প্রতিবেদন : সোশ্যাল মিডিয়া জকের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই। কিন্তু তার সব খবর সত্যি নয়। অনেক ‘ফেক নিউজ’ দিয়ে বিকৃত খবর দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়। সামাজিকভাবে মানুষকে অসম্মানিত করা হয়। হেয় করা হয়। যা কাম্য নয়। নতুন প্রজন্মের কাছে আমার আবেদন, সোশ্যাল মিডিয়ার সব খবর বিশ্বাস করবেন না। রবিবার দিদি নাম্বার ওয়ানে এই বার্তাই দিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা বাংলার দিদি, ইউনিভার্সাল দিদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শোনালেন ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ মেয়ে থেকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ওঠার এই দীর্ঘ চড়াই-উতরাইয়ের জার্নি। একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মনে করিয়ে দিলেন বাংলার মেয়েরা যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তার জন্য স্বল্প সুদে রাজ্য সরকার ৫ লক্ষ টাকা করে ঋণ দেওয়ার একটি স্কিম চালু করেছে। সঞ্চালিকা রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেন এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যাতে এই প্রকল্পটি তুলে ধরা হয়। রচনার সঞ্চালনায় ১৪ বছর ধরে চলা টেলিভিশনের এই জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে এসে নিজস্ব মেজাজ ও ক্যারিশমায় মাতিয়ে দিলেন দিদি। সঙ্গে ছিলেন সৌরভপত্নী নৃত্যশিল্পী ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়, শিল্পী অরুন্ধতী হোমচৌধুরী, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায় আর মঞ্চের উল্টোদিকে দর্শকাসনে ছিলেন বাংলার নবীন-প্রবীন প্রথিতযশা শিল্পীরা। গানে মঞ্চ মাতালেন মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন। কখনও জীবনের চলার পথের নানা টুকরো গল্প, আবার কখনও নিজের লেখা ও সুর করা গানের অনুরোধ, আবার কখনও সাঁওতাল রমনীদের সঙ্গে গানের তালে পা মেলালেন। নিজেই বললেন আমি ধামসা বাজাবো। বাজালেনও।
আরও পড়ুন-গ্রামে ঢুকে বিপদে চিতা, কলসিতে আটকাল মাথা!
ছেলেবেলার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে দিদি বললেন, আমার যখন ১০-১১ বছর বয়স তখন বাবা মারা যান। গোটা পরিবারকে আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়তে হয়। মা অসহায় হয়ে পড়েন। সেখান থেকে সংসার চালাতে লড়াই করতে হয়েছে। দুধের ডিপোয় কাজ করেছি। ৪০-৪৫ টাকা পেতাম। সংসারে কাজে লাগত সেটা। এরপর পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি। ভোর ৩টেয় উঠে রান্না করতাম। ভাই-বোনদের সামলাতাম। কলেজ করেছি। টিউশন করেছি। স্কুলে পড়িয়েছি। সে সময় পড়িয়ে মাসে ৬০ টাকা পেতাম। পুরোটাই মার হাতে তুলে দিতাম। আমরা কষ্ট করেছি কিন্তু কখনও কারও কাছে ভিক্ষা করিনি। আমাদের প্রজন্মটাকে আমি ধরে রেখেছিলাম। অনেক বড় পরিবার আমাদের। প্রায় ৩০ জন মেম্বার। তবে আমজকের প্রজন্মকে অভিষেক ধরে রেখেছে। আমার মনে আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা। বাবার কাছে শুনতাম। রেডিওতে শুনতাম। সেসব অন্যদিন ছিল।
আরও পড়ুন-গ্রামে ঢুকে বিপদে চিতা, কলসিতে আটকাল মাথা!
এখন জীবনটা অন্যরকম। আমার গোটা জীবনটাই লড়াই-আন্দোলনে কেটেছে। বাকি জীবনটাও আন্দোলন, লড়াই, প্রতিবাদ করে যাব। অনেকে বলেন রাজনীতি নাকি খুব খারাপ। আমি সেটা বিশ্বাস করি না। কারণ, যেকোনও জিনিসেরই ভাল-খারাপ দুটো দিক আছে। খারাপ দিকটা বর্জন করে ভাল দিকটা নিতে হবে।
নিজেদের বাড়ির কথা বলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আমাদের গঙ্গার পাড়ে বাড়ি। বাড়ির পাশে একটা ঘাট আছে। শুনেছি সেখানে রানি রাশমণি আসতেন। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও আসতেন।
আরও পড়ুন-গাজায় প্রথম মানবিক ত্রাণ পৌঁছে দিল আমেরিকা, ৩৮ হাজার রেডি-টু-ইট মিল প্যাকেট
