সর্বম অত্যন্ত গর্হিতম…
অনিদ্রা এবং অতিনিদ্রা, এই দুটিই শরীর এবং মনের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক। ভাগবত গীতায় তো বলেইছে, ‘তমস্ত্বজ্ঞানজং বিদ্ধি মোহনং সর্বদেহিনাম। প্রমাদালস্য নিদ্রাভিস্তন্নিবধ্নাতি ভারত।।’ অর্থাৎ, সকল দেহাভিমানীর মোহকারক হল তমোগুণ যা জীবাত্মাকে প্রমাদ, আলস্য আর নিদ্রার দ্বারা বন্ধন করে। অনিদ্রা বা অতিনিদ্রা যেমন শরীরে নানা ধরনের রোগের জন্ম দেয়, তেমনিই অনিদ্রা বা অতিনিদ্রা নির্দিষ্ট শারীরিক সমস্যা বা রোগ থেকেই তৈরি হয়। প্রথমে আলোচনা করি অনিদ্রা নিয়ে। ভারতে প্রায় এক কোটির উপর মানুষ প্রতি বছর অনিদ্রা রোগে আক্রান্ত হন।
আরও পড়ুন-নারী-প্রগতির জয়ধ্বজার বাহক তৃণমূল কংগ্রেস
অনিদ্রা (Insomnia)
উপযুক্ত ঘুমের পরিবেশ এবং সময় থাকা সত্ত্বেও, কিছুতেই ঘুম না আসা, ঘুম এলেও ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হওয়া বা খুব অল্প সময় পরেই ঘুম সম্পূর্ণ ভেঙে যাওয়া, ঘুম থেকে ওঠার পরেও একটা ক্লান্তি ভাব সারাদিন ধরে থেকে যাওয়া, এই বিভিন্ন অবস্থাগুলোকে সমষ্টিগতভাবে অনিদ্রা বলা যায়।
অনিদ্রার আবার কিছু প্রকারভেদ আছে—
প্রাথমিক (Primary) অনিদ্রা— এখানে অনিদ্রার পিছনে কোনও অন্য শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা যুক্ত নেই।
আনুষঙ্গিক (Secondary) অনিদ্রা— অন্য কোনও রোগ যেমন, যন্ত্রণা, অ্যাসিডিটি, অবসাদ, শ্বাসকষ্ট, পেটব্যথা, মাথাব্যথা, প্রস্টেটের রোগ, কিছু ওষুধের প্রভাব, রাত্রিকালীন শিফটে কাজ করার ফল, ইত্যাদি কারণে রাত্রে ঘুম ঠিক হয় না।
আবার অনিদ্রাকে নিম্নলিখিতভাবেও শ্রেণিবিভাগ করা যায়—
ক্ষণস্থায়ী (Acute) অনিদ্রা— কোনও বিশেষ স্ট্রেস বা অসুখের কারণে অনিদ্রার সমস্যা হলেও কিছুদিনের মধ্যেই সেটা ঠিক হয়ে যায়। এটা, জেট ল্যাগ, সাময়িক ব্যথা, যন্ত্রণা, মানসিক আঘাত, সাময়িক উত্তেজনা থেকে হতে পারে।
দীর্ঘস্থায়ী (Chronic) অনিদ্রা— দীর্ঘদিন ধরে (টানা তিন মাসের বেশি) যখন কেউ অনিদ্রায় ভোগে এবং প্রত্যেক সপ্তাহের প্রায় তিন থেকে চারদিন বা তারও বেশি, রাত্রে ঘুমের সমস্যা হয়। স্লিপ অ্যাপনিয়া, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, হার্ট বার্ন, সাবস্ট্যান্স অ্যাবিউজ, হার্টের রোগ ইত্যাদি কারণে এটা হতে পারে।
শুরুর সময়ের (Onset) অনিদ্রা— ঘুম আসতে দেরি হয়, কিন্তু, একবার ঘুমিয়ে পড়লে আর বেশি অসুবিধা হয় না। ঘুমোতে যাওয়ার কিছু আগে চা-কফি বা অন্য উত্তেজক কিছু খেলে, বেশি মোবাইল বা কম্পিউটার সার্ফ করলে বা মানসিক উত্তেজনা, দিনের বেলা বেশি ঘুমানোর কারণে এটা হতে পারে।
সর্বাত্মক (Maintenance) অনিদ্রা— সমগ্র রাত ধরেই যখন ঘুম আসে না। মানসিক বা শারীরিক রোগ থেকে এমন হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গেই ঘুমের সারকাডিয়ান রিদম বা দৈনিক ছন্দ নষ্ট হতে থাকে। বার্ধক্যের একাকীত্ব অনিদ্রার একটা বড় কারণ।
