কালীপুজো এবং দীপাবলি মোম, প্রদীপ, বাজি, হাওয়াই, ফুলঝুরির উৎসব। দু’বছর আগেও কালীপুজো বা দীপাবলিতে বাজি পোড়ানো নিয়ে এত ভাবনা-চিন্তা ছিল না, কিন্তু করোনাকালে শঙ্কিত চিকিৎসকমহল। পরিবেশবান্ধব বাজি পোড়ানোর ক্ষেত্রে ছাড়পত্র দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ কীভাবে কাটাবেন সুরক্ষিত দীপাবলি —জানাচ্ছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী
কাল থেকে শুরু কালীপুজো এবং দীপাবলির আলোর রোশনাই। দুর্গাপুজোর ওই জাঁকজমকের পর এ এক অন্য আনন্দ। মোমবাতি, প্রদীপ, এলইডি লাইটের রঙবাহারি ছটায় ঝলমল করে উঠবে চারপাশের পরিবেশ। ভীড়ভাট্টা, ঠাকুর দেখার চেয়ে এদিন যেন সবার মধ্যে আতশবাজির প্রতিযোগিতা। কে কত বাজি পোড়াতে পারে! যদিও শব্দবাজির উপর রয়েছে বিধিনিষেধ। সম্প্রতি কোভিডকালে দীপাবলিতে বাজির উপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সরব চিকিৎসক মহল। বক্তব্য একটাই করোনা রোগীর জন্য বাজির ধোঁয়া বিষ, সেই সঙ্গে দূষণের প্রভাব সবার উপরেই সমান। যাতে সবার দীপাবলি সফল হয় সেই কারণে সুপ্রিম কোর্ট পরিবেশবান্ধব আতশবাজি পোড়ানোর ছাড়পত্র দিয়েছে৷ পরিবেশবান্ধব বাজি বা গ্রিন ক্র্যাকার্স হল বেরিয়াম নাইট্রেট এবং পটাশিয়াম নাইট্রেট-মুক্ত বাজি। এর দূষণমাত্রা ৩০ শতাংশ এবং শব্দের মাত্রা ১১০ ডেসিবেলের বেশি হবে না৷ জানা যাচ্ছে এই বাজিতে অ্যালুমিয়ামের বদলে ম্যাগনেশিয়াম ব্যবহার করা হয়৷ আলোর উৎসবে মাতোয়ারা হবেন সবাই। এর মধ্যেও যাঁরা বাজি পোড়াবেন তাঁরা অবশ্যই সরকারি বিধি-নিষেধ, নিয়ম মেনে চললে ভয় থেকে মুক্ত হয়ে আনন্দে শামিল হতে পারবেন।
আরও পড়ুন-শুভেন্দুর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসকে কটাক্ষ কুণাল ঘোষের
কী কী করবেন
শব্দবাজি একদম নয়, আলোর বাজি পোড়ান। কারণ শব্দবাজি বেশি দূষণ ছড়ায়। বাতাসে ভেসে থাকা বাজি থেকে নির্গত বিভিন্ন রাসায়নিক চোখের জলের লিপিড স্তরকে নষ্ট করে দেয়। চোখ জ্বালা করে, জল পড়ে। তাই চোখ বাঁচিয়ে বাজি পোড়ান। শব্দবাজির আওয়াজে কানের সমস্যা বা হার্টের সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে আশপাশে বয়স্ক, অসুস্থ মানুষ, করোনা থেকে সেরে উঠেছেন এমন মানুষ থাকলে তাঁদের জন্য সুরক্ষিত ভাবে, পরিবেশবান্ধব বাজি বা গ্রিনক্রাকার্স পোড়ান— বলা হচ্ছে যার দূষণ মাত্রা তিরিশ শতাংশর বেশি হবে না।
খুব ঘিঞ্জি জায়গা, ছোট বারান্দা, ঘর সংলগ্ন কোনও স্থানে বাজি পোড়াবেন না। দেখে নেবেন আশেপাশে দাহ্যবস্তু না থাকে। অন্য বাজিগুলো পোড়ানোর জায়গা থেকে দূরে রাখুন। খোলা জায়গায়, মাঠে বাজি পোড়ালে অনেকটা সমস্যামুক্ত থাকবেন। আপনার বাজির ধোঁয়া অন্যের কষ্টের কারণ হবে না।
বাচ্চাদের হাতে বাজি না দেওয়াই ভাল। তাঁদের হাতে বাজি দিলে ফুলঝুরি জাতীয় কিছু দিন। যেটা দূর থেকে হাতে ধরে জ্বালানো যায়। তাঁদের একা কখনও বাজি পোড়াতে দেবেন না।
বাজি ধরাতে লম্বা ইনসেন্স স্টিক বা পাটকাঠি ব্যবহার করুন। দেশলাই দিয়ে বাজি জ্বালানোয় ঝুঁকি অনেক বেশি। হাত, আগুন আর বাজির দূরত্ব যত বেশি রাখা যায় ততই মঙ্গল।
