অনেক সময়ই দেখা যায় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বহু মানুষই উঠতে, বসতে, হাঁটতে, এছাড়াও শারীরবৃত্তীয় নানান কাজ করতে বেশ ব্যথা অনুভব করেন। বিভিন্ন জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধিগুলোয় চাপ অনুভূত হয়। এই ধরনের ব্যথার সঙ্গে বয়সকালের জয়েন্ট পেইন বা অস্থিসন্ধির ব্যথা, মাসল পেইন বা পেশি দুর্বলতার একটা মিল রয়েছে। কিন্তু সবার বয়সজনিত কারণে এই ব্যথা হয় না। বয়সের কারণে হলে বিশেষ চিন্তার কিছু নেই কিন্তু যদি বয়সের আগেই অর্থাৎ কম বয়সে এই ধরনের ব্যথা হয় তাহলে তা উপেক্ষা করা ঠিক নয়। এর পিছনে থাকতে পারে অন্য কারণও। যেমন মায়োসাইটিস। এই বিরল রোগটির কারণে কোনও ব্যক্তির শরীরে এই ধরনের উপসর্গ দেখা দিতেই পারে। সাবধান হতে হবে কারণ পেশি এবং অস্থিসন্ধির ব্যথা মায়োসাইটিসের জন্যও হতে পারে।
আরও পড়ুন-এগরা পুরসভায় বর্জ্য থেকে জৈবসার, পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রীর প্রকল্প হচ্ছে
কী এই মায়োসাইটিস
মায়োসাইটিস একটি বিরল ধরনের রোগ বা শারীরিক অবস্থা যাতে পেশিতে প্রদাহ হয়। মায়ো মানে পেশি আর আইটিস মানে প্রদাহ। এটি একটি অটোইমিউন ডিজিজ। মায়োসাইটিস ত্বক-সহ শরীরের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। এমনকী অনেক সময় এই রোগের কারণে রোগীর হাঁটা, ওঠা-বসা ইত্যাদি স্বাভাবিক কার্যকলাপ করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সমস্যা বাড়লে মায়োসাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি ঘাড় সোজা রাখতে এবং হালকা জিনিস তুলতেও অসুবিধায় পড়তে পারেন।
প্রথমেই জানা দরকার কাকে বলে ‘অটো ইমিউন’ রোগ। আমাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ করার যে ব্যবস্থা, তাকেই ‘ইমিউনিটি’ বা ‘অনাক্রম্যতা’ বলে। বাইরে থেকে কোনও বিজাতীয় পদার্থ কিংবা জীবাণু দেহে প্রবেশ করলে সেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আক্রমণ করে ওই জীবাণুকে। কখনও কখনও এই প্রক্রিয়াটিতেই গোলমাল দেখা দেয়। নিজের দেহের কোনও অঙ্গকেই দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুল করে শত্রু ভেবে আক্রমণ করে বসে। ফলে বাইরে থেকে আসা কোনও রোগজীবাণু নয়, শরীর নিজেই নিজের ক্ষতি করতে থাকে।
অটো ইমিউন মায়োসাইটিসে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ভুলবশত যেহেতু দেহেরই সুস্থ সবল পেশিকে আক্রমণ করে। ফলে এই বিরল সমস্যায় পেশি দুর্বল হয়ে যায়। এই ধরনের রোগে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিকমতো কাজ করে না।
আরও পড়ুন-জওয়ানদের ফিরিয়ে আনতে মিজোরামে দুর্ঘটনার কবলে মায়ানমারের বিমান
মায়োসাইটিস আসলে একটি একক রোগ নয়, রোগের একটি গ্রুপ যা পেশি থেকে ত্বক পর্যন্ত সবকিছুকে প্রভাবিত করে। প্রথমদিকে হালকা উপসর্গ হলেও তারপর কিন্তু এই রোগ বৃদ্ধি পায় যা দীর্ঘমেয়াদি ভাবে স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলে। যা অনেক সময় একাধিক সমস্যা ও অক্ষমতার কারণও হতে পারে।
বিশেষজ্ঞের মতে, যেহেতু মায়োসাইটিসের ধরন এবং কারণগুলি আলাদা, তাই রোগের লক্ষণ এবং লক্ষণগুলি দেখেও এটি চিকিৎসা করা হয় । বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগ স্থায়ী এবং নিরাময় করা বেশ কঠিন।
উপসর্গ
প্রথম প্রথম দেহের বিভিন্ন অঙ্গে শুরু হয় ব্যথা। হাত, পা, ঘাড়ের পেশিতে যন্ত্রণা হয়। তবে যেকোনও পেশিতেই বাসা বাঁধতে পারে এই রোগ। পেশি এতই দুর্বল হয়ে যায় যে, রোগী মাঝেমধ্যেই পড়ে যেতে পারেন।
জ্বর আসতে পারে মায়োসাইটিস হলে।
ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।
খাবার গিলতে খুব অসুবিধে হয়। রোগী বুঝতে পারেন না কেন এই অসুবিধে।
রোগী বিষণ্ণ বোধ করেন। একটা অবসাদ আসে।
একটানা দাঁড়িয়ে থাকলে কিংবা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে ক্লান্তি লাগে শরীরে। ধরুন, রোগী বেশ কিছুক্ষণ চেয়ারেই বসে আছেন, অথচ উঠতে যেই যাবেন মনে হবে শরীর আর দিচ্ছে না। রোগী প্রচণ্ড পরিমাণে দুর্বলতা অনুভব করেন।
চিকিৎসকের মতে, এই রোগে হাত, কাঁধ, পা, নিতম্ব, পেট এবং মেরুদণ্ডের আশপাশের পেশিগুলি মূলত এতে আক্রান্ত হয়। অসুখটি বাড়তে থাকলে এটি খাদ্যনালি, মধ্যচ্ছদা (ডায়াফ্রাম) এবং চোখের পেশিকে প্রভাবিত করতে পারে। রোগীরা সাধারণত বসার পরে দাঁড়াতে, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে, জিনিস তোলার সময় অসুবিধা অনুভব করেন।
আরও পড়ুন-কর্পূরী ঠাকুরকে মরণোত্তর ভারতরত্ন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক চমক?
