১৯০৫ সাল। সে-সময় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন কার্যকর রূপ ধারণ করেছিল। সেই সময় বাংলাদেশের বিক্রমপুর অঞ্চলে স্বদেশি প্রচারের জন্য স্বদেশি ভাণ্ডার, মহিলা সমিতি ইত্যাদি গঠিত হয়েছিল। আর এগুলো গঠন করেছিলেন কমলকামিনী গুপ্তা, নবশশী দেবী, সুশীলা সেন প্রমুখ মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামী। এ-সময়েই এই আন্দোলনের অন্যতম কারিগর নবশশী দেবী তাঁর ১১ বছরের দৌহিত্রীকে দিয়ে বিলিতি কাপড় বর্জনের সংকল্পপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে স্বদেশি ব্রততে দীক্ষিত করেছিলেন। আর তাঁর সেই দৌহিত্রী হচ্ছেন আশালতা সেন। মাত্র ১১ বছর বয়সেই গ্রাম্য মহিলাদের স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন আশালতা সেন।
আরও পড়ুন-বিজেপির হয়ে ক্যাম্প চালাচ্ছে বিএসএফ
১৮৯৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের নোয়াখালিতে জন্ম আশালতার। বাবা বগলামোহন দাশগুপ্ত নোয়াখালি জজ কোর্টের আইনজীবী ছিলেন। মা মানদাসুন্দরী। ছোট থেকেই তাঁর সাহিত্যের প্রতিও ছিল অসম্ভব টান। তখনই কবিতা লিখতেন। শেষ জীবনে লিখেছিলেন আত্মজীবনীও। শৈশবেই পেয়েছেন বৈপ্লবিক পরিবেশ। বড় হয়েছেন বিপ্লবী চিন্তাধারার মধ্যে। তার মাতামহী নবশশী দেবী স্বদেশি আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ফলে স্বদেশি আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রেরণার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে গড়ে তোলার উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সেই তাঁর প্রেরণায় এবং তত্ত্বাবধানে আশালতা ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হয়ে উঠেছিলেন।
দেশের প্রতি ভালবাসার পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যপ্রেমও ছিল অটুট আর সেই কারণে ১৯০৪ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে অন্তঃপুর নামে একটি মাসিক পত্রিকায় তিনি জাতীয়তাবাদী কবিতা লেখেন। তাঁর সেই কবিতা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি বাল্মীকি রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত কাব্যানুবাদ করেছিলেন। এছাড়াও আরও অনেক সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। শেষ বয়সে তিনি তাঁর আত্মজীবনীও রচনা করেছিলেন।
আরও পড়ুন-রফাসূত্র এখনও অধরা, ফের কৃষকদের দমাতে কাঁদানে গ্যাস
আগেকার দিনে ভারতীয় নারীদের ধর্ম, সমাজ ও শাস্ত্রের নামে দমিয়ে রাখা হত। নারীরা তাঁদের প্রাপ্ত মর্যাদা এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। সেই সময় সতীদাহ প্রথা, পর্দাপ্রথা, পণপ্রথার মতো ঘৃণ্য বিষয় সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। এই সমস্ত নারকীয় ঘটনার কারণে সমাজে অনেক নারীকেই বলি হতে হয়েছিল। কিন্তু এই সমস্ত সামাজিক প্রথা দূরে ঠেলে স্বাধীনতা সংগ্রামে শামিল হয়েছিলেন বহু মহিলা। আর তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আশালতা সেন।
আশালতা স্বাধীনতার সংগ্রামের বিভিন্ন বই পড়তেন। আর এই বইগুলো পড়তে গিয়ে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ক্রমাগত উদ্বুদ্ধ হতে থাকলেন। এরপরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন আশালতা সেন। তাঁর স্বামী ছিলেন সত্যরঞ্জন সেন। ১৯১৬ সালে তাঁর স্বামীর অকালমৃত্যু ঘটে। শিশুপুত্র সমরকে নিয়ে অত্যন্ত বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েন আশালতা সেন। আর সেই কারণে তাঁকে সেই সময় স্বাধীনতা সংগ্রামী আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে হয়। সন্তান একটু বড় হওয়ার পর তিনি পুনরায় আবার স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মধারার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ১৯২১ সালে এই আন্দোলন চলাকালীন মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন আশালতা। আর তখন তিনি তাঁর শ্বশুরের সহায়তায় ঢাকার গেন্ডারিয়ায় নিজের বাসভবনে মহিলাদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি বয়ানাগার স্থাপন করেন। এই বয়নাগারের নাম দেন ‘শিল্পাশ্রম’। ১৯২২ সালে তিনি ঢাকা জেলার মহিলা প্রতিনিধি হিসেবে গয়া কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করেন। এই অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে তাঁর সঙ্গে কংগ্রেসের বন্ধন দৃঢ় হয়। দেশের মহিলাদের মধ্যে যাতে দেশাত্মবোধ জেগে ওঠে এবং তাঁদের মধ্যে যাতে গান্ধীজির বাণী প্রচারিত হয় সেই লক্ষ্যে তিনি ১৯২৪ সালে গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি গঠন করেন। সরমা গুপ্তা এবং সরযূবালা গুপ্তার সহযোগিতায় তিনি এই গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি গঠন করেছিলেন। এই সমিতিতে যেসব মহিলা সদস্যা ছিলেন তাঁরা নিজেরাই উৎপন্ন দ্রব্যের বিক্রয় ও প্রচারকার্য পরিচালনা করতেন। এরপরে ১৯২৫ সালে আশালতা সেন নিখিল ভারত কাটুনি সংঘের (এআইএসএ) সদস্য হন। কাটুনি সংঘের সদস্য হওয়ার পর তিনি ব্যাপকভাবে খদ্দরপ্রচারে ব্রতী হন। ১৯২৭ সালে ঢাকায় মহিলা কর্মী তৈরির উদ্দেশ্যে তিনি ‘কল্যাণ কুটির আশ্রম’ স্থাপন করেন। ১৯২৯ সালে সরমা গুপ্তার সহযোগিতায় গেন্ডারিয়ার জুড়ানে শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে ‘জুড়ান শিক্ষা মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন। ওই অঞ্চলের অনুন্নত সম্প্রদায়ের লোকেদের যাতে আত্ম-উন্নয়ন হয় তার জন্য বক্তৃতার মাধ্যমে তাঁরা গণচেতনা জাগ্রত করার চেষ্টা করতেন।