বাজি পোড়ানোর সময় সুতির হাত-পা ঢাকা পোশাক পরুন। পথেঘাটে যত্রতত্র বাজি পোড়াবেন না। কারণ পথচলতি মানুষ এতে বিপদগ্রস্ত হতে পারেন। পায়ে জুতো পরে বাজি পোড়ান। ক্লোজড শ্যু হলে ভাল। কারণ বাজি পোড়াতে গিয়ে হাত এবং পা সবচেয়ে রিস্ক জোনে থাকে।
বাজির মধ্যে দাহ্যপদার্থ ছাড়াও থাকে নানারকম ক্ষতিকারক রাসায়নিক। বাজির ধোঁয়া যা খুব কষ্টকর সেই থেকে শ্বাসকষ্ট বা অ্যালার্জি হতে পারে। তাই বাজি পোড়ানোর সময় নাক-মুখ চাপা দিয়ে রাখলে ভাল। চশমা থাকলে চোখ অনেকটা বাঁচবে বাজির ফুলকি থেকে। সেফটি গগলস ব্যবহার করুন। করোনাকালে মাস্ক পরছেন সবাই। এই মাস্কই আপনিকে বাজির ধোঁয়া থেকে বাঁচাবে।
যেখানে বাজি পোড়াবেন সেখানে একবালতি জল আর বালি রেখে দিন। আগুন নেভাতে বালি খুব জরুরি। বাজির আগুনে পুড়ে গেলে ফোস্কা পড়ার আগে ঠান্ডা জল দিলে অনেকটা আরাম মেলে জ্বালাভাব কমে।
কিছু ওষুধপত্র, মলম, আইড্রপ হাতের কাছে রাখুন। যাতে বাজিতে অল্প ছ্যাঁকা খেলে ফার্স্ট-এড করা যায়।
যাঁদের হাঁপানি আছে তাঁদের বাজি না পোড়ানোই ভাল। করোনা থেকে মুক্ত হয়েছেন যাঁরা এই বছরটি নিজের ক্ষতি করবেন না। দূর থেকে বাজি পোড়ানো দেখুন।
অনেকের বাজির ধোঁয়া থেকে একটানা হাঁচি হয় যাকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলে অ্যালার্জিক রাইনাইটিস। তাঁরা বাজির ধোঁয়া এড়িয়ে চলুন। কারণ পরিবেশ ধোঁয়ামুক্ত, হবে না। শরীরে যতই রোগ থাক এমন একটা দিনে একদম বাড়িতে বসে থাকতে কারই বা মন চায়। তাই বাইরে বেরতে চাইলে এক-আধটা ফুলঝুরি জ্বালাতে মন চাইলে আগে একটু চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিন। নাক-মুখে সুতির একটু ভিজে কাপড় বেঁধে নিন।
বাজিতে পুড়ে গেলে কী করবেন
বাজি পোড়ানোর সময় অনেক সতর্কতা মেনে চললেও কখনওসখনও দুর্ঘটনা হয়েই যায়। বিশেষজ্ঞের মতে যেই মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটলে ঘাবড়ে যাবেন না। সঙ্গে সঙ্গে পোড়া জায়গায় প্রচুর পরিমাণে ঠান্ডা জল ঢালুন। কলের তলায় পোড়া জায়গাটা ধরে থাকুন। বরফ দেবেন না। পাঁচ মিনিট একইভাবে ধরে রাখুন কলের জলের নিচে।
পোড়া অংশে পোশাক থাকলে সেটি ছিঁড়ে ফেলুন। হাওয়া খেলতে দিন। শ্বাসকষ্ট হলে খোলা জায়গায় চলে যান। এবার ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মলম লাগান। চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক এবং হালকা পেনকিলার খেতে পারেন। ফোস্কা পড়বে অবশ্যই তাতে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই, খেয়াল রাখবেন ফোস্কা যেন ফেটে না যায়। কারণ ফোস্কা ফেটে গেলে ক্ষত শুকতে অনেক সময় লাগে এবং কষ্টদায়ক হয়। বেশি পুড়ে গেলে হাসপাতালে যান অবিলম্বে।
চোখে বাজির ফুলকি ছিটকে এলে সঙ্গে সঙ্গে চোখে জলের ঝাপটা দিন। সম্ভব হলে ঠান্ডা সেঁক দিন। চোখ রগড়াবেন না। মলম, ওষুধ কিছু দেবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বাচ্চাদের যদি এমন কিছু ঘটে দ্রুত ডাক্তারের চেম্বারে বা হাসপাতালে নিয়ে যান। কখনও নিচু হয়ে সামনে গিয়ে বাজি জ্বালাবেন না বা জ্বালাতে দেবেন না।
আরও পড়ুন-চারে চার, বিজেপি পাংচার
দেখে নেওয়া যাক চেস্ট প্র্যাকটিশনার ডাঃ দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত–র পরমর্শ
