যখনই আমাদের দেশে কোনও বড় ঘটনায় জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়, তখন অনেকে বলে তুঘলকি শাসন বা হিটলারি রাজত্ব চলছে। কেন এমন বলা হয়, দেখা যাক।
১৯৩৩-এর জানুয়ারিতে নাৎসি দলের নেতা অ্যাডলফ হিটলার জার্মান সরকারের চ্যান্সেলর বা প্রধান নিযুক্ত হন। ২৭ ফেব্রুয়ারি ‘রাইখস্ট্যাগ’ বা সংসদ ভবনে আগুন ধরে যায়। হিটলারের অভিযোগ, কম্যুনিস্টিরা তার সরকারকে উৎখাত করার জন্য নাশকতা শুরু করেছে। এরপর রাষ্ট্রপতি পল ভন হিডেনবার্গকে রাজি করিয়ে ‘রাইখস্ট্যাগ ফায়ার ডিক্রি’ জারি করান। যার ফলে জার্মানিতে নাগরিক অধিকার নিদারুণ সঙ্কুচিত হয়।
আরও পড়ুন-৬ হাজার নার্সের চাকরি রাজ্যে
বাক্ স্বাধীনতা, সভা-সমিতি, প্রতিবাদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা ছাড়াও জারি হয় জরুরি অবস্থা। কিন্তু এত ক্ষমতা করায়ত্ত করা সত্ত্বেও হিটলারের মনে স্বস্তি নেই। তাই তাঁর একাধিপত্য কায়েম করতে ওই বছর ২৩ মার্চ সংসদে নতুন আইন মঞ্জুরির জন্য পেশ করলেন। আইনি পরিভাষায় এটি ‘মানুষের দুর্দশা ও সংসদের বাধা দূরীকরণ আইন’ বলা হলেও সাধারণভাবে তা ‘ক্ষমতায়নের আইন’ (Enabling laws) হিসেবে গণ্য হয়। আইনটির মূল লক্ষ্য ছিল, এখন থেকে যে কোনও আইন আর সংসদে পাশ করানোর দরকার নেই। মন্ত্রিসভাই একমাত্র আইন তৈরি করবে। এমনকী রাষ্ট্রপতিরও সম্মতি লাগবে না। কিন্তু আপাতত ‘ক্ষমতায়নের আইন’ তো সংসদে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাধিক্যে পাশ করতে হবে। হিটলারের পক্ষে অত সমর্থন নেই। তাই তিনি কম্যুনিস্ট দলের মোট ৮১ জন সাংসদের সবাইকে ও সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের ১২০ জন সাংসদের মধ্যে ২৬ জনকে গ্রেফতার করে নির্বাসন শিবিরে বন্দি করেন। এরপর অন্যান্য বিরোধী দলের সাহায্য নেন। কিন্তু কোনও দলের সাংসদ যদি ওই আইনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে দেয়! তাই কোনও ঝুঁকি না নিয়ে হিটলারের ‘এস এ’ এবং ‘এস এস’ নামের মিলিশিয়া (আধা-সামরিক বাহিনী) ‘ক্রল অপেরা হাউস’ বা সংসদ কক্ষের আনাচে-কানাচে সাংসদদের শাসানি দিতে শুরু করে। প্রসঙ্গত মূল সংসদ ভবন আগুনে পুড়ে যাওয়ায় তা অপেরা হাউসে স্থানান্তরিত হয়। এতশত কাণ্ডের পরে দেখা গেল সংসদের প্রথম কক্ষ বা রাইখস্ট্যাগের ৪৪৪ জন সংসদ হিটলারের আইনটির পক্ষে ভোট দেন। ৯৪ জন বিপক্ষে, ১০৯ জন ভয়ে ভোট দিতে আসেননি। দ্বিতীয় কক্ষ অর্থাৎ রাইখস্ট্যাগের ৬৬ জন সাংসদই পক্ষে ভোট দেন। জার্মানির সুপ্রিম কোর্টও এ-বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি। আদালতের মতে, দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আইন তৈরি হয়েছে। তাই আদালতের হস্তক্ষেপ নিষ্প্রয়োজন। কম্যুনিস্ট ও সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের যে ভোটাভুটির আগেই নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল তার বিচার হল না। সংসদ ভবনে মিলিশিয়ার অনুপ্রবেশও গুরুত্ব পেল না। এইভাবে হিটলারের সর্বগ্রাসী একাধিপত্য শুরু হল। এই ঘটনার ৯০ বছর পরে ভারতীয় সাংসদদের ক্ষেত্রেও নেমে আসে অনভিপ্রেত অঙ্কুশ।
আরও পড়ুন-চমকে দেওয়া পরিষেবা, এবারের গঙ্গাসাগর আগের চেয়ে আলাদা
১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩। সংসদে জঙ্গি হামলার ২২তম বর্ষপূর্তির দিন লোকসভার দর্শক গ্যালারি থেকে লাফ দিল দু’জন। স্প্রে করল রঙিন ধোঁয়া। নতুন সংসদ ভবনের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কাঁচকলা দেখিয়ে কীভাবে অনুপ্রবেশ ঘটল! জানা গেল, অনুপ্রবেশকারীরা লোকসভারই এক বিজেপি সাংসদের ছাড়পত্র নিয়ে ওই কাণ্ড ঘটিয়েছে। ব্যাস। এই খবর জানাজানি হতেই সরকারের মুখে কুলুপ। ততক্ষণে লোকসভা তো বটেই, রাজ্যসভাতেও বিরোধীরা দাবি তুললেন— স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে বিবৃতি দিন। আলোচনা চাই। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টিভি চ্যানেলে এবং প্রধানমন্ত্রী একটি সংবাদপত্রে বললেন, গুরুতর বিষয়। তদন্ত শুরু হয়েছে, ইত্যাদি। কিন্তু সংসদের অধিবেশন চলছে। অতীতে এমন কোনও গুরুতর ঘটনা যখনই ঘটেছে, তখন সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রী, এমনকী প্রধানমন্ত্রীও সংসদে বিবৃতি দিয়েছেন।
আরও পড়ুন-রমাপ্রসাদ ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান
প্রথম দিনেই চলতি অধিবেশনের জন্য রাজ্যসভায় তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনকে বহিষ্কার করা হল। পরের দু’দিনে মোট ১৪৬ জন সাংসদকে বহিষ্কার করা হল। এক সর্বকালীন বিশ্বরেকর্ড। অপরাধ, সাংসদেরা সরকারের বিবৃতি ও আলোচনার দাবি করেছিলেন। কিন্তু সরকারের আসল উদ্দেশ্য ছিল, বন্ধু-বিরোধীরা ছাড়া বাকি বিরোধীদের সাসপেন্ড করে তিন-তিনটি কালা কানুনের সংশোধিত আইন পাশ করানো। ভারতীয় দণ্ডবিধি, ফৌজদারি পদ্ধতিবিধি এবং ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের সংশোধিত চেহারা হল— ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’। অনেকে বিদ্রুপ করে বলছেন— ‘অ-ন্যায় সংহিতা’। আইনটি আনা হল, অন্যায় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এই আইন কার্যকর হলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। হয়তো ‘মনুসংহিতা’ও ফিরে আসবে নতুন কলেবরে। সেদিন কি সাংসদ আইন পাশ করবে না মন্ত্রিসভা?