শিক্ষাই হল মানুষের মেরুদণ্ড। সমাজকে শিক্ষিত করার জন্য স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘আগে মা শিক্ষিত হলে পরে তার সন্তান শিক্ষিত হবে।’ তাই স্বামীজি মনে করতেন, বর্তমান সমাজকে সুশিক্ষিত করতে দরকার ‘নারীশিক্ষা’। নারী অনন্ত শক্তির আধার।
আরও পড়ুন-আজ শুরু কুম্ভমেলা মঙ্গলে শাহি স্নান
নারী অর্থাৎ ‘মা’ শব্দে মন শুদ্ধ হয়। নারীশক্তি বিনা জগতের কল্যাণ, জগতের উদ্ধার কখনও সম্ভব নয়! একটা সমাজকে বদলাতে পারেন একজন মা। আর একটি পরিবারকে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন মা। আজ যে মেয়েরা স্কুলে পড়াশুনা করছে তারাই আগামী দিনে ‘মা’। তাই এই ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প একটা পরিবার, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অসাধারণ এবং অভাবনীয় প্রকল্প। উন্নয়নের মডেলকে সামনে রেখে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে চালু করেছেন একের পর এক প্রকল্প। বিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নকে পাখির চোখ করে বাড়িয়েছেন বাজেটের বরাদ্দ। ২০১০-১১ সালে বিদ্যালয় শিক্ষায় বাজেট ছিল ৪২৯ কোটি, ২০২৩-২৪ সালে সেই বাজেট ৯,৯২৪ কোটি। ১৩ বছরে ১২ গুণ বাজেট বৃদ্ধি বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা প্রমাণ করে। পশ্চিমবঙ্গ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অংশ। গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্যই হল প্রজাকল্যাণসাধন। প্রজাকল্যাণের মধ্যে দিয়ে সমাজকল্যাণের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ২০১৩ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবর্তিত করেন তাঁর স্বপ্নের ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল— To reduce dropout rate and prevent early marriage. অর্থাৎ দ্রুত ড্রপআউটের সংখ্যা কমানো, নাবালিকাদের বিয়ের প্রবণতা কমানো এবং নারীপাচার রোধ।
আরও পড়ুন-হস্তশিল্পী ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির আয় বাড়াতে উদ্যোগ রাজ্যের, জেলায় জেলায় এবার গ্রামীণ মেলা
কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু হওয়ার পর স্কুল ড্রপআউটের সংখ্যা আশানুরূপ ভাবেই কমগেছে। নাবালিকাদের বিয়ের প্রবণতাও কমেছে। এ-ছাড়াও স্কুলে স্কুলে তৈরি হয়েছে কন্যাশ্রী ক্লাব। আঠারো বছরের নিচে অর্থাৎ নাবালিকা সহপাঠীদের বিয়ে রুখতে প্রশাসনকে নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রচেষ্টা। পাশাপাশি এই অল্প বয়সে বিয়ে না হওয়ায় এবং আগের মতো অভাবের তাড়নায় অনেকে শিশুশ্রমিক না হয়ে পড়াশুনা করছে। সেক্ষেত্রে নারীপাচার রোধে কন্যাশ্রী দারুণভাবে সফল। ২০১৩-১৪ সালে K1 ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পে সুবিধা পেয়েছিল ১৮,৪৪,৬২২ জন এবং ২০২২-২৩-এ তা বেড়ে ২৩,০০,০০০ জন এবং ২০১৩-১৪ সালে K2-তে আবেদন করেছিল ১,৩৮,২৬২ জন ছাত্রী এবং ২০২২-২৩-এ তা ৫,৩৪,০০০ জনে। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে K2-এর জন্য ৫ লক্ষ ৩৪ হাজার ছাত্রী ২৫,০০০ টাকা করে পেয়েছে।
আরও পড়ুন-মুর্শিদাবাদ থেকে বাংলাদেশের জলপথে সরাসরি বাণিজ্য
