সাধারণতন্ত্র দিবস (Republic Day) হিসেবে ২৬ জানুয়ারি দিনটির উদযাপন পরম্পরার শিকড় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নিহিত। ১৯২৯ পর্যন্ত গান্ধীজি-সহ কংগ্রেসের তাবড় নেতারা ব্রিটিশদের কাছ থেকে পূর্ণ স্বরাজ দাবি করা হবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ান্বিত ছিলেন। মতিলাল নেহরু এবং কংগ্রেসের প্রবীণ নেতৃবর্গ ধাপে ধাপে এগনোর পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’ যাতে ভারত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটা আলগা অংশ হিসেবে থেকে যায় অথচ যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা ভোগ করতে পারে। কংগ্রেসে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা যাঁরা তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসু। এঁরা কিন্তু মতিলালের ভাবনার সঙ্গে সহমত পোষণ করলেন না। উল্টে তাঁরা ব্রিটিশ শাসন থেকে পূর্ণ স্বরাজ চাইলেন।
১৯২৭-এ ব্রিটিশ সরকার জন সাইমনের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করল। উদ্দেশ্য, ভারতে সাংবিধানিক পরিবর্তনের বিষয়ে পরামর্শ দেবে সেই কমিশন। সেই কমিশনকে বয়কট করল কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ। কারণ কমিশনের সব সদ্যস্যই ইউরোপীয়। কমিশনে কোনও ভারতীয় প্রতিনিধি নেই। ১৯২৮-এ সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু হল। লাহোরে এরকম একটি বিক্ষোভ আন্দোলনের সময় পুলিশের প্রচণ্ড প্রহারে মারা গেলেন লালা লাজপত রায়। ব্রিটিশরা ভারতীয় সংবিধান সংক্রান্ত কোনও প্রতিবেদন ভারতীয়দের পেশ করতে দেবে না আর ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে তৈরি। এরই ফলশ্রুতি হল নেহরু রিপোর্ট। সেটি তৈরি হয়েছিল মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে আর তাতে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের দাবি করা হয়েছিল। জওহরলাল ওই রিপোর্ট তৈরির কমিটিতে সেক্রেটারি ছিলেন। তিনিও কিন্তু ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস লাভের পক্ষপাতী ছিলেন না। ১৯২৭-এ কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে জওহরলাল শিবির পূর্ণ স্বরাজের দাবি যাতে কংগ্রেস তোলে সে-চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। ১৯২৮-এর কলকাতা অধিবেশনে জওহরলাল এ ব্যাপারে কংগ্রেসকে রাজি করাবার বহু চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু গান্ধীজি রাজি হলেন না। পক্ষান্তরে, ভাইসরয় যখন গান্ধীজির মধ্যপন্থা মানতে চাইলেন না, উলটে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন, ভারতীয়দের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিল। সেই অসন্তোষের অভিমুখ পূর্ণ স্বরাজের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন মহাত্মা গান্ধী।
আরও পড়ুন-১৫৬৭ ক্রীড়াবিদ পাবেন প্রতি মাসে ভাতা, খেলোয়াড়দের চাকরির জন্য মুখ্যমন্ত্রীর স্পোর্টস ডেস্ক
এভাবে কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে সভাপতির পদে এলেন অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সি জওহরলাল নেহরু। ১৯২৯-এর ডিসেম্বর মাসে লাহোর অধিবেশনে জওহরলাল পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব পাশ করাতে সমর্থ হলেন। ৩১ ডিসেম্বর লাহোরে ইরাবতী নদীর তীরে জওহরলাল নেহরু স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করলেন। তখনই কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে ২৬ জানুয়ারি (Republic Day) স্বাধীনতা দিবস পালনের আবেদন জানানো হল। ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি স্বাধীন ভারতের সংবিধান কার্যকর হল। ১৯২৯-এর পূর্ণস্বরাজের দাবি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি উজ্জ্বল পর্ব সূচিত করে। ২৬ জানুয়ারি (Republic Day), ১৯৩০ থেকে ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০ পর্যন্ত কালপর্ব তিতিক্ষা আর সংগ্রামের লম্বা ইতিহাস। এই পর্বে হাজার হাজার লোক কারারুদ্ধ হয়েছেন, শয়ে শয়ে লোক শহিদ হয়েছেন। ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি দিনটিকে সাধারণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এই দশকগুলোতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং হিন্দু মহাসভা বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকা পালন করে। তারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি এবং প্রায়শই ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করে। যেমন, ২৬ জুলাই, ১৯৪২-এ বাংলার উপ মুখ্যমন্ত্রী তথা হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলার বড়লাট জন হারবার্টকে লিখলেন, কংগ্রেসের আগামী ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে দমন করতে হবে। জাতীয় আন্দোলনকে ধিক্কার জানিয়ে তিনি লিখলেন, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যদি কেউ জনচেতনাকে আন্দোলিত করার পরিকল্পনা করে আর তার ফলে যদি অভ্যন্তরীণ অশান্তি কিংবা নিরাপত্তাহীনতার উদ্ভব হয় তবে সরকারের সেটিকে প্রতিহত করা উচিত। শ্যামাপ্রসাদ বড়লাটকে আরও লেখেন, ‘আমি আপনাকে পুরো মাত্রায় সাহায্য করতে ইচ্ছুক।’ এই নির্লজ্জ পরম্পরার সূচনা তখন থেকে যখন তাঁদের নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভারতবিরোধী কাজে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
শেষ পর্যন্ত দেশ যখন স্বাধীনতা অর্জনে সমর্থ হল তখন আরএসএস আর হিন্দু মহাসভা গান্ধীজিকে দেশভাগের জন্য দায়ী করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। আর তাদের সমর্থক গান্ধীজিকে হত্যা করল। আরএসএসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। ১৮ মাসের জন্য ওই সংগঠন বেআইনি বলে ঘোষিত হল। তাদের নেতাদের ধরপাকড় শুরু হল। জুলাই, ১৯৪৯-এ যখন তাদের কারামুক্তি ঘটল তখন আরএসএসকে মনে হল যেন ধোয়া তুলসী পাতা। দু’বছর পর তাদের ডাকে সাড়া দিয়েই বিশ্বাসঘাতক শ্যামাপ্রসাদ নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। নাম হল ‘জনসংঘ’। সেই দলই পরবর্তীকালে ভারতীয় জনতা পার্টি হয়েছে। তাই, ২৬ জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র দিবস পালনের পাশাপাশি যে গেরুয়াপন্থীরা আজ দেশ শাসন করছেন তাঁদের লজ্জাজনক ইতিহাসটাও স্মরণ করা উচিত।