শিশুদের স্বভাবগত অনিদ্রা— শিশুরা সহজে শুতে যেতে বা ঘুমাতে চায় না। ওদের গল্প বলে, খেলাধুলা, শারীরিক কসরত, শোয়ার নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি করে, কিছুটা শাসনের মাধ্যমে ঘুম পাড়াতে হয়।
আরও পড়ুন-বাংলার মহিলাদের আর্থিক নিরাপত্তা, পাশে আছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প
অনিদ্রার ক্ষতিকর প্রভাব—
উদ্বেগ, অবসাদ উচ্চরক্তচাপ তড়কা হার্ট ডিজিজ হাঁপানি ডায়াবেটিস ওজন হ্রাস অ্যাসিডিটি গাড়ি চালানোর সময়ে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বৃদ্ধি কাজে উদ্দ্যমের অভাব স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক শারীরিক মিলনের উদ্দীপনা হ্রাস স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া
অনিদ্রা থেকে মুক্তির উপায়—
জীবনশৈলীর পরিবর্তন— নিয়মিত কাজের মধ্যে থাকা, কিছুটা হলেও শরীরের ব্যায়াম হয় এমন কাজে নিযুক্ত থাকা, নিদেনপক্ষে তিরিশ মিনিট অন্তত হাঁটা। সুষম আহার করা, অতিরিক্ত তেল-মশলা যুক্ত, ঝাল, খাবার কম খাওয়া উচিত। নৈশাহারে একেবারে পেট ভর্তি করে প্রচুর খেয়ে নেওয়া উচিত নয়। পরিমাণমতো জল খাওয়া উচিত, তবে শুতে যাওয়ার আগে প্রচুর জল খেলে ঘুমের অসুবিধা হতে পারে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে স্নান বেশ উপযোগী, বিশেষ করে গরমের সময়ে।
মেডিটেশন ঘরের পরিবেশ ঘুমের উপযুক্ত করে তোলা উচিত শোয়ার আগে মোবাইল ঘাটা, টিভি দেখা, উচ্চগ্রামে গান শোনা, ঝগড়া বা অন্য কোনও উত্তেজনামূলক বিষয়ে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে চাকরি থেকে অবসরের পরে বা একা থাকলে, বিকেলে কিছু সময়ে প্রতিবেশী বা এলাকার সমবয়সি মানুষের সঙ্গে আড্ডা, মাঠে, পার্কে হাঁটা, গল্পের বই পড়া, সামাজিক কাজের সঙ্গে জুড়ে থাকা, একাই কোথাও কয়েকদিন ঘুরে আসা কোনও গ্রুপের সঙ্গে। এগুলো করলে, রাত্রে সহজেই ঘুম আসে। ডায়াবেটিসের সঠিক এবং নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে অনিদ্রা দূরে রাখা যায়
বিহেভিয়ারাল থেরাপি, কাউন্সেলিং ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রেই অনিদ্রার চিকিৎসায় উপযোগী যে সমস্ত কাজে আনন্দ পাওয়া যায়, নিজের হবিগুলোয় নিজেকে ব্যস্ত রাখা যখন অন্যান্য প্রক্রিয়ায় কাজ হয় না, কিছু অবসাদ বা উদ্বেগ কাটানোর ওষুধ, মেলাটোনিন জাতীয় ওষুধ শেষ অবধি ব্যবহার করতে হয় আকুপাংচার কিছু ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে অ্যারোমাথেরাপি: কিছু সুগন্ধী তেল দিয়ে মালিশ বা কপালে নাকে ব্যবহার করে খুব ভাল ঘুম হয়, যেমন, ল্যাভেন্ডার, সিডারউড, স্যান্ডালউড, নেরোলি, ক্যামোমিলে ইত্যাদি।
অতিনিদ্রা (Hypersomnia)
রাত্রে যথেষ্ট এবং নিরবচ্ছিন্ন (টানা আট ঘণ্টা) ঘুমানো সত্ত্বেও যদি দিনের বেলা ঘুমে চোখ জুড়ে আসে, তাকে অতিনিদ্রা বলে।
