শুষ্ক শীতের রুক্ষতা কাটিয়ে বসন্ত এসে গেছে। আর মাত্র ক’দিন বাকি গ্রীষ্মের দাবদাহে প্রবেশ করতে। বাতাসের যেমন জরাজীর্ণ, শীতকাতুরে চেহারা সেই সঙ্গে ত্বক, চুল, হাত-পায়েরও। এর কারণ সিজন চেঞ্জ। এদিকে দূষণের বাড়বাড়ন্ত।
তাই ঋতু পরিবর্তন বা সিজন চেঞ্জের সঙ্গে ত্বকের যত্নেরও পরিবর্তন বাধ্যতামূলক। কারণ আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আর্দ্রতার মাত্রা পরিবর্তিত হয়। আমরা যে বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি এবং ত্বক শ্বাস নিচ্ছে তার আর্দ্রতা পরিবর্তিত হয়। এছাড়াও সূর্যের এক্সপোজারের পরিমাণও পরিবর্তিত হতে পারে।
এই সময় ঠান্ডা নেই তবু ত্বকের আর্দ্রতা উধাও, রুক্ষ চুল আরও যেন এলোমেলো, ফাটাফুটি ঠোঁট, লিপস্টিক পরার পর আরও ড্রাই, হাত পায়ে একটু টানটান ভাব। সবটাই কেমন যেন ঠিক নেই। ঘরোয়া টোটকা বা বিভিন্ন ঘরোয়া উপাদানেই হয়ে যেতে পারে এই সিজন চেঞ্জ জনিত অর্ধেক সমস্যার সমাধান।
ত্বকের যত্নে
ঋতু পরিবর্তনে ত্বক মানেই অচেনা। খানিকটা তেলতেলে আবার খানিকটা রুক্ষ, শুষ্ক। অথচ একটা টান টান ভাব ধরে থাকে সারাটাক্ষণ। মুখের ত্বক হোক বা শরীর তাতে স্বাভাবিক তেলা ভাব ধরে রাখতে সরাসরি ঠান্ডা জল ব্যবহার না করে ঈষদুষ্ণ জল দিয়ে মুখ ধোবেন সবসময়।
ঘরোয়া ক্লেনজার
এই সময় ত্বকের ক্লেনজিং খুব জরুরি। পরিষ্কার ত্বকে ঋতু পরিবর্তন জনিত সমস্যা দেখা দেয় না। কাঁচা দুধ খুব ভাল ঘরোয়া ক্লেনজার। কাঁচা দুধে তুলো ভিজিয়ে তা দিয়ে যেমন মুখ পরিষ্কার করা যায় তেমনই কাঁচা দুধের সঙ্গে চিনি অথবা চালের গুঁড়ো মিশিয়ে একটা দারুণ ঘরোয়া স্ক্রাবার তৈরি করে নিতে পারেন যা এই ঋতু পরিবর্তনের সময় ত্বকের অতিরিক্ত মরা কোষ তুলে দেবে। ত্বক হবে উজ্জ্বল সতেজ।
ঘরোয়া টোনার
এবার আলতো করে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে টোনার, লাগান। এখনও বাজারে প্রচুর ধনেপাতা। দামটাও কমই। ধনেপাতা নিন আধকাপ, গোলাপ জল আধকাপ, এক চা-চামচ মধু। একসঙ্গে মিশিয়ে পেস্ট করে ছেঁকে নিন অথবা ধনেপাতা ফুটিয়ে সেই জলটা ছেঁকে নিয়ে ওর মধ্যে গোলাপ জল আর মধু দিন। এবার একটা স্প্রে বোতলে ভরে ফ্রিজে রাখুন যখন প্রয়োজন স্প্রে করুন এটা খুব ভাল টোনার। পুদিনা পাতা নিন ভাল করে ধুয়ে জলে ফোটান। এবার সেই জল ছেঁকে ঠান্ডা করে স্প্রে বোতলে ঢেলে ফ্রিজে রেখে দিন। যখন প্রয়োজন ব্যবহার করুন।
ঘরোয়া ময়েশ্চারাইজার
টোনিং করার পর ময়েশ্চারাইজার লাগান। এখন আর ভারী ময়েশ্চারাইজার নয় আবার সরাসরি জেল-বেস ময়েশ্চারাইজারও নয়। হালকা কোনও লোশন ব্যবহার করতে হবে। এতদিন যেটা ব্যবহার করেছেন তুলে রাখুন। মুখে ভারী তেল এবং ভারী সিরাম এড়িয়ে চলুন।
