২০১৪। মোদি প্রথমবার সংসদে পা রাখার আগে ভবনের সোপানেই সাষ্টাঙ্গ হলেন। বললেন, ‘গণতন্ত্রের মন্দির’। এই দৃশ্য ও অনুভবের প্রকাশ অভিনব। এর আগে বরাবর যুক্ত ছিলেন রাজ্য-রাজনীতিতে, তাও আবার হিন্দি বলয়ের বাইরে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিতর্কেরও কেন্দ্রে তখন তিনি। কংগ্রেস তথা ইউপিএর অভিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বিপরীতে বিজেপি যখন তাঁকেই বাজি রেখেছিল, সেটাও ছিল রীতিমতো চমক প্রদর্শন।
আরও পড়ুন-এবার ইডির জোড়া সমন পেলেন কেজরিওয়াল, ভোটের আগে হেনস্থার চক্রান্ত
সেই শুরু।
সামান্যতম ইঙ্গিত ছাড়াই ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করেছেন। করোনার মতো ভয়াবহ বিপদের সামনে যখন আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলি-সহ সারা দুনিয়া দিশেহারা, তখন মোদি ‘আবিষ্কার’ করলেন ‘থালা বাজানো’ দাওয়াই! বললেন, এতেই নাকি পালাবার পথ পাবে না করোনা!
২০১৫-এর ২৯ ডিসেম্বর। ‘দাওয়াত’ ছাড়াই উপস্থিত হলেন পাকিস্তানের তৎকালীন উজির-এ-আজম নওয়াজ শরিফের লাহোরের প্রাসাদে (সারপ্রাইজ স্টপওভার)। পাক প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ হন তাঁরা। সেই ছবি প্রচারিত হয় বিশ্বময়। উপমহাদেশের রাজনীতি-কূটনীতিতে এমনটা যে সম্ভব, চর্মচক্ষে দেখেও তা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। নিন্দুকেরা বলে, প্রত্যুত্তরে পাকিস্তান ফিরিয়েছে অবশ্য পুলওয়ামা।
বিভিন্ন মঞ্চে মোদির সঙ্গে জি জিনপিংয়ের মোলকাত হয়েছে অন্তত ২০ বার। মোদির আন্তরিক আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে চৈনিক প্রেসিডেন্ট পরিদর্শন করেছেন সবরমতী আশ্রম এবং মহাবলীপুরম মন্দির। দুই রাষ্ট্রনায়ক দোলনায় দুলেছেন। দোলনা-কূটনীতির ফাঁকে পূর্বনির্ধারিত সূচি ছাড়াই আলোচনা হয়েছে তাঁদের। মোদি নিজেও কয়েকবার চিন সফর করেছেন।
অতঃপর এই দুই ‘প্রিয়’ প্রতিবেশী মিলিতভাবে ‘উপহার’ দিয়েছে তালিবানের তাঁবে আফাগানিস্তান। কাবুলি ‘পুতুল’ পরে যদিও পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই হাত-পা ছুঁড়ছে বেশি, সেটা অবশ্য অন্য পাঠ। মোদি কখনও প্রেস মিট করেন না; সংসদে বিরোধীদের হাজারো প্রশ্নের সামনে স্পিকটি নট থাকেন; কিন্তু রেডিও, টিভিতে নিয়মিত শোনান ‘মন কি বাত’। তামাম ভারত চষে বেড়ান, এমনকী উত্তর-পূর্বে গিয়েও কেতা দেখান তিনি, তাঁর পা পড়ে না কেবল পোড়া মণিপুরে।
আরও পড়ুন-দিল্লিকে উড়িয়ে ট্রফি আরসিবির
২০২১ থেকে টার্গেট বাংলা। বিধানসভায় ২০০ পার করার হুঙ্কাকর শুনিয়ে রণদামামা ১০০-র অনেক আগেই থামাতে হয়েছিল গেরুয়া শিবিরকে। তবু যে ভবি ভুলবার নয়! এবার প্রথম টার্গেট দিলেন মোদির ডানহাত অমিত শাহ— ৪২-এ ৩৫। তারপরই চলে এসেছে হাতে গরম সন্দেশখালি ইস্যু। শিষ্যের কথায় কি নাখোশ হলেন মোদি? দিনকয়েক বাদে ‘দাবিপত্র’ পেশ করলেন, বাংলার বিয়াল্লিশটি আসনেই পদ্ম ফুটেছে দেখতে চান তিনি! অবশ্য এক বেসরকারি অনুষ্ঠানে শাহের গলাতেই শোনা গেল নরম সুর, তিনি নিজে যে টার্গেট দিয়েছিলেন তার চেয়েও নরম— ৪২-এ ২৫ আসন জয় দেখতে চান তিনি।
বিজেপির মতো পার্টিতে শীর্ষ নেতৃত্বের দিশার ভিতরে পরের পর এই বিভ্রান্তি— এও মারাত্মক গিমিক বইকি! বিজেপি চমক দেখাল, বাংলায় প্রার্থী-তালিকা ঘোষণা নিয়েও। মার্চ মাস পড়তে না পড়তেই দিল্লি থেকে ঘোষণা করা হল লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার তালিকা। তার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ২০টি কেন্দ্র। ঘটনার দিন মোদি বঙ্গদেশ সফরে ছিলেন। তিনি কলকাতা ছাড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেশবাসীকে শোনানো হল এই চমৎকার বার্তা। কিন্তু ঘোষণার ঘোর কাটতে লাগল না ২৪ ঘণ্টাও। প্রার্থী-তালিকার পবন সিং পরদিনই জানিয়ে দিলেন, ভোটের লড়াইয়ে তিনি নেই!
