ঠিক দু’বছর আগের কথা। ২০২১-এর ১৭ থেকে ১৯ ডিসেম্বর হরিদ্বারে আয়োজিত হয়েছিল ‘হিন্দু ধর্মসংসদ’ নামে বিরাট এক আয়োজন। গোটা দেশ থেকে বেশ কয়েকটি প্রধান হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী নেতা ও ধর্মগুরুরা যোগ দিয়েছিলেন এতে। তিনদিনব্যাপী এই ধর্ম মহাসম্মেলনে ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সম্বন্ধে অভূতপূর্ব ঘৃণাভাষণ, সরাসরি সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ ও তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ডাক দেওয়া হয়। উত্তরাখণ্ডের ‘হিন্দু রক্ষা সেনা’র সভাপতি প্রবোধানন্দ গিরি, হিন্দুদের হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান, বলেন গোটা দেশ জুড়ে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ‘সাফাই অভিযান’ চালাতে হবে। ‘নিরঞ্জনী আখড়া’র ‘মহামণ্ডলেশ্বর’ সাধ্বী নিরঞ্জনা নাথুরাম গডসেকে ‘মহাপুরুষ’ আখ্যা দেন। এর আগে জানুয়ারি, ২০১৯-এ ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওয় তাঁকে দেখা গিয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর কুশপুতুলে গুলি ছুঁড়তে।
আরও পড়ুন-নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের জন্মদিবসে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য
যেকোনও ধরনের ভিন্ন মতবাদ বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এহেন ঘৃণা পোষণ সংঘ পরিবারের ডিএনএ-তেই রয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের তাত্ত্বিক গুরু মহাদেব সদাশিব গোলওয়ালকর তাঁর ‘বান্চ অফ থটস’ বইতে ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তরীণ শত্রু চিহ্নিত করেছিলেন তিনটি গোষ্ঠীকে—মুসলিম, খ্রিস্টান ও কমিউনিস্ট পার্টি। ২২ জানুয়ারি ২০২৪, চার প্রধান হিন্দু শঙ্করাচার্যের আপত্তি সত্ত্বেও নিছক ভোটে ফায়দা তোলার জন্য অযোধ্যায় অসমাপ্ত রামমন্দিরের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দিনটি কিন্তু বিশিষ্ট হয়ে আছে আরও একটি কারণে। দু’দশক আগে, ২২ জানুয়ারি, ২০০৩-এ ওড়িশার কেওনঝড় জেলায় দরিদ্র কুষ্ঠরোগীদের মধ্যে সাড়ে তিনদশক ধরে সেবাকার্যে নিয়োজিত অস্ট্রেনিয়ান পাদ্রি গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইনস ও তাঁর দুই শিশুপুত্রকে পুড়িয়ে মারে দারা সিং-এর নেতৃত্বে বজরং দলের ঘাতকরা। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পরে কখনও ভিন্ন ধর্ম, কখনও কলমধারী মাওবাদী, কখনও জল-জমি-জঙ্গল রক্ষায় নিয়োজিত প্রতিবাদী সমাজকর্মী— যেকোনও বিরোধী সংখ্যালঘু মতামতকে বলপূর্বক দাবিয়ে দেবার এক আগ্রাসী অভিযান শুরু হয়েছে। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ-হরিয়ানায় বিরোধী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর-মসজিদ-মাজার গুঁড়িয়ে দিচ্ছে সরকারি বুলডোজার। যোগী আদিত্যনাথের নতুন নাম—‘বুলডোজার বাবা’। আর অসমে একই কাজ করছেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তাঁর নতুন নাম ‘বুলডোজার মামা’। এবং এই ধ্বংসলীলা সেলিব্রেট করছে শাসকদলের সমর্থকরা।
আরও পড়ুন-তিন মুসলিম ব্যক্তিকে বেঁ.ধে প্রকাশ্যে চা.বুক, গুজরাট পুলিশের সমা.লোচনা শীর্ষ আদালতের
