২০২১-এর বিধানসভা ভোটের আগে দিল্লি থেকে আসা পরিযায়ী বিজেপি-নেতারা হুঙ্কার ছেড়েছিলেন— “আব কি বার, ২০০ পার”। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলার মানুষ মাত্র ৭৭ আসনে আটকে দিয়েছিল তাঁদের দৌড়। সেই ১৯৪৬-এ পরাধীন ভারতে অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রাদেশিক আইনসভার ভোটে হিন্দু মহাসভা পেয়েছিল মাত্র তিনটি আসন। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় জনসংঘ তৈরি হওয়ার পরবর্তী তিন দশক এবং ১৯৮০ সালে বিজেপি গঠিত হওয়ার পরে, আজ সাড়ে চার দশকেও বাংলার মাটিতে, বাঙালির কাছে নিজেদের আদৌ গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারেনি বিজেপি ও সংঘ-পরিবার। আজও বাঙালির চোখে বিজেপি মূলত হিন্দি-বেল্ট বা গোবলয়ের পার্টি। বাঙালির ডিএনএ-তে বিজেপির সংকীর্ণ হিন্দুত্ববাদ নেই। বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি, বাঙালি মনীষীদের বাণী ও রচনা খুঁটিয়ে পড়লেই বোঝা যায়, বিজেপি বাঙালিকে বোঝে না, সে বাঙালির উচ্চ মেধা ও সংস্কৃতিকে মেনে নিতে পারে না। ফলত, বাংলাও তাদের খালি হাতে ফেরায় বারবার।
আরও পড়ুন-বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের ধাঁচে বিজনেস হাব তৈরি হবে নিউটাউনে
আমরা সকলেই জানি, কৃত্তিবাসী রামায়ণ আদি বাল্মীকি রামায়ণ অনুসারে লেখা হলেও সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী ভক্তিবাদী আন্দোলনের প্রভাবে কৃত্তিবাসের রামায়ণ বহু ক্ষেত্রেই সংস্কৃত রামায়ণ থেকে সরে এসেছে। এতে বাঙালির সাংস্কৃতিক নিজস্বতা এতটাই আরোপিত হয়েছে যে, কাব্যের মূলরস, প্রধান চরিত্রসমূহ অনেকাংশেই পালটে গিয়েছে। সংস্কৃত রামায়ণে শৃঙ্গার, বীর, করুণ, শান্তরস মুখ্য। কিন্তু বাংলা রামায়ণে ‘বীররস’ প্রায় অনুপস্থিত। বাল্মীকি রামায়ণের মতো বাঙালি রাম ‘হাইপারম্যাস্কুলিন’ নন, তিনি অনেক বেশি আবেগী, স্ত্রীবশ্য ও কিছুটা ভীতুও বটে। রাজ্যাভিষেকের আগে রামচরিত্রে দেখি দ্বিধাদুর্বলতা, একইসঙ্গে আসন্ন বিপদসমূহের আশঙ্কা— “আমি রাজ্য পাইব বিমাতা চিন্তান্বিতা।।/ কোন্যুক্তি কুঁজি দিল বিমাতার তরে।/ না জানি বিমাতা আজ কোন্যুক্তি করে”।। সীতার প্রতি রামের মনোভাবেও ক্ষত্রিয়সুলভ দার্ঢ্য নেই। ইন্দ্রজিৎ ‘মায়াসীতা’ বধ করলে দুর্বলচিত্ত মানুষের মতোই রামের বিলাপ— “সীতা না দেখিলে আমি না পারি রহিতে।/ সীতার মরণে ক্ষমা দিব কিসে চিত্তে”। আসলে যত সময় এগিয়েছে, দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, কৃত্তিবাসী রামায়ণে বৈষ্ণব ভক্তিবাদ প্রভাব ফেলেছে এবং রাম চরিত্রটিও বদলে গিয়েছে। শাক্তভক্তির চেয়ে বৈষ্ণবভক্তিই এই অ-ক্ষত্রিয়সুলভ রামের উপর আরোপিত হয়েছে বেশি। এই বাঙালিসুলভ কোমলতার কারণেই দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন— “এখানে কামান ভাঙিয়া ফুলধনু গড়া হয়েছে”। উত্তর ভারতীয় রণংদেহী চারিত্রধর্ম এই রামের নেই। বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘রামায়ণ’ প্রবন্ধে লিখেছেন— “কৃত্তিবাস… প্রাদেশিক। বাঙালি মাত্র, শুধু বাঙালি”। তাই বিজেপির রাম বাঙালিকে প্রভাবিত করতে পারেনি। ডিজিটাল মিডিয়ায় যে চূড়ান্ত পৌরুষসম্পন্ন রামের দৃশ্যায়ন বিজেপির আইটি সেল করে চলেছে, তা বাঙালিকে প্রভাবিত করে না।