কারণ
নানা কারণে এটি হতে পারে, যেমন ভাইরাল সংক্রমণ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং অটোইমিউনের সমস্যার মতো বিষয় থাকতে পারে এর পিছনে।
ভাইরাসজনিত সংক্রমণ থেকে হয়।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস দীর্ঘদিন থাকলে তার থেকেও হতে পারে।
একটি ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে হয়।
লুপাস (গুরুতর প্রদাহজনক অটোইমিউন রোগ) থেকে হতে পারে।
স্ক্লেরোডার্মা একটি অটোইমিউন ডিজিজ। এই রোগের প্রভাবেও হতে পারে মায়োসাইটিস।
মায়োসাইটিস বিভিন্ন ধরনের হয়। যদিও সমস্ত উপসর্গগুলি খুব একই রকম, তবে শরীরে তাদের প্রভাব ভিন্নভাবে দেখা যায়।
ডার্মাটো মায়োসাইটিস
এতে আক্রান্ত হলে পেশিতে ব্যথা হয়। পেশি ফুলে যায়। বুক, ঘাড়, পিঠ, হাঁটু, পায়ের জয়েন্ট এবং আঙুলে, কখনও কখনও চোখের পাতায়ও ফুসকুড়ি দেখা যায়। এছাড়াও এই সমস্যার কারণে রোগীকে জ্বর, ক্লান্তি, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা, কণ্ঠস্বর পরিবর্তন এবং খাবার গিলতে সমস্যার মতো সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে।
পলিমায়োসাইটিস
পলিমায়োসাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে খুব দুর্বলতা থাকে, ব্যথা, জ্বালাপোড়া এবং ফোলার সমস্যা দেখা যায়। এছাড়া জ্বর, ক্লান্তি, শুকনো কাশি, কোনও কিছু গিলতে অসুবিধা, ওজন কমে যাওয়া এবং কণ্ঠস্বর পরিবর্তন-সহ নানা সমস্যা হতে পারে। সাধারণত মহিলাদের মধ্যে এই সমস্যা তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়।
ইনক্লুশন বডি মায়োসাইটিস
এই সমস্যাটি পুরুষদের তুলনামূলকভাবে বেশি প্রভাবিত করে। এতে কবজি, আঙুল ও উরুর মাংসপেশির দুর্বলতার লক্ষণ দেখা যায়। সমস্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পেশিতে ব্যথা বা দুর্বলতা এতটাই বাড়তে পারে যে রোগী শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে, হাঁটাচলা করতে, মাটি থেকে কিছু তুলতে, জিনিসপত্র ধরে রাখতেও সমস্যা হয়। অনেক সময় সে পড়েও যায়।
ক্লিনিক্যাল টেস্ট, ব্লাড টেস্ট, এমআর ইমেজিং, ইএমজি এবং পেশি বায়োপসি করার পরে এই রোগটি নির্ণয় করা হয়। নির্দিষ্ট স্টেরয়েড এবং ইমিউনো সাপ্রেসিভ ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মায়োসাইটিস সম্পূর্ণ সারে না বা নিরাময় সম্ভব হয় না। কিন্তু সঠিক চিকিৎসা, ওষুধ, নিয়মিত পরিচর্যা ও সতর্কতা অবলম্বন করলে এই রোগ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রোগী কতটা সাড়া দিচ্ছে পুরোটাই তার ওপর নির্ভর। কিন্তু উপসর্গকে উপেক্ষা করলে এই রোগে স্থায়ীভাবে শারীরিক অক্ষমতা চলে আসতে পারে, যেমন হাঁটাচলা, কাজ করতে না পারা বা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া।