আরও পড়ুন-আজ অভিষেকের সভা গঙ্গারামপুরে
এখানেই শেষ নয়।
রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন মোদি একাধিক গ্যারান্টিকে সামনে রেখে। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য— বছরে ২ কোটি চাকরি এবং প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা প্রদান। বলেছিলেন, দুর্নীতি আর কালো টাকার শেষ হবে। দশ বছরে তাঁর সরকারই প্রমাণ করে দিয়েছে— দুটিই ‘জুমলা’। ওইসঙ্গে প্রকৃত যে গ্যারান্টি কার্যকর ছিল, সেটাকেই নস্যাৎ করল মোদি সরকার। তাতে গরিব মানুষের জীবিকা ও আয়ের সুযোগ ধ্বংস হল। গ্রামীণ অর্থনীতির মোড় ঘোরানোর ক্ষেত্রে ১০০ দিনের কাজের গ্যারান্টি (মনরেগা) স্কিম ছিল মরমি আবিষ্কার। কোভিডকালে ভারতীয় অর্থনীতি যখন শয্যাগত-প্রায়, তখনই কৃষি আর মনরেগা ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। আর সেই প্রকল্পটি নিয়েই মোদি সরকার এমন আচরণ করল যেন সেটি তাদের গলার কাঁটা।
বেকারত্ব বৃদ্ধির রেকর্ড এই জমানায় গত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। এজন্য মনরেগাকে তাচ্ছিল্য করার ভুল নীতিকেই দায়ী করেন অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের বহু পণ্ডিত। ভাবুন, মোদি যখন প্রধানমন্ত্রিত্বের ‘হ্যাটট্রিক’ করবেন ভেবে লাফাচ্ছেন, তখনই ভারতের যুবরা ইজরায়েল এবং ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে প্রাণ দিচ্ছেন। বিসর্জন যাচ্ছে তাঁদের বেকারত্ব ঘোচানোর স্বপ্ন। জনধন ও উজ্জ্বলা? গরিব মহিলাদের উপলব্ধি আধুনিক রূপকথার গল্প মাত্র। ক’জন ধনশালিনী হয়েছেন এবং মুখ উজ্জ্বল হয়েছে ক’জনের? সবই নিশ্চয় কথার কথা। মানে বলতে হয় তাই বলা। জুমলা। কথা যখন চলছে, তখন কিছু একটা না বললে কি তা চালু থাকে? এজন্য কিছু বলতেই হয়। সেজন্যই গ্যারান্টি পে গ্যারান্টি। মোদি এখন আর ‘গ্যারান্টি’তেই থেমে নেই, ‘গ্যারান্টিরও গ্যারান্টি’ দিচ্ছেন!
সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্য জনসভায় জানতে চেয়েছেন, মানুষ কী চায়? মোদির গ্যারান্টি না দিদির গ্যারান্টি? জন গর্জন সেই প্রশ্নের নিঃসংশয় জবাব দিয়েছে।
এবার ইভিএমে সেই উত্তরকে প্রতিষ্ঠিত করার পালা।
আসুন! জোড়া ফুলের জয় দিয়ে বুঝিয়ে দিই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কী চায়।
গিমিক আর গ্যারান্টির জুমলা নয়।
কথা দিয়ে কথা রাখার নিশ্চয়তা।