চার দশক ধরে হিংসার উৎসব। নেতৃত্বে প্রবল প্রতাপান্বিত সিপিএম। একের পর এক গণহত্যা। চার দশক ধরে বাংলার বুকে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, জমি লুঠ, ভেড়ি লুঠ, শোষণ, নির্যাতন। একটার পর একটা।
সাঁইবাড়িতে ছেলের রক্তমাখা ভাত মাকে খেতে বাধ্য করা (১৯৭০ ), কাশীপুর বরানগর গণহত্যা (১৯৭১), মরিচঝাঁপিতে উদ্বাস্তু নিধন (১৯৭৯), বিজন সেতুতে আনন্দমার্গীদের জ্যান্ত পোড়ানো (১৯৮২), বানতলায় গণধর্ষণ ও হত্যা (১৯৯০), ধর্মতলায় ২১ জুলাই (১৯৯৩), সূচপুর গণহত্যা ( ২০০০), ছোট আঙারিয়ার গণহত্যা (২০০১), সিঙ্গুর (২০০৬), নন্দীগ্রাম (২০০৭), বাসন্তী (২০০৮), নেতাই (২০১১)। এর বাইরেও রয়েছে অগণিত রক্তগাথা। কোচবিহারে পাঁচ ফরোওয়ার্ড ব্লক কর্মীকে খুন থেকে শুরু করে খিদিরপুর বন্দর এলাকায় পুলিশ অফিসার বিনোদ মেহতাকে খুন, তিলজলায় ওসি গঙ্গাধর ভট্টাচার্যকে খুন থেকে শুরু করে হাওড়ার কেন্দুয়াতে পুরুষদের হাতের কবজি আর মহিলাদের স্তন কেটে নেওয়া, কম রক্তপাত, নির্যাতন, অন্যায় অবিচার দেখেনি পশ্চিমবঙ্গ বামফ্রন্টের আমলে।
আরও পড়ুন-জমা জলের সমস্যা থেকে এবার পাকাপাকি রেহাই, খালের উপর হোয়েল পাম্পিং স্টেশন
এর বিপ্রতীপে তাকাই আজকের সন্দেশখালির দিকে। একজনেরও প্রাণ যায়নি। এক রাউন্ডও গুলি চলেনি। রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে সেই বিদ্রোহের আবহ তৈরির মরিয়া চেষ্টা বহিরাগতদের দিয়ে। আরএসএসের এক ডজন বাছাই করা প্রচারক ছড়িয়ে পড়েছেন গ্রামবাসীদের উত্তেজিত করতে। দিল্লি থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করে নোয়াখালির দাঙ্গার সঙ্গে তুলনা টানা হচ্ছে। আর বঙ্গে অবলাকান্ত, গদ্দার অধিকারী আর আগুন সখীর দল তুলনা টানছেন নন্দীগ্রামের সঙ্গে। ইতিহাস ভুলিয়ে ঘুলিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরার মরিয়া চেষ্টা।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর সভা, প্রস্তুত পুরুলিয়া
দাঙ্গা! লাগাতে পারলেই ষোলোকলা পূর্ণ হয় গেরুয়া দলের। টানটান মেরুকরণই পদ্ম ফোটার আদর্শ মরশুম! ভোটের বাজারে ইস্যুটাকে তপ্ত কড়াইতে ফেলে আগুন পোয়ানোর বর্ণাঢ্য আয়োজন। সেই পটভূমিতে কেন্দ্রের মন্ত্রীসান্ত্রিদের ডেলি প্যাসেঞ্জারি, যার শুরু আগামী সপ্তাহে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দিয়ে। এক সপ্তাহে তিনবার। আরামবাগ, কৃষ্ণনগর ও বারাসত। এমনও শোনা যাচ্ছে, বিশ্বগুরুর সফর পর্যন্ত তাওয়া গরম রাখার নির্দেশ এসে গিয়েছে দিল্লি থেকে। তাই সার, জল দাও। সোজা আঙুলে পশ্চিমবঙ্গে আসন বাড়ানো যাবে না দেখে আঙুল বেঁকিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার প্রাণান্তকর চেষ্টা। জল ঘোলা করার এই খেলায় চোদ্দো আনা বিজেপি আর বাকি দু আনা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় জগাই আর মাধাই। ওদিকে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, সংগঠন বলে তো কিছুই নেই, আগের বারের ১৮ আসন জেতার রেকর্ডটা অন্তত ছুঁতে হবে যে!