বাড়িতে তিলের তেল থাকলে আলাদা করে বডি অয়েল বা ময়শ্চারাইজারের কোনও দরকারই নেই। তিলের তেল খুব হালকা। এটি ত্বককে নরম, মসৃণ এবং উজ্জ্বল করে তুলতে পারে। তিল তেলে রয়েছে লিনোলিক অ্যাসিড এবং ফ্যাটি অ্যাসিড যা সেরা প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজারগুলির মধ্যে একটি।
এছাড়া এক চামচ মধু, দু’চামচ গোলাপ জল, চার চামচ অ্যালোভেরা জেল, ভিটামিন ই ক্যাপসুল দুটো মিশিয়ে বোতলে ভরে ফ্রিজে রাখুন, এটাই ঘরোয়া ময়েশ্চারাইজার বা লোশন হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। এই মিশ্রণ সবসময় সাতদিনের তৈরি করবেন।
ঘরোয়া ফেস সিরাম
এছাড়া ঘরোয়া উপায়ে চটজলদি মুখে ঔজ্জল্য আনতে জবা ফুলের গুঁড়োর সঙ্গে দু’ফোঁটা তিল তেল মিশিয়ে ফেস সিরাম হিসাবে ব্যবহার করুন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাবেন চকচকে ত্বক।
যাঁদের মিশ্র ত্বক অর্থাৎ টিজোন তৈলাক্ত, দু’গাল শুষ্ক, রুক্ষ। গাজরের রস নিন দুই চামচ, ওর মধ্যে তিন ফোঁটা লেমন এসেন্সিয়াল অয়েল এবং দু’ফোঁটা রোজ এসেন্সিয়াল অয়েল দিন, সবটা ভাল করে মিশিয়ে দিনে অন্তত দু’বার মুখ ধোয়ার পর ব্যবহার করুন।
২ চামচ অ্যালোভেরা জেল, ২ চামচ গোলাপ জল ও ২টি ভিটামিন-ই ক্যাপসুল নিন। এবার একটি পাত্রে অ্যালোভেরা জেল, গোলাপ জল ও ভিটামিন-ই ক্যাপসুল ভালভাবে মিশিয়ে নিন। কোনও বোতল বা কন্টেনারে এই ফেস সিরাম রাখতে পারেন।
ঘরোয়া মাস্ক
কলা একটু বেশিদিন থাকলে কালো হয়ে যায়। খাওয়া যায় না। তাই ফেলে না দিয়ে চটকে পেস্ট করে নিন, এর সঙ্গে মেশান এক টেবিল চামচ মধু। দু-ফোঁটা লেবুর রস দিয়ে দিন। মুখে লাগিয়ে ১৫ মিনিট পর্যন্ত রেখে ভাল করে ধুয়ে ফেলুন, উপকার মিলবে।
বাড়িতে অ্যালোভেরার গাছ থাকলে মুখে সেই অ্যালোভেরা জেল লাগিয়ে শুকোনো পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তারপর ঠান্ডা জলে ধুয়ে নিন। এই সময় ত্বক খুব সতেজ থাকবে।
সাধারণ পাতিলেবুর রস, গোলাপজল আর গ্লিসারিন সমান পরিমাণে মিশিয়ে মুখে লাগান। ৩০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলবেন। এই সময় অনেকের ব্রণ হয়, ফুসকুড়ি হয়, এই প্যাক সেগুলো কমিয়ে ত্বক সুস্থ করবে।
ঘরোয়া সানস্ক্রিন
বিশেষজ্ঞদের মতে ৩০ এসপিএফ ত্বকের জন্য আদর্শ। জিঙ্ক অক্সাইড দু’চামচ, নারকেল তেল ১/৪ কাপ, অ্যালোভেরা জেল ১/৪ কাপ, ইউক্যালিপ্টাস অয়েল ২০ ফোঁটা। জিঙ্ক অক্সাইড আর অ্যালোভেরা জেল বাদে তেলগুলো মিশিয়ে নিন। হালকা আঁচে বসিয়ে নাড়ুন, মিশ্রণটা পাতলা মসৃণ হতে হবে। এবার ঠান্ডা করে অ্যালোভেরা জেল মেশান এবং সবশেষে জিঙ্ক অক্সাইড দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে নেড়ে নিন। ঠান্ডা করে ফ্রিজে রাখুন। এটা ব্যবহার করুন সানস্ক্রিন হিসেবে।
