ঋষি অরবিন্দ তাঁর ‘ধর্ম’ নামাঙ্কিত রচনায় লিখেছিলেন, ‘‘বিচারের শুদ্ধতা সমাজের স্তম্ভস্বরূপ’’।
আর বিচারের অশুদ্ধতা!
অরবিন্দের কথাটি যদি সত্য হয়, তাহলে মানতেই হবে, বিচারে যদি খাদ থাকে তবে তা সমাজে ন্যায়ের স্তম্ভটিকে লোপাট করে দেয়। এই অপকর্মটিই করে চলেছে মোদি জমানা। একের পর এক ঘটনায়। স্পষ্ট লেনদেনের হিসাব। তুমি আমাদের ন্যায়ের নামে পক্ষপাত দুষ্ট রায় দাও, আমরা তোমাকে উপঢৌকন দিয়ে পুষিয়ে দেব।
অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের পালটি খেয়ে পলিটিক্সে প্রবেশ সেই ধারারই সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। তদতিরিক্ত কিছু নয়। কিস্যুটি নয়।
আরও পড়ুন-সাইবার ফাঁদ রুখতে চালু হল কেন্দ্রের নয়া পোর্টাল
‘গেল। গেল।’ রব তোলার কোনও ব্যাপার নেই। কারণ, এই যে প্রথম এজলাস ছেড়ে কেউ রাজনীতির মঞ্চে গেলেন, এমনটা নয়। মোদি জমানাতেই যে এই দৃষ্টান্ত প্রথম স্থাপিত হল, তাও নয়।
আজ থেকে ৫৭ বছর আগেকার কথা। সন ১৯৬৭। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কোকা সুব্বা রাওয়ের অবসর গ্রহণের আর তিন মাস বাকি। তিনি কোর্টরুম ছেড়ে পলিটিক্সে এলেন। বিরোধীরা তখন কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে কাকে দাঁড় করাবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। সুব্বা রাও তাঁদের সেই সমস্যাটা মেটালেন। জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হলেন। জেতার আশা ছিল না। জিততেও পারেননি। সুতরাং পদের লোভে পদত্যাগের ঘটনা এটা নয়। বরং বলা যেতে পারে, আদর্শের টানে আত্মত্যাগ।
তবে ডিগবাজির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন আর একজন। বাহারুল ইসলাম। অসম হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ছিলেন। কংগ্রেসের টিকিটে রাজ্যসভায় সাংসদ পদে নির্বাচিত হন। দুবার। ১৯৬২ ও ১৯৬৮-তে। ১৯৭২-এ রাজ্যসভার সাংসদ পদে ইস্তফা দিয়ে গুয়াহাটি হাইকোর্টে বিচারপতির পদে যোগ দেন। তখন সেটাকে বলা হত অসম অ্যান্ড নাগাল্যান্ড হাইকোর্ট। ১৯৭৯-র ১১ মার্চ তিনি ওই উচ্চ ন্যায়ালয়ের কার্যকরী প্রধান বিচারপতির পদে আসীন হন। ১৯৮০-র ৪ ডিসেম্বরে তিনি সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি হন। সে বছরই ১ মার্চ তিনি গুয়াহাটি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে অবসর নেন। অবসর গ্রহণের পর বিচারপতি পদে পুনরাভিষেক সেই প্রথম। ১৯৮৩-তে ফের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পদে ইস্তফা দিয়ে লোকসভা ভোটে দাঁড়ান কংগ্রেসের টিকিটে। সেবার অসমে ভোট বাতিল হয়ে যায়। ১৯৮৪-তে তিনি কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবেই রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন।
আরও পড়ুন-জলসংকটে জেরবার বেঙ্গালুরু
