প্রতিবেদন : বিধানসভা উপনির্বাচনে চার কেন্দ্রেই তৃণমূল কংগ্রেসের বিরাট ব্যবধানে জয়। কেন তৃণমূলের উপর মানুষের বিশ্বাস, আস্থা, ভরসা ক্রমশ বাড়ছে? কেন বুথ উজাড় করে মানুষ ভোট দিলেন? কেন নিজের পাড়ার বুথেই হেরে গেলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক? কেন বিধানসভা ভোটের চাইতেও উপনির্বাচনে জয়ের ব্যবধান লাফিয়ে বাড়ল? কেন তিন কেন্দ্রে জামানত জব্দ হল বিজেপির!
বিশ্লেষণ বলছে মানুষের বিরক্তি আর নিরাপত্তাহীনতা এবার মস্ত বড় ভূমিকা ছিল উপনির্বাচনে।
এক. মানুষ বিরক্ত। পেট্রোল, ডিজেল, গ্যাস, জিনিসপত্রের দাম, ব্যাঙ্কের সুদ কমিয়ে দেওয়া, পিএফের সুদ কমানো, জিএসটির নামে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে মানুষ ক্ষুব্ধ। সরাসরি কেন্দ্রের সরকার মানুষের পেটে টান মেরেছে।
দুই. মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একের পর এক জনমুখী প্রকল্প। কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, থেকে শুরু হয়েছিল। তারপর স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড, দুয়ারে সরকার কিংবা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, একের পর এক চালু হয়েছে। পড়ুয়া থেকে কৃষক, বাড়ির মহিলা থেকে আশা কর্মী, সকলের কাছে সরকার প্রকল্প নিয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ এটাকে ডোল পলিটিক্স বললেও আসলে মানুষ যে উপকার পাচ্ছেন, তা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে এক মাসে এক কোটির বেশি মহিলার নাম নথিভুক্তীকরণ প্রমাণ দিচ্ছে। দুয়ারে রেশন চালু হলে সেটাও হবে বড় মাইলস্টোন। দেশের যে কোনও রাজ্যে এই প্রথম। রাজ্যের এমন কোনও পরিবার এখন প্রায় পাওয়াই মুশকিল, যে পরিবার রাজ্য সরকারের প্রকল্পের সুবিধা পায়নি।
তিন. কাজে পেরে না উঠে বিজেপি সুযোগ পেলেই ধর্মীয় বিষয়ে সুড়সুড়ি দেওয়ার কাজ শুরু করে দেয় রাজ্যে। এই উপনির্বাচনেও বিরোধী দলনেতা শান্তিপুরে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশের ঘটনায় বিজেপির লাভ হবে, ভোট বাড়বে। ভোটের মধ্যে সরাসরি রাজনীতি টেনে আনা মানুষ মেনে নিতে পারেননি। এটা বাংলার সংস্কৃতি নয়।
চার. কোভিড পরিস্থিতি এবং তার মোকাবিলায় কেন্দ্রের পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ রাজ্যের মানুষ। বিশেষত টিকা রাজনীতি। বিজেপি শাসিত রাজ্যকে বেশি টিকা দেওয়া, বাংলাকে বঞ্চিত করার দৃশ্য মানুষ দেখেছেন। সীমিত ক্ষমতার মধ্যেই রাজ্য সরকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে মানুষের পাশে থাকতে। শুধু তাই নয়, পরিযায়ী শ্রমিকদের কেন্দ্র মানুষ বলেই ধর্তব্যে আনেনি। সেখানে রাজ্য তাদের শুধু বাড়ি ফিরিয়ে এনেছে তাই নয়, দিয়েছে বিকল্প রোজগারের সুযোগ।
পাঁচ. রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলা ঘূর্ণিঝড় যশে ছারখার হয়ে যায়। আমফানের রেশ যেতে না যেতেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রধানমন্ত্রী এসে মাত্র এক হাজার কোটির ঝুলি ধরিয়েছেন! দরকার ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা! মানুষ দেখেছেন, ঝড়-জলে পাশে ছিল কারা! পাশে থাকার পর ঝড়-বিধ্বস্ত এলাকা গড়ার অর্থও রাজকোষ থেকে দিয়েছে রাজ্য। মানুষ বুঝেছেন।
ছয়. বাহিনী, কমিশন দিয়ে ভোট করিয়ে রাজ্যের মানুষের ভ্রুকু়ঞ্চনের মধ্যে পড়েছে বিজেপি। শুধু তাই নয়, বাহিনীর বাড়াবাড়ি এবং কমিশনের স্বেচ্ছাচারিতায় কোভিডের মধ্যেও বিধানসভা ভোট ৮ দফায় হয়। মানুষ মেনে নিতে পারেননি। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের পথ খুঁজছিলেন।
সাত. কেন্দ্রে কংগ্রেস যত দুর্বল হয়েছে, ততই মানুষ বিকল্প খুঁজে নিতে চেয়েছেন। লোকসভা ভোটে মানুষ বিকল্প না পেয়ে সাময়িক বিভ্রান্তিকর প্রচারে মোদিকে সমর্থন করেছিলেন। বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের বিরাট জয়ের পর মানুষের বিকল্পের সন্ধানে ঘোরা বন্ধ হয়।
আট. বিজেপিকে সবচেয়ে বেশি ডুবিয়েছে ব্যক্তি আক্রমণ। যত আক্রমণ হয়েছে তত ভোট কমেছে। লড়াইয়ে এঁটে না উঠলেই সিবিআই-ইডির চিঠি যেভাবে খোলামকুচির মতো ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে মানুষ বিরক্ত। এমনকী নির্বাচন কমিশনও বাদ যায়নি। সীমান্তে বিএসএফের এক্তিয়ার বাড়ানো আসলে যে রাজ্যগুলির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ সবাই বুঝেছেন। জিএসটি থেকে রাজ্যের প্রাপ্য সবেতেই বঞ্চনা। মানুষ বুঝেছেন। যথার্থ জায়গায় জবাব দিয়েছেন।