চুলের যত্নে
এতদিন শীতের অন্যতম সমস্যা ছিল মাথার মৃত কোষ বা খুশকি আর রুক্ষ নিষ্প্রভ হয়ে যাওয়া আনম্যানেজেবল চুল। কারও কারও সিজন চেঞ্জে চুল পড়তে শুরু করে। এবার শীত কাটিয়ে বসন্ত এসে পড়েছে, আর কিছুদিনেই তেড়ে গরম পড়তে শুরু করবে তা সত্ত্বেও এই সমস্যা কমবেশি রয়ে গেছেই বরং আমাদের চুল এখন আরও বেশি হাতের বাইরে। কিন্তু শীতের সামগ্রী এখন আর চলবে না তাই খুশকির মোকাবিলা করতে সপ্তাহে একদিন হেনা করলে ভাল ফল পাবেন। হেনা করার সময় হেনার মিশ্রণে একটা ডিম ফেটিয়ে দিন আর এক চামচ নারকেল তেল মেশান, এতে চুলের হাল ফিরবে। ড্রাইনেস যাবে, খুশকি কমবে।
মাথার ত্বককে সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার শ্যাম্পু দিন। বাড়িতেই বানিয়ে নিন ভাল শ্যাম্পু।
ঘরোয়া শ্যাম্পু
দেড় কাপ জলে দুটো টি-ব্যাগ দিয়ে ১০ মিনিট ফুটিয়ে নিন। তারপর টি-ব্যাগ তুলে ওর মধ্যে একটা ভাল গায়ে মাখার সাবানের কয়েকটি টুকরো দিয়ে দিন সাবানটা গলে গেলে দু’বড় চামচ গ্লিসারিন মিশিয়ে একটি বোতলে ভরে পরে প্রয়োজনমতো ব্যবহার করুন।
রিঠা সারা রাত ভিজিয়ে রেখে তার জলটাও শ্যাম্পুর বিকল্প হিসেবে দারুণ ভাল।
ঘরোয়া হেয়ার স্পা
একটা স্পা ট্রিটমেন্ট করে নিন, এর জন্য পার্লারে যাওয়ার দরকার নেই। শ্যাম্পু করার ঘণ্টা দেড়েক আগে দু’চামচ হেনা পাউডার, দু’চামচ আমলকী পাউডার এবং দু’চামচ রিঠা পাউডার ভাল করে হালকা গরম জলে মেশান, ওর মধ্যে এক চামচ লেবুর রস মিশিয়ে নিন। একটা পেস্ট করে মাথার স্ক্যাল্প এবং চুলে দু’-তিন মিনিট ম্যাসাজ করুন। এবার আধঘণ্টা ওইভাবে রাখুন তারপর সামান্য গরম জলে তোয়ালে ডুবিয়ে, জল ঝরিয়ে মিনিট দশেক মাথায় জড়িয়ে রাখুন। এবার মাথা ধুয়ে নিন। সবশেষে একটি স্প্রে বোতলে চায়ের লিকার মেশানো জল স্প্রে করুন। এটা দারুণ ঘরোয়া স্পা আর এই পদ্ধতিতে খুশকিও দুর হবে।
ঘরোয়া সিরাম
জোজোবা অয়েল ও পাঁচ ফোঁটা রোজমেরি অয়েল মিশিয়ে ভাল করে মিশিয়ে নিন। তৈরি আপনার হোমমেড হেয়ার সিরাম। এবার প্রতিবার শ্যাম্পু করার পরে চুলে এবং স্ক্যাল্পে এই সিরাম লাগিয়ে নিন। এতেই চুল থাকবে সতেজ সুন্দর।
আরও পড়ুন- রাজ্যসভায় বিশিষ্ট লেখিকা সুধা মূর্তি, মনোনয়ন রাষ্ট্রপতির
হাত-পায়ের যত্ন
শীতকাল হোক বা সিজন চেঞ্জ, হাত-পায়ের সমস্যা বিশেষ বদলায় না। পা ফাটতেই থাকে, হাতে সাদা খড়ি ফোটে, চামড়া একটু শিথিল লাগে, বয়সের ছাপ প্রকট হয় আবার পাশাপাশি পায়ে কালচে ছোপ পড়ে যায়।
