সংসদীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ছুঁড়ে ফেলে একনায়কতন্ত্রের দিকে পা বাড়াতে চাইছে

আগামীতে ভয়ানক দিন রুখতে লড়তে হবে এক সাথে। নেত্রী বলেছেন, আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়লে রাম-বাম সব উবে যাবে। সেই কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে তেমন লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরছেন অনির্বাণ সাহা

Must read

মোদি জমানায় দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকেই বিদায় করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এই দর্শন মেনেই, জিএসটি চালু করে কেন্দ্রীয় নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। এই দর্শন মেনেই ‘এক দেশ, এক ভোট’-এর তত্ত্ব সামনে আনা হয়েছে। সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়’ কথাগুলি ছেঁটে ফেলার ভাবনার কথাও শোনা যাচ্ছে। মোদির নাম, ছবি প্রচারে রাজি না হলে কৌশলে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থবরাদ্দও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো বিষয়েও রাজ্যের অধিকারে একতরফাভাবে হস্তক্ষেপ করারও চেষ্টা হচ্ছে। এই দর্শন মেনেই যাবতীয় ‘সাফল্য’ মোদি সরকারের নামে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। এমনকী কেন্দ্র-রাজ্যের যৌথ প্রকল্পেও প্রধানমন্ত্রী মোদির নামমাহাত্ম্য প্রচারের ফরমান জারি হচ্ছে! এই দর্শনেই সংসদের বুড়ি ছুঁয়ে, আসলে বিরোধীদের এড়িয়ে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ করানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন-রোদ উঠেছে হাসি ফুটেছে

খবরে প্রকাশ, ২০১৩ সালে চতুর্দশ অর্থ কমিশন যখন গঠিত হয় তখন করবাবদ আয়ের ৩২ শতাংশ অর্থ রাজ্যগুলির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হত। তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মোদি দাবি করেছিলেন, আদায় হওয়া করের অর্ধেক অর্থাৎ ৫০ শতাংশ দেওয়া হোক রাজ্যগুলিকে। সেই নরেন্দ্র মোদি ২০১৪-তে প্রধানমন্ত্রী হয়েই ভোল বদলে ফেলেছেন। অর্থ কমিশনই কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে করের ভাগ কী হবে তা ঠিক করে। তখন অর্থ কমিশনের সুপারিশ ছিল, রাজ্যগুলির ভাগ ৩২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪২ শতাংশ করা হোক। কিন্তু মোদি চান, রাজ্যগুলির ভাগ ৩৩ শতাংশ হোক।

আরও পড়ুন-প্রাচীন বাংলার অখ্যাত শীতমেলা

রাজ্যগুলি আর্থিকভাবে দুর্বল হলে কেন্দ্রের উপর তাদের নির্ভরতা বাড়বে। অর্থাভাবে রাজ্যগুলি উন্নয়নের কাজও ঠিকমতো করতে পারবে না। ফলে অর্থ আর ক্ষমতার আতিশয্যে রাজ্যগুলির একমাত্র আশ্রয় হয়ে উঠতে পারবে কেন্দ্র। সহজ হিসাবে, দিল্লির কথায় ওঠবোস করতে হবে রাজ্যগুলিকে। তারপর প্রচারের কাজটি সহজ হবে, রাজ্যের উন্নয়ন করে দিচ্ছে ‘মোদি সরকার’। রাজ্যগুলিকে আর্থিকভাবে দুর্বল করে কেন্দ্রকেই দেশীয় প্রশাসনের পরোক্ষ ভরকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। এ একেবারে একনায়কতন্ত্রের পদধ্বনি। ফ্যাসিবাদের পুনর্জাগরণ।

