২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৩। আসন্ন ৫ মার্চ, জার্মানির নির্ণায়ক নির্বাচনের ঠিক দু’সপ্তাহ আগে, হিটলারের অন্যতম সহযোগী, রাইখস্ট্যাগের প্রেসিডেন্ট হেরম্যান গোয়েরিং-এর বার্লিনের বাসভবনে দেশের সবচেয়ে ধনী ২৪ জন শিল্পপতিকে ডেকে পাঠানো হয়। এই শিল্পপতিদের সামনে দাঁড়িয়ে স্বয়ং হিটলার একটি ৯০ মিনিটের ভাষণ দেন। হিটলার বোঝান, দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য সমস্ত বিরোধী দলগুলোকে নিকেশ করে একচ্ছত্র ক্ষমতা দখলের প্রয়োজন কেবল জার্মান জাতির স্বার্থেই নয়, শিল্পপতিদের নিরঙ্কুশ মুনাফা লাভের জন্যও জরুরি বটে। তৎকালীন জার্মানির স্টিল টাইকুন, বণিক সংঘের চেয়ারম্যান গুস্তাফ ক্রুপ উঠে দাঁড়িয়ে হিটলারকে পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দেন। এই বক্তৃতার পরেই হিটলার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান।
আরও পড়ুন-হাতছানি দেয় আলিবাগ
এরপর অর্থনীতিবিদ জামলার স্কাক্ট নাৎসি কোয়ালিশনের সমর্থনে একটি ফান্ড গঠনের আহ্বান জানান শিল্পপতিদের কাছে। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২০ মিলিয়ন ডলারের (বর্তমান মূল্যে) একটি নির্বাচনী ফান্ড তৈরি হয়। সেই ফান্ড হিটলারকে ভোটে জিততে বিপুল সাহায্য করেছিল। এই বৈঠকের ঠিক পরদিন, নাৎসি পার্টির প্রচার-অধিকর্তা গোয়েবলস তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, কীভাবে তাঁরা জার্মান বৃহৎ শিল্পপতিদের আর্থিক সহায়তায়, নিজেদের পার্টির হয়ে অবিরাম মিথ্যা প্রচারের যন্ত্রটিকে এইবার সচল করে তুলবেন। এভাবেই জার্মান শিল্পপতিদের একাংশ নাৎসি রাষ্ট্র গঠনে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছিলেন। পরবর্তী ইতিহাস সকলেরই জানা। চূড়ান্ত স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় আধিপত্য, ইহুদিদের নাগরিক অধিকার হরণ ও ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করে নাৎসি-রাজ এক সন্ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তোলে। সমস্ত বিরোধী দল, ট্রেড ইউনিয়নকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। মানব-ইতিহাসের চরম অন্ধকার দিন ঘনিয়ে আসে।
আরও পড়ুন-ফের রক্তাক্ত হল বিজেপি শাসিত মণিপুর, হত ২, উত্তেজনা চরমে
প্রায় একই ঘটনা ঘটছে ভারতে। ২০১৪-র সাধারণ নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদিকে বিজেপির মুখ হিসেবে তুলে ধরার জন্য ভারতীয় কর্পোরেটদের একাংশ বিপুল টাকা বিনিয়োগ করেছিল। এক আগ্রাসী প্রচার চালানো হয়েছিল পূর্ববর্তী সরকারের বিরুদ্ধে। বছরে দু’কোটি বেকারের চাকরির ব্যবস্থা এবং বিদেশের ব্যাঙ্কে লুকিয়ে রাখা কালো টাকা ফেরত এনে প্রত্যেক ভারতীয়ের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার আকাশকুসুম প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসে। এই অবাস্তব স্বপ্ন মানুষের মনে গেঁথে দেওয়ার জন্য কর্পোরেট-পোষিত সংবাদমাধ্যমের একাংশকে ব্যবহার করা হয়। বিগত পাঁচ বছরের শাসনকালে এই মোদি-সমর্থক কর্পোরেট-মিডিয়া লাগাতার প্রচার চালিয়ে গিয়েছে, মোদিজির শাসনকালে বিভিন্ন দিক থেকে ভারত নাকি এক অভূতপূর্ব বিকাশের মুখ দেখেছে। মোদিই ‘বিশ্বগুরু’। যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ১০ বছরের রাজত্বকালে ৭৩ বার বিদেশভ্রমণে জাতীয় কোষাগারের কোটি কোটি টাকা খরচ করেছেন, কোনওরকম যুক্তি-তথ্যের ধার না ধরে কেবল মিথ্যা উন্মাদনা তৈরির মাধ্যমে তাঁকেই ভারতের একমাত্র পরিত্রাতা হিসেবে তুলে ধরছে একাংশের বৃহৎ মিডিয়া। কিন্তু বাস্তব সত্যটা ঠিক কী?