বোধহয় ওরা ভুলে গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণ-আন্দোলনের ইতিহাস। চার দশকেরও বেশি দীর্ঘ রাজনৈতিক কেরিয়ারে যখনই আঘাত নেমে এসেছে তখনই আরও দ্বিগুণ বেগে প্রত্যাঘাত করেছেন। শত প্রতিকূলতা, হামলা তাঁর লড়াইকে আরও উজ্জ্বল করেছে, মহান করেছে। এবারও এজেন্সির হানা, নেতা, মন্ত্রী, বিধায়কদের গ্রেপ্তারি এবং সবশেষে কলকাতা থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরের সন্দেশখালির ‘অমানবিক’ কার্যকলাপের পর্দাফাঁস। নিঃসন্দেহে একটা অন্যায় হয়েছে। এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কতজনের জমি দখল হয়েছে, ক’জন নারীর সম্ভ্রম হরণ হয়েছে তা তদন্তের বিষয়। কিন্তু একজনেরও হয়ে থাকলে তা যেমন ঘৃণ্য অপরাধ, তেমনই স্রেফ ভোটের লক্ষ্যে নারীর ইজ্জত হরণের কাহিনি নিয়ে তিলকে তাল করার প্রয়াসও সমান দোষে দুষ্ট। জোর করে চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে বলপূর্বক ভেড়িতে পরিণত করা নিঃসন্দেহে অন্যায়। দোষীর শাস্তি চাই। কিন্তু ভুললে চলবে না, যতজন নারী কিংবা পুরুষ ক্যামেরার সামনে অভিযোগ করেছেন তাঁদের কথায় উঠে এসেছে প্রধানত তিনটি নাম। এরা তিনজনই কি একটা দল হতে পারে কিংবা সরকার? তা তো হতে পারে না। সরকার ও দলটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁকে দেখেই ২৯৪ আসনে মানুষ ভোট দেয়। একুশের ভোটেও নেত্রীকে সামনে রেখেই তৃণমূল প্রার্থী সুকুমার মাহাত পেয়েছেন ১ লক্ষ ১২ হাজার ভোট। এই লক্ষাধিক মানুষের জনসমর্থনের উৎস কারা? অনুগামী আছেন, সমর্থক আছেন, আছেন কট্টর দলীয় কর্মী, সৎ নেতা, অসৎ ধান্দাবাজ স্থানীয় ব্যবসায়ী সবাই। ভালমন্দ নিয়েই সমাজ। শুধু তিনজনের অপকর্মের জন্য সব শেষ হয়ে যেতে পারে না।
আরও পড়ুন-অবৈধ নির্মাণ বুলডোজার চালিয়ে ভাঙল বন দফতর
প্রতিবাদ সবসময় স্বাগত কিন্তু ভোটের নামে কুৎসা অপপ্রচার মেনে নেওয়া যায় কি? শিবু, উত্তম, শাহজাহান দল নয়। দল মানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জননেত্রীর রাজনৈতিক জীবন খোলা খাতার মতো। স্বচ্ছতা সংশয়াতীত। কী বিরোধী নেত্রী আর কী মুখ্যমন্ত্রী, শত প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়েও মানুষের আদালতে কৈফিয়ত দিতে তিনি কসুর করেননি কখনও। তাঁর জনসমর্থনের তল আজও পায়নি বিরোধীরা। এবারও কিন্তু তিনি তৈরি। আবারও খেলা হবে। আরও প্রো-অ্যাকটিভ মেজাজেই খেলা হবে। মরিয়া চেষ্টা হবে, টাকার বন্যা বইবে, হাওয়াই জাহাজের মহার্ঘ জ্বালানি নষ্ট হবে। সকাল বিকেল ডেলি প্যাসেঞ্জারি চলবে পাল্লা দিয়ে। তবু মাত্র তিনজনের কৃতকর্মের দায় চাপিয়ে একটা রাজনৈতিক দলকে কলঙ্কিত করার চক্রান্ত এবারও সফল হওয়া কঠিন। কারণ সন্দেশখালি গোটা রাজ্য নয়। তার চেয়েও কঠিন বাংলা ও বাঙালির অস্মিতাকে বিসর্জন দিয়ে বহিরাগতদের দ্বারা চালিত একটি দলকে বাংলায় পাকাপাকি জায়গা দেওয়া।
গোটা পশ্চিমবঙ্গ মানে ৮৮,৭৫২ বর্গকিলোমিটার বা ৩৪,২৬৭ বর্গমাইল। মোট জনসংখ্যা প্রায় ১০ কোটির মতো। আর এই সন্দেশখালির ১ ও ২ নং ব্লক মিলিয়ে তিন লক্ষের কিছু বেশি মানুষের বাস। এলাকা ৪০০ বর্গকিলোমিটারের মতো। সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশের আশেপাশে। অর্থাৎ, সন্দেশখালি সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি নয়। এটা সবার মনে রাখা দরকার।