এবার আসি খাদ্যাভ্যাসের প্রসঙ্গে। বিভিন্ন সময়ে বিজেপির একাধিক নেতা বাঙালির আমিষ খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বিরূপ উক্তি করেছেন। সম্প্রতি তিন রাজ্যে জয়ের পর মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব সরকারি আদেশনামা জারি করে রাজ্যের প্রকাশ্য স্থানে মাছ, মাংস, ডিম বিক্রি নিষিদ্ধ করেছেন।
আরও পড়ুন-পঞ্চায়েতের উদ্যোগে সমুদ্রসৈকতে হল রাস্তা, গেস্ট হাউস
রাজস্থানের জয়পুরের হাওয়ামহল কেন্দ্রের বিজয়ী বিজেপি বিধায়ক বালমুকুন্দ আচার্য তাঁর বিধানসভা এলাকায় আমিষ খাবার বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার বই যাঁরা গত একশো বছর ধরে বিক্রি করছেন সেই ‘গীতা প্রেস’ প্রকাশিত ‘আহার নিরামিষ না আমিষ?’ পুস্তিকায় (২০২৩) ছত্রে ছত্রে আমিষ খাবারের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করা হয়েছে। বাঙালি হিন্দু দীর্ঘদিন যাবৎ শাক্তসাধনায় অভ্যস্ত। বাংলার অধিকাংশ মানুষ আমিষ ভক্ষণ করেন। গোবলয়ের জবরদস্তি নিরামিষ খাদ্যাভ্যাস-চাপানো সংঘী মানসিকতাকে বাঙালি কখনওই মেনে নেবে না। সংখ্যালঘু মানুষকে ‘শত্রু’ হিসেবে টার্গেট বানানোর জন্যই বিজেপির এই নিরামিষ-প্রীতি, এটা বাংলার মানুষ বিলক্ষণ বোঝেন।
আরও পড়ুন-অজানা নিউমোনিয়া
গোটা মধ্যযুগ জুড়ে বৈষ্ণব ভাবান্দোলনের পাশাপাশি অন্যান্য ভক্তিবাদী ধারা যে সমন্বয়ী ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সাধনার জন্ম দিয়েছে বাংলায়, তার উত্তরাধিকার বহু অপচেষ্টা সত্ত্বেও এখনও অটুট। ‘ভারতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা’ বইয়ের লেখক মনীষী ক্ষিতিমোহন সেন দেখিয়েছেন, হিন্দুধর্মের ইতিহাসে অন্যকে গ্রহণ করার ক্ষমতা ও বহুমত-সহিষ্ণুতার এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বিশেষত, দ্বাদশ শতকের পর “হিন্দুধর্মের বিবর্তনকে নিরপেক্ষভাবে দেখলে মহান ধর্ম ইসলামের সৃজনশীল প্রভাবকে অস্বীকার করার কোনও উপায় থাকে না”। এই সমন্বয়ী সাধনার পীঠস্থান বাংলা। বাংলার বাউল, সুফী, সহজিয়া, কর্তাভজা, সাহেবধনী ইত্যাদি অজস্র ভাবকাঠামো তন্ত্রের অন্যতম সাধনস্থল এই বাংলায় বহু শতক জুড়ে এক বিচিত্র সমন্বিত সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। গ্রামবাংলার মাজারে প্রদীপ জ্বালতে যান হিন্দু কুলবধূ, মন্দিরের বটবৃক্ষে মনস্কামনার ঢিল বাঁধেন মুসলিম যুবক। সংঘ পরিবারের সংকীর্ণ একমাত্রিক আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক হিন্দুত্ব দিয়ে বাংলাকে উপলব্ধি করা অসম্ভব। সংঘ পরিবার যে এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক নেতার ফ্যাসিবাদী দর্শনে বিশ্বাস করে, তারই বহিঃপ্রকাশ হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি আধিপত্যবাদ। এদের শীর্ষনেতার মিছিল থেকেই কলকাতায় বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছিল। এদের নেতা জানেনও না রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান কোথায়। এই বাঙালি-বিরোধী, বাংলা-বিদ্বেষী শক্তিকে পশ্চিমবঙ্গ কখনও মেনে নেবে না।