আরও পড়ুন-গত লোকসভা ভোটে ইভিএমে ধরা পড়ে ব্যাপক যান্ত্রিক ত্রুটি! প্রকাশ্যে আরটিআই রিপোর্ট
আশালতা সেন ছিলেন অসম্ভব সাহসী এবং বুদ্ধিমান। ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর লবণ আইন অমান্য আন্দোলনের সময় তাঁর এই বুদ্ধি ও সাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। সেই সময় তিনি উষাবালা গুহ, সরমা গুপ্তা প্রমুখ সহকর্মীদের নিয়ে নোয়াখালি থেকে কিছুটা নোনা জল ঢাকায় নিয়ে আসেন। এবং সেখানকার করোনেশন পার্কে সবার সামনে লবণ তৈরি করে আইন অমান্য আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং তাঁর সঙ্গে বাংলার নানান জায়গায় ঘুরে ঘুরে আন্দোলন সংগঠিত করেন। আর এই কাজের জন্য তিনি আর তাঁর সহকর্মীরা গ্রেফতার হন।
আশালতা সেন জানতেন যে দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক হচ্ছে নারী। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এই নারী-সমাজ যদি নির্লিপ্ত থাকে তারা যদি পুরুষদের কাজে সহায়তা না করে তাহলে কোনও আন্দোলন সফল হতে পারে না। আর সেই কারণেই তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল মহিলাদের আত্মসচেতন এবং সংঘটিত করে তোলা। আর মহিলাদের আত্মসচেতন এবং সংগঠিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি প্রচুর নারী-সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঢাকার জাগ্রত সেবিকা দল, নারী কর্মী শিক্ষাকেন্দ্র, বিক্রমপুরের রাষ্ট্রীয় মহিলা সংঘ এবং কংগ্রেস মহিলা সংঘ। বিক্রমপুরের বিভিন্ন স্থানে মহিলা সংঘের কয়েকটি শাখাও স্থাপিত হয়। মানভূমের কংগ্রেস নেতা নিবারণ দাশগুপ্ত ছিলেন ঢাকার নারীকর্মী শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষক। মেদিনীপুরের কাঁথিতে এবং শ্রীহট্টে অনুরূপ দুটি কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল। কংগ্রেসের মহিলা সংঘ গঠনের সময়, ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের প্রচারকার্য উপলক্ষে তিনি উত্তরবঙ্গ-সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা সফর করেছিলেন। ১৯৩২ সালে গান্ধীজি গ্রেফতারের পর ঢাকায় আইন অমান্য আন্দোলন জোরদার হয়। সেইসময় গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতিকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। কল্যাণ কুটিরের কর্মীদের আবাসগৃহ পুলিশ তালাবন্ধ করে রাখে। এর প্রতিবাদে মহিলা কর্মীদের নিয়ে আশলতা সেন আন্দোলন এবং প্রচারকার্য শুরু করেন। আর এর ফলে তিনি গ্রেফতার হন। এই সময়ই দুটি মামলায় তাঁর সাজা হয়। ১৯৩৩ সালে আশালতা সেন মুক্তি পান। এরপরে তিনি ঢাকা জেলার কংগ্রেসের সহ-সভাপতি হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৪২ সালে মহাত্মা গান্ধীর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন আশালতা। এই সময়ই ঢাকায় পুলিশের গুলিতে এক যুবকের মৃত্যু হয়। সেই মৃত্যুর প্রতিবাদ-মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে আশালতা সেন গ্রেফতার হন। আর এর জন্য তাঁর সাড়ে সাত মাস সশ্রম কারাদণ্ড হয়। ১৯৪৩ সালে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা গিয়েছিল। সেই দুর্ভিক্ষে ক্ষুধার্ত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন আশালতা সেন। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদ এবং ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হওয়ার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর পাশাপাশি আশালতা সেন সমাজকল্যাণমূলক কাজকর্মগুলো চালিয়ে যান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আশালতা সেন নানান ভাবে সাহায্য করেছিলেন। এছাড়াও তিনি সেই সময় শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে কয়েকটি গানও রচনা করেছিলেন।
আরও পড়ুন-মহিলারাই রুখবে বিজেপিকে মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ সাতগাছিয়ার
এরপর ১৯৬৫ সালে তিনি দিল্লিতে বসবাসকারী তাঁর ছেলে সমররঞ্জন সেনের কাছে চলে যান। ১৯৮৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবী আশালতা সেন দিল্লিতে তাঁর পুত্রের বাসভবনে ইহলোক ত্যাগ করেন।
আশলতা সেনের বাড়িটি একটি স্কুল করার জন্য দিয়ে দেওয়া হয়। এই বাড়ি বর্তমানে গেন্ডারিয়া মনিজা রহমান বালিকা বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত।
বাংলার নারী-মুক্তি আন্দোলন এবং ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে জাতিকে মুক্ত করার আন্দোলনে আশালতা সেনের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।