেখিয়েছেন, সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত জেরুসালেমের চার্চ এই দিনটিকে অগ্রাহ্য করেছে। আর্মেনিয়ানরা এখনও ৬ জানুয়ারি ক্রিসমাস পালন করেন। এই অনির্দিষ্টতায় খ্রিস্টের মহিমা এতটুকুও ক্ষুণ্ণ হয় না।
এই সূত্রে আরও নানা কৌতূহল ভিড় করে আসে। যেমন, ক্রিসমাস ট্রি কোথা থেকে এল? খ্রিস্টের জন্মভূমি জুডিয়া বা প্যালেস্টাইনের গরমে ওই ধরনের কনিফার জন্মানোর প্রশ্ন ছিল না। খ্রিস্টধর্ম যখন উত্তরে প্রসারিত হয়ে ইউরোপের ধর্মে পরিণত হয় তখনই পাইন গাছ থেকে ক্রিসমাস ট্রি-এর ধারণা জন্ম নিয়েছিল। ইউরোপে পুরনো মাতৃকাদেবীর মন্দিরে থাকত পাইন গাছের সারি। ইতিহাসে ক্রিসমাস ট্রি-এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় লাটভিয়ায় ১৫১০ ও জার্মানিতে ১৫৭০ সালে। জার্মান প্রোটেস্টান্ট মার্টিন লুথার ষোড়শ শতকে এটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। ১৮৩০-এর দশকে রানি ভিক্টোরিয়ার জার্মান স্বামী অ্যালবার্ট উইন্ডসর প্যালেসে ক্রিসমাস ট্রি নিয়ে আসেন, সেই থেকে ইংল্যান্ডে তার প্রচলন হয়। ব্রিটেন থেকে তার উপনিবেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং আটলান্টিক পেরিয়ে পাড়ি দেয় আমেরিকায়।
আরও পড়ুন-মোদির ক্যারিশমা কমেছে, মন্তব্য প্রশান্ত কিশোরের
ক্রিসমাসের সময় কার্ড আর উপহার দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর রীতি এই প্রাচীন উৎসব থেকে এসেছে। ক্রিসমাস পালনের বিভিন্ন প্রথা, যেমন ‘ইউল লগ’ পোড়ানো, মোমবাতি জ্বালানো, ক্যারল গাওয়া— এ সবই এসেছে বা নেওয়া হয়েছে পুরনো নানা রকম আচার থেকে।
বিশুদ্ধতাবাদী খ্রিস্টানরা এসব খ্রিস্টপূর্ব ও (তাঁদের মতে) ‘বিধর্মী’ রীতি ও আচারের মাধ্যমে ক্রিসমাস পালনকে অনেক সময়েই ‘অপবিত্র আড়ম্বর আর উল্লাস’ বলে নিন্দা করেন। সপ্তদশ শতকে ম্যাসাচুসেটস-এর পিউরিটানরা আচার অনুষ্ঠানের বাড়াবাড়ি দেখে ক্রিসমাস উৎসবকেই নিষিদ্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি।
ক্রিসমাস কেক আর পুডিং কেবল নিজেদের লোভ মেটানোর একটা উপায়— এই অভিযোগ তুলে ১৬৬৪ সালে মার্কিন দেশে পিউরিটানরা তা নিষিদ্ধ করে দিতে উদ্যোগী হন। কিন্তু রাজা প্রথম জর্জ ফের ক্রিসমাসে কেক আর পুডিং-এর চল ফিরিয়ে আনলেন এবং সেইসব কেক পুডিং যেন আরও মিষ্টি হয়ে উঠল, যে মিষ্টিতে লোভে পাপ।
আরও পড়ুন-আসছেন মুখ্যমন্ত্রী, প্রস্তুতি খতিয়ে দেখলেন জেলা সভাধিপতি, উদ্বোধনের অপেক্ষায় চাকলাধাম
সান্তা ক্লজ কবে এলেন? কে-ই বা তিনি? উপকথায় বলে, তিনি নাকি চতুর্থ শতকের এক অত্যন্ত দয়াবান বিশপ। তাঁর আদি নিবাস তুরস্ক, নাম ছিল নিকোলাস। তিনি দীন-দরিদ্রদের সাহায্য করতেন, বিশেষত যাঁরা মুখ ফুটে সাহায্য চাইতে পারতেন না তাঁদের। আর সেই থেকে সান্তার জন্য বাচ্চারা মোজা ঝুলিয়ে রেখে দেয়, তাকে উদ্দেশ্য করে অপূর্ব সব চিঠি লেখে আর অপেক্ষা করে, কখন সান্তা এসে দারুণ সব উপহার দিয়ে যাবে। কবিতায় গানে গল্পে আমরা জেনেছি, কেমন করে সেই সন্ত উত্তর মেরু থেকে বড় বড় শিংওয়ালা হরিণে টানা স্লেজে চেপে বরফের মধ্যে দিয়ে এসে সারা পৃথিবীর অগণিত বাচ্চাকে উপহার দিয়ে যান। ক্রিসমাসের আগের রাত্রে শিশুরা ঘুমিয়ে পড়লে মা-বাবা মোজার ভেতর নানান খেলনা, উপহার রেখে সেই মোজা তাদের মাথার কাছে রেখে দেন। পরের দিন সকালে শিশু ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে গিয়ে সেই মোজা খুলে দেখতে যায় সান্তা তার জন্য কী উপহার রেখে গেছে— তৈরি হয় এই উত্সবের শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে যখন নৌবাণিজ্যের প্রসার হল, তখন নাবিকরা এই সন্তের গল্প বয়ে নিয়ে গেলেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, অচিরেই তাঁর নাম হল ‘ফাদার ক্রিসমাস।’ পরে ওলন্দাজ অভিবাসীরা এই লোককথাকে আমেরিকায় নিয়ে গেলেন, তাঁদের ‘সিন্টার-ক্লাস’ হয়ে গেলেন সান্তা ক্লস। সান্তা ক্লস তুরস্ক থেকে উত্তরমেরু পাড়ি দিয়েছেন এবং এখন তিনি অবাধে বিশ্বের সর্বত্র ঘুরে বেড়ান, পাসপোর্ট-ভিসার তোয়াক্কা না করে অনাবিল আনন্দ বিতরণ করেন।