কে এস হেগড়ে। কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচিত দু’দুবার রাজ্যসভার সাংসদ। ১৯৫৭-তে তিনি মাইসোর হাইকোর্টের বিচারপতি পদে আসীন হলেন। অবসর গ্রহণের পর লোকসভার ভোটে দাঁড়ালেন, জিতলেন। ১৯৭৭-এ সেই সূত্রে তিনি লোকসভার স্পিকার। হেগড়ে জিতেছিলেন জনতা দলের টিকিটে।
এফ আই রেবেলোও অনুরূপ কাণ্ড ঘটান। ১৯৭৭-এ গোয়া বিধানসভায় ভোটে জেতেন জনতা দলের টিকিটে। পরে বোম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি হন। ১৯৮৯-তে লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়ে হারার পর আর রাজনীতিতে পা মাড়াননি।
এসব উদাহরণের দিকে তাকালে বঙ্কিমী কমলাকান্তের একটা উক্তি মনে পড়ে যায়।
‘‘মনুষ্য মাত্রেই পতঙ্গ। সকলেরই এক একটি বহ্নি আছে, সকলেই সেই বহ্নিতে পুড়িয়া মরিতে চাহে, সকলেই মনে করে, সেই বহ্নিতে পুড়িয়া মরিবার অধিকার আছে— কেহ মরে, কেহ কাচে বাধিয়া ফিরিয়া আসে।’’
এই ব্যাপারটাকে বিজেপি ট্রেন্ডিং প্র্যাকটিস করে ছেড়েছে।
আরও পড়ুন-কর্মী-শায়েস্তার ফরমান মণিপুরে, বিজেপি রাজ্যে সরকারি বিজ্ঞপ্তি ঘিরে চাঞ্চল্য
একথা বলছি তার কারণ একাধিক। অবসরের পর বিচারপতিদের পুরস্কৃত করার ট্রেন্ডটি মোদি জমানায় উৎকট ভাবে প্রকট।
এ কে বিশ্বেশ। বারাণসীর জেলা বিচারপতি ছিলেন। অবসর নেওয়ার দিন জ্ঞানবাপী মসজিদে পূজা-অর্চনার নির্দেশ দিলেন। সংঘের অ্যাজেন্ডার পক্ষে রায়। পুরস্কারস্বরূপ যোগী সরকার পরিচালিত ড. শকুন্তলা মিশ্র ন্যাশনাল রিহ্যাবিলিটেশন ইউনিভার্সিটির লোকপাল পদে নিযুক্ত হলেন।
এ এম খান উইলকর। এই বিচারপতি ২০০২-তে গুজরাত গণহত্যায় মোদিজিকে পাকাপাকিভাবে রেহাই দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি থাকার সময় তাঁর একের পর এক রায় পিএমএলএ, ইউএপিএ আর এফসিআরএ-কে বিরোধী দমনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে মোদি সরকারকে। ইউএপিএ আইনে কেউ গ্রেফতার হলে তার জামিন পাওয়ার সুযোগ কেড়ে নিয়েছে খানউইলকরের রায়। অসরকারি সংস্থাগুলোর বিদেশি অনুদান বন্ধের ব্যবস্থা করেছে এই বিচারপতির রায়। অ্যামেনিস্টি ইন্ডিয়া থেকে শুরু করে মাদার টেরিজার সংস্থা পর্যন্ত সবাই এই রায়ের কোপে পড়ে অনুদান খুইয়েছে। আর এসবের পুরস্কার হিসেবে এই খানউইলকরকেই লোকপালের চেয়ারপার্সন পদে বসিয়েছে মোদি সরকার।
আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে নির্যাতিতার বাবার ঝুলন্ত দেহ গাছে
ভুয়ো এনকাউন্টারে সোহরাবুদ্দিন খুনে অমিত শাহর বিরুদ্ধে এফআইআর খারিজ করে দিয়েছিলেন পি সদাশিবম। অবসর গ্রহণের পর তাঁকেই কেরলের রাজ্যপাল পদে বসিয়েছে বিজেপি।
এই সাম্প্রতিক পরম্পরার সর্বশেষতম সংযোজন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। রামপক্ষের হৃদয় নিয়ে বামপন্থী সাজার চেষ্টা করতেন। এখন সাজ খুলে রেখে গেরুয়া আলখাল্লা গায়ে জড়িয়েছেন। খুল্লামখুল্লা কুৎসা করছেন মা-মাটি-মানুষের সরকারের বিরুদ্ধে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে।
নোংরা মাখা এই পদ্মপন্থীর আগামী দিনের জন্য ধিক্কার রইল।
ছিঃ!