আরও পড়ুন-বিতর্ক উসকে জ্ঞানবাপী মসজিদের বেসমেন্টে পুজোর অনুমতি দিল কোর্ট
কর্পোরেট-লবির একাংশ যে মোদি সরকারকে খুলে আম সমর্থন দিচ্ছে, তা নিশ্চয়ই বিনা কারণে নয়। বিগত দশ বছরব্যাপী মোদি সরকার মূলত কাজ করেছে তাঁদের এই ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট-লবি ও অতি-ধনী অংশের সমর্থনে। মোদি সরকারের দশ বছরে যেখানে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা ৫০% মানুষের হাতে এসেছে জাতীয় সম্পদের ৩%, সেখানে উপরের দিকে থাকা ১০% মানুষের হাতে এই সম্পদের পরিমাণ ৬৬%। মোদির আমলে দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য রেকর্ড মাত্রা ছুঁয়েছে। গত দশ বছরে বিজেপি-ঘনিষ্ঠ কর্পোরেটদের ঋণ মকুব করা হয়েছে প্রায় ২৫ লক্ষ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয়-বৃদ্ধির নিরিখে গত দশ বছরে ভারতের স্থান এতটাই নীচে নেমে গিয়েছে যে, এইমুহূর্তে আমাদের মাথাপিছু আয় পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশেরও নীচে, যে বাংলাদেশকে এই সেদিনও পশ্চাৎপদ দেশ হিসেবে গণ্য করা হত।
আরও পড়ুন-বঞ্চনার জবাব নেই, অসম্পূর্ণ রিপোর্ট নিয়ে নাটক বিজেপির
মোট ১৮০টি দেশের মধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবোন্নয়ন ও সামাজিক সূচকের নিরিখেও বিগত দশ বছরে ভারতের স্থান ক্রমশ তলানিতে ঠেকেছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান এইমুহূর্তে ১১১তম। মানবোন্নয়ন সূচকে ১৩২তম। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ১৬১তম। অথচ অতি ধনীদের সংখ্যার দিক থেকে এইমুহূর্তে ভারতের স্থান উঠে এসেছে তৃতীয় স্থানে। নব্বই দশকের গোড়ায় মুক্ত অর্থনীতি চালু হওয়ার এক দশকের মধ্যেই বোঝা যাচ্ছিল এই বিশ্বায়ন আসলে আরও বেশি করে পুঁজির বিশ্বায়ন ঘটাবে। কিন্তু এই পুঁজি প্রতিযোগিতামূলক পুঁজি নয়। সমাজতাত্ত্বিকদের ভাষায় এ হল ‘ক্রোনি পুঁজি’ বা ‘তোষামুদে পুঁজি’। এই পুঁজি কর্মসংস্থান বা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটায় না। বরং ক্ষমতাসীন দলকে চূড়ান্ত সমর্থন দিয়ে এই পুঁজি নিজের বল্গাহীন মুনাফা বৃদ্ধি ঘটায়। অর্থাৎ এর চরিত্র চরম অগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যবাদী। এই পুঁজির বিকাশে দেশের সাধারণ মানুষের কোনও ভাগ থাকে না। বরং ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা, স্বল্প সঞ্চয় ইত্যাদি যেসব ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অর্থ সুরক্ষিত থাকত এতদিন, সেই ক্ষেত্রগুলো থেকে সম্পদ নিষ্কাশন করে এই মুষ্টিমেয় কর্পোরেটদের চরম মুনাফা লাভের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। মোদির আমলে এই লুটেরা-কর্পোরেটদেরই পৌষ মাস, আমজনতার সর্বনাশ ঘটছে।