আরও পড়ুন-এক ডজন পিকনিক স্পট

বেনিতো মুসোলিনির রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ‘ফ্যাসিবাদের’ জন্ম হয় ইতালিতে। ১৯২২ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তাঁর শাসনকালে ইতালিতে ফ্যাসিবাদী শাসনের অস্তিত্ব ছিল। ফ্যাসিস্ত দল গড়ার আগে তিনি ইতালীয় সমাজতান্ত্রিক পার্টির সদস্য ছিলেন। কিন্তু পার্টির প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার ভূমিকার বিরোধিতা করায় তিনি বিতাড়িত হন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর মতাদর্শ পাল্টে ফেলে ১৯১৯ সালে ফ্যাসিস্ত আন্দোলন ও পার্টির জন্ম দেন। ১৯২২ সালে তিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯২৫ সালে বিরোধীদের সমস্ত ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে তিনি ফ্যাসিবাদী শাসন শুরু করেন। একটি নতুন আইন তৈরি করা হয় যাতে সংসদের সমস্ত আসনের দুই-তৃতীয়াংশ আসন সবচেয়ে শক্তিশালী দলের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। বাকি আসন বিরোধীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। ‘নির্বাচনে ভোটদান, প্রতিনিধি সভা ইত্যাদি’র মতো জনগণের রায় নেওয়ার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলির ‘প্রায় কোনও দরকারই নেই যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে।’ রুশো লিখেছেন, ‘কারণ শাসকরা ভালই জানে যে সাধারণের ইচ্ছা সবসময় তাদের দিকেই থাকে যদি তা জনহিতৈষী হয়; যেটা সর্বাপেক্ষা ন্যায্য, তাই ন্যায়পূর্বকভাবে কাজ করলেই সাধারণের ইচ্ছা মেনে চলা হয়।’ রুশোর এই কথাগুলোই ফ্যাসিবাদী দর্শনের আঁতুড় ঘর। একইভাবে কমিউনিজমের ভিত্তি। সত্যি কথা বলতে কি, ফ্যাসিবাদ এবং কমিউনিজম— উভয়েই হল একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দুটি আলাদা রূপ। আর একনায়কতন্ত্রের এই দুই রূপের বিরুদ্ধে লড়াই জনগণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার। আজকের বাংলায় এই লড়াই তাই একইসঙ্গে রাম ও বামের সঙ্গে মা মাটি মানুষের লড়াই।

আরও পড়ুন-ধান কেনাতেও কেন্দ্রের বঞ্চনা, তবু স্বনির্ভর প্রকল্পে ৩০ হাজার কোটি

মুসোলিনি লিখেছিলেন, ‘জীবনের ফ্যাসিবাদী ধারণা হল ধার্মিক প্রকারের, যেখানে মানুষকে একটি উচ্চতর নিয়মের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে দেখা হয় এবং তাকে একটা বাস্তব ইচ্ছাশক্তি দেওয়া হয় যাতে সে তার নিজত্বের গণ্ডি ভেঙে একটি আধ্যাত্মিক সমাজের অংশ হতে পারে। যারা ফ্যাসিবাদী রাজত্বের ধার্মিক নীতির সুবিধাবাদের দিকগুলির চেয়ে বেশি কিছু বোঝে না, তারা বুঝতে পারে না যে ফ্যাসিবাদ শুধু একটা শাসনপ্রণালীই নয়, কিন্তু তা বাদ দিয়েও এবং সর্বোপরি এটা একটা চিন্তাকাঠামো।’ এই বক্তব্য বুঝিয়ে দেয় যে ফ্যাসিবাদ কতটা কার্যকরভাবে জনগণকে ভুল পথে চালিত করার ক্ষমতা রাখে। আজকের ভারতে রামের নামে, দুর্নীতিমুক্ত করার নামে, কার্যকর প্রশাসনের নামে, বিজেপি এই কাজটাই করছে।
আজকের ভারতে রামনামে অসত্যকে সত্য হিসেবে, অনৈতিককে নীতি শিরোমণি হিসেবে তুলে ধরার মরিয়া চেষ্টা স্পষ্ট। এটা করা হচ্ছে একেবারে হিটলারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। আর্যদের গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে হিটলার লেখেন, ‘আমাদের এই গ্রহে মানব-সংস্কৃতি ও সভ্যতা আর্যদের উপস্থিতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাকে যদি বিনষ্ট করা বা দমিয়ে রাখা হয় তাহলে নব্যবর্বর যুগের কালো চাদর পৃথিবীকে ঢেকে ফেলবে।’

আরও পড়ুন-রাজ্যপাল-নিযুক্ত উপাচার্যেরা শিক্ষাক্ষেত্রে গেরুয়াকরণ চান

এর উলটোদিকে মার্কসবাদী কমিউনিস্টদের ভূমিকাও প্রশ্নাতীত নয়, বরং সন্দেহ করার মতো ও বিরক্তিকর। বিপক্ষকে পঙ্গু করতে ও নিজস্ব পদ্ধতিসমূহকে কার্যকর করতে মুক্তহস্ত হওয়ার জন্য মার্কসবাদীরা গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে। যখন কিছু মার্কসবাদী গোষ্ঠী নিজেদের সমস্ত নির্মাণকুশলতা দিয়ে একটা সময়ের জন্য বোঝাতে চেষ্টা করে যে তারা গণতন্ত্রের নীতিসমূহের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত, তখন এটা স্মরণে আনা ভাল যে এই ভদ্রলোকেরাই ক্ষমতায় থাকলে পশ্চিমি গণতন্ত্রের ধারণা অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট অনুযায়ী সিদ্ধান্তগ্রহণের নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখান। বুর্জোয়া গণতন্ত্র তখন পুলিশ-মিলিটারির নৃশংস দমনপীড়নের মধ্য দিয়ে তার প্রকৃত রূপ নিয়ে আমজনতার সামনে আসে। ভারতে এখন সেই অবস্থা চলছে।

Latest article