K3 ‘কন্যাশ্রী-3’ প্রকল্পে মাস্টার ডিগ্রি পর্যন্ত সমস্ত ছাত্রী ৪৫%-এর বেশি নম্বর পেলে আবেদন করতে পারবে। এক্ষেত্রে পারিবারিক আয়ের কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী হলে মাসে ২৫০০/- টাকা এবং কলা ও বাণিজ্য বিভাগের ছাত্রী হলে মাসে ২০০০/- টাকা করে পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য পায়। এখনও পর্যন্ত ১,১৯,০০৬ জন ছাত্রী কন্যাশ্রী-৩ প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছে। বিয়ে না হলে আঠারো বছর বয়সের পর ‘কন্যাশ্রী’ ২৫,০০০ এবং ‘রূপশ্রী’ ২৫,০০০ মোট ৫০,০০০ টাকা পাবে। আর আঠারো বছরের আগে অর্থাৎ নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে করলে শুধু ‘কন্যাশ্রী-১’ পাবে কিন্তু ‘কন্যাশ্রী-২’ এবং ‘রূপশ্রী’ প্রকল্পের এই ৫০,০০০ টাকা পাবে না।
আরও পড়ুন-ফাইনালে সেই হার ভারতের
মিড-ডে মিল হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পুষ্টি প্রোগ্রাম। বর্তমানে ২৬,৩৩৩টি বিদ্যালয়ে কিচেন গার্ডেন রয়েছে। ২০১১ সালে মিড-ডে মিলে খরচ হত ৩০৩ কোটি আর বর্তমানে তা ৯৯০ কোটি ছাড়িয়েছে। ১.১৮ কোটি ছাত্রছাত্রী এই পুষ্টি প্রোগ্রামের সুফল পাচ্ছে। ২৫.৮৩ কোটি টাকা খরচ করে ৫৭,৯৯৬ বিদ্যালয়ে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র বসানোর ব্যবস্থা হয়েছে। রাজ্য সরকার মিড-ডে মিল কর্মীদের অতিরিক্ত ৫০০ টাকা করে দিচ্ছে। এলপিজি গ্যাসের মাধ্যমে ১০০% বিদ্যালয়ে রান্নার ব্যবস্থা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার্থে ১৬,৬১৩টি বিদ্যালয়ে ডাইনিং হল নির্মাণ করা হয়েছে। ৮২,০১৫ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী মিড-ডে মিলের খাবার পাচ্ছে। ১,১৭,৩৬,৩৩৫ জন ছাত্রছাত্রী প্রতিদিন বিদ্যালয়ে রান্না-করা খাবার খায়।
কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য বলছে পশ্চিমবঙ্গ ৯৯%, উত্তরপ্রদেশ ৮২%, রাজস্থান ৮৩%, মণিপুরে ৬৩% মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় কলকাতার বিশ্ববাণিজ্য সম্মেলনে এ-বছরই প্রথম ছিল এডুকেশন কনক্লেভ। শিক্ষামন্ত্রীর হাত ধরেই আন্তর্জাতিক মানের সাথে পাল্লা দিচ্ছে আমাদের রাজ্য বাংলা এবং বুনিয়াদি শিক্ষায় সারা ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ দেশের সেরা। শুধুমাত্র সিলেবাস পরিবর্তন এবং আধুনিকীকরণ নয়, বিদ্যালয়ে নিরাপত্তা ও সাবধানতা বিষয়েও নজর দিচ্ছে শিক্ষাদপ্তর। গ্রামের যেখানে দূর-দূরান্ত পথ পেরিয়ে মাধ্যমিক স্কুলগুলি যেতে হয় সেখানে সমস্ত অভিভাবকের পক্ষে সাইকেল কিনে দেওয়া সম্ভবপর হত না। মূল্যবান সময় যাতায়াতের পথে যাতে সময় নষ্ট না হয় সেই উদ্দেশ্যে রাজ্যের সমস্ত বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ‘সবুজসাথী’ প্রকল্পের মাধ্যমে বিনামূল্যে সাইকেল দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার। ১ কোটি ১৫ লক্ষ ছাত্রছাত্রীকে সাইকেল দেওয়ার ফলে বিদ্যালয়ে যাতায়াতের সুবিধা হয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তিগত কাজেও সাইকেল ব্যবহার করে সময় অপচয় রোধ করতে সচেষ্ট হচ্ছে। কোভিড-১৯-এর সময় যখন বিশ্ব অবরুদ্ধ তথা অচলাবস্থায় তখন বিদ্যালয়গুলো বন্ধ রাখতে বাধ্য। সেইসময় বিদ্যালয়কে ড্রইংরুমে পৌঁছে দিতে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন প্রকল্প ‘তরুণের স্বপ্ন’। সমস্ত অভিভাবকের পক্ষে যা ছিল প্রায় অসম্ভব এবং অসহায়তার এই প্রকল্পের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়িয়ে সময়ের প্রয়োজনে টেকস্যাভি করতে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ট্যাব অথবা অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন কেনার জন্য ১০,০০০ টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ২৭ লক্ষ ছাত্রছাত্রী সরাসরি উপকৃত হয়েছে।
(পরবর্তী পর্ব আগামিকাল)