এই সময় হাত-পায়ের দৈন্যদশা দুর করতে এক চামচ অ্যালোভেরার রস, তিন টেবিল চামচ শসার রস মিশিয়ে হাতে পায়ে লাগিয়ে নিন স্নানের আগে। দশ মিনিট ওইভাবেই রেখে দিন। তারপর একটু ম্যাসাজ করে ধুয়ে ফেলুন।
হাত-পায়ের চামড়ার টানটান ভাব লাবণ্য ফিরিয়ে আনতে দুই টেবিল চামচ বেসন, এক চা-চামচ হলুদ গুঁড়ো, দুই টেবিল চামচ কাঁচা দুধ বা গোলাপজল এবং কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে ঘন পেস্ট তৈরি করে হাত ও পায়ে লাগিয়ে ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।
একদম সময় নেই তাহলে স্নানের আগে হাত ও পায়ে টকদই ম্যাসাজ করুন। পাঁচ থেকে সাত মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। সঙ্গে একটু লেবুর রস দিতে পারেন।
ঘরোয়া ম্যানিকিওর পেডিকিওর
পেডিকিওর করতে অনেক খরচ। কিন্তু সিজন চেঞ্জ হোক বা অন্য ঋতু, বাড়িতেই যদি একেবারেই নিখরচায় পেডিকিওর করা যায় তাহলে আর চিন্তা কী!
লাগবে শুধু নেইল কাটার, দাঁতমাজার ব্রাশ, পোড়ামাটির ঝামা, তুলো, তোয়ালে। প্রথমে হাত-পায়ের নখের নেলপলিশ তুলে নিন। এরপর কুসুম-গরম জল নিয়ে একটা বড় গামলায় সামান্য শ্যাম্পু ওতে দিয়ে হাত-পা ভিজিয়ে রাখুন ১০ মিনিট। তারপর ব্রাশ দিয়ে নখের চারপাশের ময়লা ও চামড়া পরিষ্কার করে নিন। এরপর ঝামা দিয়ে পায়ের গোড়ালির ঘষে ফাটাচামড়া তুলে নিন।
নিজের নখ কেটে নিন আর নখের ভেতরের ময়লা পরিষ্কার করে নখের মাথা ঘষে ফাইল করুন।
সবশেষে মুলতানি মাটি, মধু আর গোলাপজল মিশিয়ে হাত-পায়ে লাগিয়ে দশ মিনিট রেখে শুকিয়ে গেলে জলে ধুয়ে নিন। একটা হালকা লোশন লাগিয়ে— ব্যস! দেখুন হাত-পা কেমন চমকদার হয়ে উঠেছে।
ঠোঁটের যত্ন
এইসময় ঠোঁটে টান ধরে, শুষ্ক, রুক্ষ, নিষ্প্রভ, ফুটিফাটা হয়ে থাকে। তাই শোয়ার আগে সামান্য মধু লাগিয়ে ঘুমোতে যান।
খরখরে ফাটা ঠোঁটে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে চিনি ও মধুর জুড়ি মেলা ভার। লিপবাম আপনার ঠোঁটকে আপেক্ষিকভাবে রক্ষা করলেও দিনের শেষে তা বিশেষ কাজে আসে না। কিন্তু চিনি দিয়ে স্ক্রাবিং করলে ঠোঁটের কালচে দাগ দূর হওয়ার পাশাপাশি মরা চামড়াও দূর হবে।
চিনি দিয়ে এক্সফলিয়েট করার পর তাজা অ্যালোভেরার জেল হাতে নিয়ে ঠোঁটে মালিশ করুন। শুকিয়ে এলে তা ধুয়ে ফেলুন। নিয়মিত ব্যবহারে ঠোঁট কোমল ও মসৃণ হবে।
নারকেল তেল যে কোনও সংক্রমণ কমায়, ছোপ তুলে দেয় এবং ত্বক কোমল ও মসৃণ রাখে। প্রতিদিন রাতে শোয়ার আগে সামান্য পরিমাণে নারকেল তেল ঠোঁটে মালিশ করুন।