ধরুন যেসব বাচ্চাদের ঠান্ডা লাগার প্রবণতা রয়েছে অল্পেই সর্দিকাশি লেগে যায় তাঁদের বাজির ধোঁয়া থেকে ফুসফুসে সমস্যা হতে পারে তাই বাজির ধোঁয়া থেকে দূরে থাকাই ভাল। বয়স্কদের ক্ষেত্রে ক্রনিক অবস্ট্র্যাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি যাঁদের রয়েছে বা ব্রঙ্কিওল অ্যাজমা বা হাঁপানি, ব্রঙ্কিয়েকটেসিস রয়েছে, লাংয়ের অন্য রোগ যেমন টিউবারকিউলোসিস হয়েছে, এবং কোভিড রোগী যাঁরা সুস্থ হয়ে উঠেছেন তাঁদের জন্য কিন্তু বাজির ধোঁয়া ভীষণ পরিমাণে ক্ষতিকর। প্রতি ৭০ জন করোনা রোগীর মধ্যে ৬০-এর বেশি মানুষের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত পাওয়া যাচ্ছে। ধূসর প্যাচ এমনটা নয় যে শুধু কালীপুজো বা দিওয়ালির দিন বাজি ফাটানো হল আর তখন তখনই শুধু সমস্যা হল, বাজি পোড়ানোর ফলে যে বিষাক্ত ধোঁয়াগুলো বেরয় বাতাসে মিশে যায় সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, অ্যালুমিনিয়াম, ক্যাডমিয়াম, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডসহ ভারী ধাতু বাতাসে মিশে থাকে। এগুলো ভারী হয় বলে নিচের দিকে থাকে। পরের দিন যাঁরা মর্নিং ওয়াক বা ইভিনিং ওয়াকে বেরচ্ছেন যে বয়স্ক মানুষেরা তাঁদের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে এগুলো শ্বাসনালিতে পৌঁছয়। ফলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হন। কোভিড আসার পর এই বিপদ আরও ভীষণভাবে বেড়ে গেছে। আমাদের লাংয়ে যে নর্মাল টিস্যু বা ছোট ছোট বায়ুথলিগুলো রয়েছে সেইগুলো খুব স্থিতিস্থাপক হয়, এগুলো বেলুনের মতো আমরা ফোলাই এবং চুপসে ফেলি অর্থাৎ অক্সিজেন দেওয়া-নেওয়া হয় সেখানে কোভিড ভাইরাসের প্রভাবে নর্মাল টিস্যুগুলো নষ্ট হয়ে যায় এবং একটা ফাইবার বা ফাইব্রোসিস তৈরি হয়। শরীরের ভিতরে কোনও ক্ষত বা ইনফেকশন হলে সেই ক্ষতকে নিরাময় করে ফাইবার বা ফাইব্রোসিস দিয়ে। এই পালমোনারি ফাইব্রোসিসের জন্য লাং সেই ইলাস্টিসিটিটা হারিয়ে ফেলে। ফলে কোভিড হওয়ার আগে তাঁর যে ধারণক্ষমতা ছিল, লাংয়ের সেই ইলাস্টিসিটি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে নতুন করে আর ওই বায়ুথলিগুলো তৈরি হয় না। ফাইবার সেই জায়গা পূরণ করে দিলেও ফাইবারের সেই ইলাস্টিসিটি নেই। ফলে এই ধরনের রোগীর ফুসফুস এমনিতেই দুর্বল রয়েছে। যাঁদের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি তাঁরাও কিন্তু শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। বাজির ধোঁয়া এইসব মানুষের শ্বাসকষ্ট আরও বাড়াবে। আলোর বাজি হোক বা শব্দবাজি এর মধ্যে থাকে কার্বন, সালফার, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম অকসালেট, আয়রন ডাস্ট, অ্যালুমিনিয়াম, বেরিয়াম নাইট্রেট ইত্যাদি বহু ক্ষতিকারক কেমিক্যাল। সেই বাজি পোড়ানোর ফলে এইসব কেমিক্যালের বিষাক্ত ধোঁয়া এবং ভাসমান ধূলিকণা তৈরি হয়। কালীপুজোর কয়কটা দিন রাত ন’টা থেকে এগারোটা অবধি সব বাতাসে স্মগ বা ধোঁয়াশা থাকে সেগুলো বাতাসে দূষণের মাত্রা বাড়ে, মেশে এবং দুর্বল শ্বাসযন্ত্র যাঁদের তাঁদের আরও বেশি ক্ষতি করে বলাই বাহুল্য। তাই এই বছরটা দীপাবলিতে আনন্দ করুন আলো দিয়ে।