অতিনিদ্রা মেয়েদের মধ্যে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। জনসংখ্যার ৫% এই রোগে আক্রান্ত। গড়ে ১৭ থেকে ২৪ বছর বয়সের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়।
আরও পড়ুন-সাত দফার চক্রান্ত জবাব দেবে বাংলা
কী ঘটে?—
১০ ঘণ্টার বেশি ঘুমানোর পরেও দিনের বেলা কেবল ঘুম পায়। ঘুম থেকে উঠতে খুব সমস্যা হয়, যাকে বলে স্লিপ ড্রাংকেননেস। ঘুম ভাঙলেও বিভ্রান্ত বা বিশৃঙ্খল থাকে বেশ কিছু সময়। দিনের বেলা হালকা ঘুমালেও মনোনিবেশে অসুবিধা বা সতর্ক থাকতে না পারা উদ্বেগ, বিরক্তির সৃষ্টি হওয়া। কর্মোদ্যম হ্রাস পায় অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে মাথা ধরা খিদে কমে যাওয়া দ্রুত চিন্তা করা বা উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। স্মৃতিশক্তির সমস্যা বোঝা যায়। হ্যালুসিনেশন বা ভুল দেখার সৃষ্টি হয়।
অতিনিদ্রার কারণ—
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর সঠিক কারণ জানতে পারা যায় না। ৩৯% ক্ষেত্রে তাদের বলা হয় ইডিওপ্যাথিক হাইপারসমনিয়া। এদের পারিবারেও অতিনিদ্রার ইতিহাস থাকে। যে সমস্ত স্নায়ু সংবাহককে এর কারণ মনে করা হয়, তারা হল, গাবা, সেরোটোনিন, ওরেক্সিন, ডোপামিন ইত্যাদি। এগুলোকে বলে প্রাথমিক বা প্রাইমারি হাইপারসমনিয়া।
নারকোলেপ্সি (Narcolepsy)—
এটি একটি প্রাথমিক হাইপারসমনিয়া যেখানে হাইপোক্রেটিন বা ওরেক্সিন নামের নিউরোট্রান্সমিটার কম নিঃসৃত হয়। সঙ্গে ক্যাটাপ্লেক্সি বা হঠাৎ করে মাংসপেশির দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
সেকেন্ডারি বা আনুষঙ্গিক হাইপারসমনিয়া—
হাইপোথাইরয়েড বা থাইরয়েড হরমোনের কম ক্ষরণের ফলেও অতিনিদ্রা হতে পারে। মানসিক অবসাদ অতিনিদ্রার একটি বড় কারণ। এপিলেপ্সি, পারকিনসন্স ডিজিজ, মালটিপল স্ক্লেরোসিস জাতীয় স্নায়ুর রোগে অতিনিদ্রা দেখা যায়। স্থূলতা, অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া এগুলোও অতিনিদ্রার কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত মদ, গাঁজা, কাফ রেমেডিজ, ঘুমের ওষুধ নিয়মিত নেশার মতো সেবন করলে অতিনিদ্রা হয়। পারকিনসনের ওষুধ, এপিলেপ্সির ওষুধ, নারকোটিক জাতীয় ব্যথার ওষুধ, ডেমেনসিয়া বা স্মৃতিভ্রংশের ওষুধ নিয়মিত সেবনে অতিনিদ্রার সমস্যা দেখা দেয়।
অতিনিদ্রার চিকিৎসা—
সঠিক ঘুমের অভ্যাস এবং পরিবেশ তৈরি করতে হবে। হাইপোথাইরয়েডের সঠিক চিকিৎসা করতে হবে। যে ওষুধগুলো ঘুমের কারণ সেগুলোর ডোজ ধীরে ধীরে বাড়ানো, কম ডোজে ব্যবহার করা বা সম্ভব হলে যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করে দেওয়া। নেশার দ্রব্য এবং ওষুধ থেকে নিজেকে দূরে রাখা, প্রয়োজনে পুনর্বাসন।
সাইকো-স্টিমুল্যান্ট মেডিসিন যেমন, অ্যাম্ফিটামিন, মিথাইলফেনিডেট, ফ্লুমাজেনিল ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।