বিদ্যা ও শিল্পকলার দেবী সরস্বতী। সৃষ্টি এবং সৌন্দর্যের সাধক মাত্রই চন্দ্রবদনীর ভক্ত। স্কুল জীবনে প্রায় প্রত্যেকেই এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছেন। বড় হওয়ার পরেও অনেকেই বাগদেবীর বন্দনা করেন। বাড়িতে অথবা কোনও প্রতিষ্ঠানে। দেবীর কাছে রাখেন জ্ঞানের প্রার্থনা। ভক্তিভরে চেয়ে নেন আশীর্বাদ। সরস্বতী হিন্দু ধর্মের দেবী। তবে অন্য ধর্মাবলম্বীরাও এই দেবীর পুজোয় শামিল হন। কেউ কেউ পুজোর আয়োজন পর্যন্ত করেন। সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন উস্তাদ রাশিদ খান। তিনি প্রতিবছর বাড়িতে সরস্বতীর আরাধনা করতেন। রাখতেন সংগীতের উপাচার। উদাহরণ দেওয়া যায় আরও। আসলে সরস্বতীবন্দনা পেরিয়ে গেছে ধর্মীয় সীমারেখা। হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। বীণাপাণির আরাধনা করেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টরা। কীভাবে আরাধনা করেন তাঁরা, জেনে নেওয়া যাক।
আরও পড়ুন-অভিষেকের অভিযোগ গ্রহণ শীর্ষ আদালতের
গান হল সরস্বতীর আশীর্বাদ
পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী
সরস্বতী বিদ্যার দেবী। সঙ্গীতের দেবী। আমি গত ২৬ বছর ধরে আমার সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান শ্রুতিনন্দনে তাঁর আরাধনা করছি। এই বছরও তার ব্যতিক্রম হবে না। জোরকদমে চলছে প্রস্তুতি। আমার সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছাত্রছাত্রী আছেন। তাঁরা সবাই সরস্বতীর আরাধনা করেন। ধর্মীয়ভাবে পুজো হয়। কখনও আমি পৌরোহিত্য করি, কখনও ছাত্রেরা। সবাই মিলে অঞ্জলি দিই। যা যা করার সবই করি। সেই সঙ্গে পুজোর সময় আমরা পরিবেশন করি গান। অন্য ধর্মের ছাত্র-ছাত্রীরাও মন্ত্রপাঠ করেন, গান করেন। সমবেতভাবে দেওয়া হয় সুরের অঞ্জলি। সরস্বতীর আটটি গান আছে। মূলত সেইগুলোই গীত হয়। কিছু নিমন্ত্রণ আসে। তবে পুজোর দিন সচরাচর বাইরে কোথাও যাই না। ছাত্র-ছাত্রী, পরিবার-পরিজনদের সঙ্গেই সময় কাটাই। আমি মনে করি, গান হল সরস্বতীর আশীর্বাদ। সেই আশীর্বাদ দেবীর কাছে প্রার্থনা করি।
প্রতিদিনই আমার সরস্বতী আরাধনা
আবুল বাশার
আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা মুর্শিদাবাদ জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে। যে স্কুলে পড়তাম, সেটা মুসলিম প্রধান। তবে হিন্দু-মুসলমান সবাই একসঙ্গে পড়াশোনা করত। সব থেকে বড় কথা, সেই স্কুলে সরস্বতী পুজো হত। এখন যেভাবে অনেক জায়গায় দুর্গাপুজোয় মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা অংশগ্রহণ করে, ঠিক সেইভাবেই আমাদের স্কুলে মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীরা সরস্বতী পুজোয় অংশ নিত। আমিও অংশ নিতাম। অঞ্জলি দিতাম, প্রসাদ খেতাম। আসলে মুর্শিদাবাদ নবাবদের জায়গা। সমন্বয়ের জায়গা। তাই হিন্দু-মুসলমান কোনও পার্থক্য দেখতে পেতাম না। হিন্দুদের পাশাপাশি ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও মনে করতেন বিদ্যা অর্জন করতে হলে, গান গাইতে হলে দেবী সরস্বতীর আরাধনা করতে হবে। পুজোর অর্থ হচ্ছে স্মরণ করা। তাই আমরা বিদ্যাদেবীকে স্মরণ করি। স্মরণ না করলে দেবী সন্তুষ্ট হবেন কি? হবেন না। এখনও বহু মুসলমান সরস্বতী পুজোর অংশ নেন। এটায় বাধা না দিলে একটা সময় হিন্দু-মুসলমান মিশে যাবে। তবে এটাও ঠিক, বাধা দেওয়া হচ্ছে। বাধা দিচ্ছে রাষ্ট্র। না হলে আমরা কবেই মিলিত হয়ে যেতাম। আজও আমি ইসলামকে মেনেই সূর্যপ্রণাম করি, দেবী সরস্বতীর আরাধনা করি। তবে মূর্তিপুজো করি না। যদিও বাড়িতে রেখেছি স্বামী বিবেকানন্দের ছবি। উপনিষদ অন্নকে ঈশ্বর বলেছে। সেই অন্ন আমি অক্ষর থেকে পাই। অক্ষর লিখে পাই। অক্ষর মানে সরস্বতী। বলা যায়, প্রতিদিনই আমার সরস্বতী আরাধনা। খুব কম বয়স থেকেই সাহিত্যচর্চা করছি। মৈত্রেয়ী দেবীর ‘নবজাতক’ পত্রিকায় লিখেছি ছাত্রজীবনে। তার জন্য পেয়েছি শিক্ষকমশাইদের প্রশ্রয়, স্নেহ। সেইসময় এক বান্ধবী আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি সরস্বতীর বরপুত্র।’ কথাটা আমি ভুলতে পারিনি। আমি আজও নিজেকে দেবী সরস্বতীর সন্তান মনে করি।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেতাম না
