নির্বাচনী বন্ড একটি কেলেঙ্কারি ছিল। তা বাতিল হওয়ায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আশা করি, নির্বাচনের সময় মানুষের পারস্পরিক সমর্থনে আরও বেশি স্বচ্ছতা আসবে। —বক্তব্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী বন্ড মামলার শুনানিতে গোটা বিষয়টিকে ‘অসাংবিধানিক এবং বাতিল’ বলে ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ। স্বচ্ছতার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় এসবিআই ও নির্বাচন কমিশনকে। মোট ২৩২ পাতার রায়ে বলা হয়েছে, এসবিআই আর কোনও নির্বাচনী বন্ড বিক্রি করতে পারবে না। ২০১৯ সালের ১২ এপ্রিল থেকে এখনও পর্যন্ত বিক্রি হওয়া নির্বাচনী বন্ড সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আগামী ৬ মার্চের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে জমা দিতে হবে।
এই প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেনের বক্তব্য খুব পরিষ্কার। তিনি বলছেন, ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থা দলীয় রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত। এর ফলে সাধারণ মানুষ কী চাইছেন, তা বোঝা কঠিন হয়ে পড়ছে। আসলে, বিরোধী দলগুলির প্রতি সরকার কী ধরনের মনোভাব পোষণ করে, তার মধ্যে দিয়েও দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রভাবিত হয়। বিরোধীদের প্রতি সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা নির্বাচন ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলে। আমরা নাগরিকদের মতামত ও কাজের স্বাধীনতার পাশাপাশি যতটা সম্ভব একটি অবাধ নির্বাচনী ব্যবস্থা চাই। সেজন্য ভারতীয় সংবিধানে সমস্ত নাগরিকদের সার্বিক রাজনৈতিক স্বাধীনতার পরিসর দিতে চেয়েছে। কোনও একটি বিশেষ গোষ্ঠীর বিশেষ সুবিধা থাকুক, তা কখনওই চাওয়া হয়নি।
আর এই চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মিলছে না নির্বাচনী বন্ডের ব্যাপারে। সেখানে কেবল শাসক দলের সুবিধা বহাল ছিল এতদিন যাবৎ।
এর সমান্তরালে দেশে চলছে অঘোষিত জরুরি অবস্থা। তারই জেরে অধ্যাপিকা নীতাশা কাউলকে ভারতে ঢুকতে দেয়নি মোদি সরকার (Modi era)। তিনি জন্মসূত্রে কাশ্মীরি পণ্ডিত, বর্তমানে ব্রিটেনের বাসিন্দা। ওয়েস্টমিনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। কর্নাটক সরকারের আমন্ত্রণে সংবিধান ও জাতীয় সংহতি বিষয়ক একটি সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে এসেছিলেন। বেঙ্গালুরু বিমানবন্দরের বাইরে বেরতে পারলেন না। দীর্ঘক্ষণ দমবন্ধকর ছোট্ট একটি ঘরে বসিয়ে রাখার পর পত্রপাঠ তাঁকে ব্রিটেনে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১২ ঘণ্টা সফরের পর বেঙ্গালুরুতে এসে তাঁকে ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। একটি ছোট্ট সেলে তাঁকে রাখা হয়েছিল। জল বা খাবারের ঠিকমতো ব্যবস্থা ছিল না। বালিশ বা কম্বলও দেওয়া হয়নি। এরপরে ফের ১২ ঘণ্টা বিমানে চেপে ব্রিটেনে ফিরেছেন তিনি। অভিযোগ, এর আগেও বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন তাঁকে খুন-ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে। এমনকী ভারতে বসবাসকারী তাঁর অসুস্থ, ধর্মপ্রাণ মায়ের বাড়িতেও পুলিশ গিয়েছে। আরএসএসের সমালোচনা করে লেখালিখি ও বক্তব্যের জন্য এই পদক্ষেপ। তাতেও দমানো যাচ্ছে না তাঁকে। বলছেন, ‘আমার কাজই আমার হয়ে কথা বলবে।’
আরও পড়ুন- সারি-সারনা ধর্মের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনে আন্দোলন, জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী
নীতাশা বিভিন্ন নথি ও আমন্ত্রণপত্রের ছবি এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করে লিখেছেন, ‘কর্নাটক সরকার আমাকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু ভারত সরকার ঢুকতে দিল না। অভিবাসন দপ্তরের তরফে শুধু বলা হল, দিল্লির নির্দেশ রয়েছে। অথচ দিল্লি থেকে আমাকে আগে কোনও নোটিশ বা চিঠি দিয়ে আসতে বারণ করা হয়নি।’
গত বছরের নভেম্বরে পতঞ্জলিকে বিভিন্ন রোগের প্রতিকার হিসাবে নিজেদের ওষুধ সম্পর্কে ‘বিভ্রান্তিকর এবং মিথ্যা’ প্রচার করার বিষয়ে সতর্ক করেছিল শীর্ষ আদালত। জরিমানা হতে পারে বলেও মৌখিক ভাবে জানানো হয়েছিল। রামদেবের সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ)। আইএমএ-র অভিযোগ ছিল, পতঞ্জলির বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপনে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা এবং চিকিৎসককে অসম্মান করা হয়েছে। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার অভিযোগও আনা হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, কোভিড প্রতিরোধী না-হওয়া সত্ত্বেও শুধু করোনিল কিট বিক্রি করেই আড়াইশো কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছিল রামদেবের পতঞ্জলি। আর তার জন্য ‘বিভ্রান্তিকর এবং মিথ্যা’ বিজ্ঞাপনী প্রচার চালানো হয়েছিল বলে অভিযোগ ছিল আইএমএ-র।
সরকার চোখ বন্ধ করে বসে আছে! যোগগুরু রামদেবের পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ সংস্থার ‘বিভ্রান্তিকর এবং মিথ্যা’ বিজ্ঞাপনী মামলায় কেন্দ্রের নিন্দা করে তেমনটাই মন্তব্য করেছে সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের মন্তব্য, ‘‘সরকার চোখ বন্ধ করে বসে আছে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।’’
কী বুঝলেন?
এই দেশের ১৪০ কোটি নাগরিক সরকার নির্বাচন করেন পরের পাঁচ বছর সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের আশায়। তাঁরা বিশ্বাস করেন, এই সরকার তাঁদের জন্য কিছু করবে। কিন্তু মোদি সোমবার সাফ বলেছেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে আমি এমন ব্যবস্থা কার্যকর করব যে, দেশবাসীর জীবনে সরকারের ভূমিকাই কমে যাবে। বিশেষ করে মধ্যবিত্তের। মানুষ তো নিজেদের কাজ নিজেরা করতেই সমর্থ। সেটাই তারা করুক না! সমস্যায় পড়লে তখন সরকার সাহায্য করতে পারে। এর বেশি কিছু নয়।’ বিষয়টা পরিষ্কার। মধ্যবিত্তের দায় আর নিতে চান না মোদি (Modi era)। অথচ, এই মধ্যবিত্তই সবচেয়ে বেশি ভোগ্যপণ্য কিনে বাজার অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখে, আয়কর দেয়, মূল্যবৃদ্ধি-বেকারত্বের জ্বালায় ভোগে, আর তারপরও প্রধানমন্ত্রী তাদের দায় নিতে অস্বীকার করেছেন। মধ্যবিত্ত আর সরকারের থেকে সরাসরি কোনও আর্থিক সহায়তা পাবে না।
টেক্সটাইল প্রদর্শনীর উদ্বোধন করে মোদি বলেছেন, ‘ভারতের বস্ত্র বৈচিত্র্যের সম্ভার ঐক্য ও সমন্বয়ের উদাহরণ।’ তিনি কাশ্মীরের কানিশাল, উত্তরপ্রদেশের জারদৌসি, বেনারসি, তামিলনাড়ুর কাঞ্জিভরম, ওড়িশার সম্বলপুরি, গুজরাতের পটোলা এবং মহারাষ্ট্র সিল্কের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বাংলার কথা কিন্তু তাঁর মনে আসেনি। তসর থেকে ধনেখালি, মুর্শিদাবাদ সিল্ক থেকে বালুচরির নাম স্থান পায়নি তাঁর ভাষণে। দেশে সাতটি পিএম মিত্র পার্ক হচ্ছে। এর মাধ্যমে ভারতের বস্ত্রশিল্প উন্নত হবে। বাংলা এই তালিকাতেও নেই।
সুতরাং মোদি জমানায় (Modi era) বাংলার প্রাপ্তি শুধুই শূন্য।