যতক্ষণ পর্যন্ত একটি শাসকদল, তার কর্মী ও সমর্থকবাহিনী এহেন ধ্বংসের যজ্ঞে অংশগ্রহণ করে ততক্ষণ অব্দি হিংসার কর্তৃত্ব থাকে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কিছু মানুষের হাতে। কিন্তু যখন এই ঘৃণাকে সর্বজনীন করে তোলা হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় অনবরত ভয়াবহ যান্ত্রিক প্রচার ও পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় গণসংগঠনকে ব্যবহার করে, তখন আর এই ঘৃণার চরিত্র দলীয় পরিচিতিতে আটকে থাকে না। আজকের ভারতবর্ষে আমরা সেই ঘৃণার ‘সর্বজনীনতা’ তৈরির কৌশল দেখছি। একদিকে বিজেপির আইটি সেল ও তাদের হাজারো কর্মী, মূলধারার টিভি চ্যানেলের বিতর্কসভা, ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-ট্যুইটার পোস্ট, হাজার হাজার রিলস তৈরি করে দ্রুত ভাইরাল বানিয়ে দেওয়া— এই সবক’টি উন্নত কারিগরি প্রযুক্তির মাধ্যমে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে মিথ্যা প্রচার, মিথ্যা গালগল্পকে ইতিহাস বলে চালানোর মাধ্যমে। সংখ্যালঘুদের সবচেয়ে বেশি খতরনাক ‘অপর’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে এর বিষময় ফল হাতে-নাতে দেখেছি আমরা।
আরও পড়ুন-রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার পরেরদিন রামভক্তদের ভিড়ে বিশৃঙ্খলা রামমন্দিরে
ধরা যাক, অতি সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও যা শ্যুট করা হয়েছে মোবাইল ক্যামেরায়। শ্যুট করেছেন অতি অনামী কোনও ব্যক্তি, যাঁর পরিচয় কেউ জানে না। মুম্বাইয়ের জুহু বিচে তাঁর ক্যামেরা ঘুরছে। ক্যামেরা জুম করছে বেশ কিছু হিজাব ও বোরখা-পরিহিত মুসলিম মহিলার উপর। ভিডিওটি শুরু হচ্ছে এই নয়া ভারতে ‘কেয়া করেগা মোদি আউর কেয়া করেগা যোগী’ সেই হুঙ্কার দিয়ে। নেপথ্যকণ্ঠ বলে চলেছে, জুহু বিচে যদি এরকম মুখ-ঢাকা সংখ্যালঘু রমণীরা খুলে-আম ঘুরতে পারে, তাহলে জুহু বিচ আর ইসলামিক স্টেটের মধ্যে ফারাক কোথায় তা নাকি বোঝাই যাচ্ছে না! ভিডিও শেষ হচ্ছে এই আশঙ্কা প্রকাশ করে যে, “এখনও যদি আমরা, হিন্দুরা, এই বাড়তে থাকা বিপদের গুরুত্ব না বুঝি, তাহলে পরিণতি ভয়ঙ্কর”!
কোন পরিণতির কথা বলতে চাইছে এই আম-আদমির কণ্ঠস্বর? স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকেই ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। এখানে প্রত্যেকটি ধর্মীয়, ভাষা, এথনিক গোষ্ঠীর স্বাধীনতা সংবিধানসম্মত। সেখানে কোনও সংখ্যালঘুকে সরকারি ক্ষমতার জোরে ভয় দেখানো যায় না, তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়ানো যায় না। আজ যখন উত্তরপ্রদেশের একটি মাধ্যমিক স্কুলে ক্লাসের মধ্যেই শিক্ষিকা একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছাত্রকে দাঁড় করিয়ে হিন্দু ছাত্রদের নির্দেশ দেন তার গালে পরপর এসে থাপ্পড় মারতে এবং সেই ভিডিও ভাইরাল হয়, যখন চলন্ত দূরপাল্লার ট্রেনের ভিতর এক উচ্চবর্ণীয় জওয়ান সামান্য বচসার জেরে চারজন সংখ্যালঘু ব্যক্তিকে গুলি চালিয়ে মেরে ফেলে, তখন বোঝা যায়, ঘৃণা ও হিংসা আজ সমাজে এক সর্বজনীন রূপ পাচ্ছে। একই ঘটনা ঘটেছিল হিটলারের জার্মানিতে, যখন সাধারণ জার্মানদের চোখে ‘গণশত্রু’ বানানো হয়েছিল ইহুদিদের। মোদির ভারত কি সেদিকেই এগোচ্ছে?