ইন্দ্রাণী হালদার
আমার কাছে সরস্বতী পুজো মানে প্রথম শাড়ি পরার দিন। ছোটবেলায় লাল রঙের একটা ব্লাউজ ছিল। তার সঙ্গে পরতাম মায়ের হলুদ রঙের শাড়ি। স্কুলে যেতাম। আনন্দ করতাম সারা দিন। বাড়িতেও পুজো হত। পুজোর সময় কুলের থালার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ভাবতাম, অঞ্জলি দেওয়া শেষ হলেই কুল খাব! কারণ সরস্বতী পুজোর আগে আমরা কেউ কুল খেতাম না। অঙ্কে যদি গোল্লা পাই! একটু বড় হওয়ার পর সরস্বতী পুজোর দিন বন্ধুদের সঙ্গে বেরতাম। বাড়ি থেকে এই ছাড়টুকু পাওয়া যেত। বিকেলের দিকে এদিক-ওদিক ঘুরতাম। ঠাকুর দেখতাম। আনন্দ করতাম। ছোট থেকেই জেনেছিলাম, এই দেবীকে তুষ্ট রাখতে পারলে পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করা যাবে। তাই সরস্বতীকে ভক্তি করতাম খুব। আজও করি। আমাদের ছোটবেলায় সরস্বতী পুজো অন্যরকম ছিল। বাড়িতে বাড়িতে পুজো হত। এখন তো সব বাড়িতে পুজোই হয় না। তবে আমাদের বাড়িতে নিষ্ঠার সঙ্গে সরস্বতী পুজো হয়। আমার মা পুজোর আয়োজন করেন। আমরা সঙ্গে থাকি। ঠাকুর সাজাই। আলপনা দিই। পুজোর সময় অঞ্জলি দিই। আমাদের পাড়ার ক্লাবেও সরস্বতী পুজো হয়। বাড়ি এবং পাড়া নিয়ে পুজোর দিনটা হইহই করে কেটে যায়। ক্লাবের পুজোয় হয় খাওয়াদাওয়া। আয়োজিত হয় নাচ-গানের অনুষ্ঠান। এই দিন ছুটি নেওয়ার চেষ্টা করি। তবে মেগা সিরিয়ালের চাপ থাকলে পুজো সেরে দুপুরের দিকে শ্যুটিংয়ে যাই। দিন বদলেছে। তবে সরস্বতী পুজোর আবেগ, আনন্দ আমার কাছে একই রকমের থেকে গেছে।
আরও পড়ুন-মা-বোনেদের হাত শক্ত করার বাজেট
সরস্বতীকে নিয়ে আমি গান বেঁধেছি
নাজমুল হক
সরস্বতী বিদ্যার দেবী। তাঁর আরাধনা শিক্ষা জগতে হয়, শিল্প জগতে হয়। যে কোনও শিক্ষিত সৃষ্টিশীল মানুষ, সুরের জগতের মানুষই সরস্বতী পুজো করেন। আমরা যাঁরা সঙ্গীত চর্চা করি, প্রায় প্রত্যেকেই সরস্বতীর আরাধনা করি। এই পুজোর সঙ্গে প্রত্যেকের শৈশব এবং কৈশোর জড়িয়ে থাকে। আমি যে স্কুলে পড়তাম, সেই স্কুলের সরস্বতী পুজো হত। এখনও হয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মেতে উঠতাম। স্কুলে অঞ্জলি দিয়েছি। প্রসাদ খেয়েছি। সরস্বতী পুজোর সময় দু-দিন পড়ার ছুটি পেতাম। কারণ বইপত্র থাকত ঠাকুরের কাছে। কী যে আনন্দ হত, বলে বোঝাতে পারব না। তখন এত হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ছিল না। আমার বেশিরভাগ বন্ধুই হিন্দু। সরস্বতী পুজোর কিছু দিন আগে থেকেই চলত প্রস্তুতি। এটা যে অন্য ধর্মের পুজো, কখনও মনে হত না। ধর্মের বিভাজনটা এখন বড় বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। সরস্বতীকে নিয়ে গানও বেঁধেছি। পুজোর দিন যখন যেখানে শো থাকে আমি গাই। গানটা হল ‘মা তুই কবে আসবি বল/ আমার মন বড় চঞ্চল।’ আমার গানের দল উজানিয়া এবং পরিবার নিয়ে আমি ২৪ বছর ধরে বাড়িতে সরস্বতী পুজো করছি। এবারও হবে। আগে থাকতাম বাঘাযতীনে। সেখানে হত। কিছুদিন আগে চলে এসেছি বরানগরে। এবার থেকে হবে এখানে। আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে স্থানীয় চার-পাঁচটি পরিবার। জোরকদমে প্রস্তুতি চলছে। আজও পুজোর দিন উপোস থাকি। অঞ্জলি দেওয়ার পরে প্রসাদ খাই। ছোটবেলা থেকে এইভাবেই আমি অভ্যস্ত।