সঞ্চালক রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় দিদিকে জিজ্ঞাসা করেন তাঁর ডায়েটের কথা। উত্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ওভাবে ডায়েট বলে কিছু হয় না। যে যেভাবে সুস্থ থাকবে সেটাই কার্যকর। তবে খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরচর্চাও করতে হবে। নিজের প্রাত্যহিক রুটিন তুলে ধরে বলেন, আমি ঘুম থেকে উঠেই বিছানাতে ১ ঘণ্টা ব্যায়াম করি। এরপর পুজো সেরে নিয়ে অফিস বেরোনোর আগে এক ঘণ্টা হাঁটি। আমি হাঁটতে হাঁটতেই অনেক কাজ করি। এটা আমার অভ্যাস। আমি মনে করি মানুষ যতদিন সুস্থ থাকবে, ততদিন কাজ করবে। আমার প্রেরণা বাংলার মানুষ। সবাইকে নিয়েই আমি চলি। আমি বলি কখনও অবসাদ এলে শিশুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে হবে। কাগজ-পেন টেনে নিয়ে ছবি আঁকতে হবে। যাই আঁকুন না কেন তাহলেই দেখবেন মনের সব রাগ বেরিয়ে যাবে। দিদি নাম্বার ওয়ানে গোল্ডেন টিপস দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মানুষ ভাল থাকলে আমিও ভাল থাকি। বক্তব্য তাঁর।
আরও পড়ুন-তৃণমূলের অভিযোগ সত্য প্রমাণিত করে প্রার্থী হতে চলেছেন অভিজিৎ গাঙ্গুলি
পুরনো দিনের কথা বলতে গিয়ে উঠে আসে বয়সের প্রসঙ্গ। তখনই দাদার কথা উল্লেখ করে মজার গল্প বলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, আগেকার দিনে এতো সব ব্যাপার ছিল না। তাই হঠাৎ আমি আর আমার দাদা আবিস্কার করি, সার্টিফিকেটে আমি আর আমার দাদার বয়সের ব্যবধান ৬ মাসের। আসলে আমার দাদা আমার থেকে ৫ বছরের বড়। এই কথা প্রসঙ্গে নিজের জন্মদিনের কথাও তোলেন দিদি। তিনি বলেন, আমাকে অনেকে ৫ জানুয়ারি জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। আসলে ওই দিনটিই অফিসিয়ালি সার্টিফিকেটে রয়ে গিয়েছে। আমি জন্মেছিলাম অষ্টমীর দিন। ৫ অক্টোবর। সেদিন প্রবল বৃষ্টি হয়েছিল। তাই আমি মনে করি বৃষ্টি আমার জীবনের শুভ। যাদবপুরে প্রথমবার লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়ানোর কথা উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ওই বয়স বাড়ানো ছিল বলেই আমি নির্বাচনে দাঁড়াতে পেরেছিলাম। না হলে পারতাম না।
রাজ্য সঙ্গীত দিয়ে রাত ৮টা থেকে শুরু হওয়া দু’ঘণ্টার অনুষ্ঠানে ছিল একের পর এক চমক ও রঙিন সব মুহূর্ত। কখনও আজকের প্রজন্মের সঙ্গীত শিল্পী ও বিধায়ক অদিতি মুন্সি গাইছেন, তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো। মুগ্ধ হয়ে শুনছেন মুখ্যমন্ত্রী। আবার একেবারে অঙ্কিতা ভট্টাচার্য আবার রথিজিৎ সেনগুপ্তর গানে মাতল অনুষ্ঠান। ইন্দ্রনীল সেন তাঁর পুরনো অ্যালবাম সুরের বলাকা থেকে গান ধরে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন করার আগেই অখিলবন্ধু ঘোষের নাম শুনে হেসে ফেললেন। আবার কখনও গান ধরলেন রূপঙ্কর বাগচি। গাইলেন শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। শালবনী থেকে আসা সাঁওতাল নৃত্যশিল্পীরা মাতিয়ে দিলেন অনুষ্ঠান।
রাজ্যের উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে এল রাজ্যে শিল্পায়নের কথা। সেই প্রসঙ্গেই তিনি বললেন, আমাদের রাজ্যে এই মুহূর্তে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা নীরবচ্ছিন্নভাবে চলতে চলতে দেশে একনম্বর জায়গায় চলে গিয়েছে। এখানে বিদ্যুতের কোনও সমস্যাই নেই। শিল্পের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর সরকার ও দলের পক্ষ থেকে বাংলার মানুষকে ধন্যবাদ জানান। দিদিকে একটি মেমেন্টো দেওয়া হয়। যাতে লেখা ছিল দিদি তুমি অনন্যা। রচনা তাঁকে বাঁকুড়ার টেরাকোটার একটি দুর্গামূর্তি ও শঙ্খ উপহার দেন। যা তিনি তুলে দেন শিল্পী ইন্দ্রনীল সেন ও রূপঙ্করের হাতে। অনুষ্ঠানের একটি জায়গায় রুটি বেলার আয়োজন ছিল। সেখানেও দক্ষতার সঙ্গে দেখিয়ে দেন তিনি মুখ্যমন্ত্রী হলেও ঘরকন্যাতেও সমান পারদর্শী। বলেন, যখন সাংসদ ছিলাম (৭ বারের) তখন রান্না করতাম। খাওয়াতাম। এখন টুকটাক করি। তবে দিদি নাম্বার ওয়ান তাঁর বাড়ির বউ-মেয়েরা সকলেই আগ্রহের সঙ্গে দেখেন তা বলতেও ভোলেননি। তিনি রচনাকে বলেন, তোমরা না বললেও এই অনুষ্ঠানটি তোমাদের কাছে চেয়ে নিয়েছি। তবে রবিবাসরীয় সন্ধ্যায় গোটা বাংলা চোখ রেখেছিল টেলিভিশনের পর্দায় বাংলার ১ নম্বর দিদিকে দেখতে।