লোকশিক্ষা হবে
তিরিশে অগ্রহায়ণ কৃষ্ণা দ্বাদশী তিথি, ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর রবিবার শ্রীরামকৃষ্ণ বসে আছেন মঞ্চের সামনে। পাশে মাস্টার, বাবুরাম ও নারায়ণ। গিরিশও এসেছেন। কিন্তু অভিনয় এখনও শুরু হয়নি। ঠাকুর গিরিশের সঙ্গে কথা বলছেন—
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)— ‘বাঃ তুমি বেশ সব লিখছো।’
গিরিশ— ‘মহাশয়, ধারণা কই? শুধু লিখে গেছি।’
আরও পড়ুন-মৌলেদের রক্ষায় নদী, খাঁড়িতে বাড়তি নজরদারি
শ্রীরামকৃষ্ণ— ‘না, তোমার ধারণা আছে। সেইদিন তো তোমাকে বললাম। কী করে ভক্ত না থাকলে, চালচিত্র আঁকা যায় না। ধারণা চাই। কেশবের বাড়িতে নববৃন্দাবন নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। দেখলাম, একজন ডিপুটি ৮০০ টাকা মাহিনা পায়, সকলে বললে, খুব পণ্ডিত, কিন্তু একটা ছেলে লয়ে ব্যতিব্যস্ত! ছেলেটি কিসে ভাল জায়গায় বসবে, কিসে অভিনয় দেখতে পাবে, এইজন্য ব্যাকুল! এদিকে ঈশ্বরীয় কথা হচ্ছে তা শুনবে না, ছেলে কেবল জিজ্ঞাসা করছে, বাবা এটা কি, বাবা ওটা কি? — তিনিও ছেলে লয়ে ব্যতিব্যস্ত। কেবল বই পড়েছে মাত্র কিন্তু ধারণা হয় নাই।’
গিরিশ— ‘মনে হয়, থিয়েটারগুলো আর করা কেন।’
শ্রীরামকৃষ্ণ— ‘না না ও থাক, ওতে লোকশিক্ষা হবে।’
চৈতন্য হোক
এর আগে বাংলা থিয়েটারকে মূল স্রোতে নিয়ে এসেছেন স্বয়ং রামকৃষ্ণ। ওই বছরেই ২১ সেপ্টেম্বর, সেটাও ছিল রবিবার। স্টার থিয়েটারে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব সপার্ষদ গিরিশচন্দ্রের ‘চৈতন্যলীলা’ দেখতে গেছেন। থিয়েটার শুরু হল, ঠাকুর নাটক দেখতে দেখতে প্রায়ই ভাব সমাধিস্থ হয়ে পড়ছেন। থিয়েটার শেষের পরে ভক্তরা ঠাকুরকে নিয়ে গেলেন মঞ্চের পাশের অফিস ঘরে। এক ভক্ত জিজ্ঞেস করলেন, কেমন লাগল নাটক? ঠাকুর জবাব দিলেন— ‘আসল নকল সব এক হয়ে গেছে।’ একে একে সবাই ঠাকুরকে প্রণাম করতে এলেন। ‘চৈতন্যলীলার’ চৈতন্যরূপিণী নটী বিনোদিনী যখন এসে দাঁড়ালেন ঠাকুর তাঁর পায়ের উপর পড়তে যাচ্ছেন। ভক্তরা ঠাকুরকে ধরে ফেললেন। বিনোদিনী তাঁকে প্রণাম করতেই, ঠাকুর আশীর্বাদ করে বললেন— ‘মা তোর চৈতন্য হোক।’
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
গিরিশ থেকে অনির্বাণ
গিরিশ থেকে অনির্বাণ, বাংলা থিয়েটারের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বদল এসেছে বাঁকে বাঁকে। গিরিশের সময় অবশ্য ভদ্রঘরের মেয়েরা থিয়েটার পাড়ায় এসে অভিনয় করেননি। তখন সব অভিনেত্রীই আসতেন নিষিদ্ধপল্লি থেকে। সাধারণ রঙ্গমঞ্চে শুরুর দিকে ছেলেরাই মেয়েদের চরিত্রে অভিনয় করতেন। মধুসূদন দত্তের পরামর্শে বেঙ্গল থিয়েটারেই প্রথম অভিনেত্রীদের প্রবেশ ঘটে। পতিতালয় থেকে তুলে এনে অভিনয় করানো হয় রঙ্গালয়ে। সেদিন থেকেই ভদ্র শিক্ষিত সমাজ থিয়েটারের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দেয়। এমনকী থিয়েটারের অভিনেতারাও সমাজে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েছিলেন। শুধু তাই নয়, কেশবচন্দ্র সেনের ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকার ১২৮১ বঙ্গাব্দের ১ পৌষ সংখ্যায় লেখা হল : ‘যাত্রার পরিবর্তে নাটক অভিনীত হইতে দেখিয়া আমরা মনে করিয়াছিলাম যে এতদিনের পর বিশুদ্ধ আমোদ আস্বাদ করিবার উপায় হইল। কিন্তু সে আশায় ছাই পড়িল। বেশ্যাদ্বারা অভিনয় করাইলে, নাট্যমন্দির আর বিশুদ্ধ আমোদের স্থল রহিল না।’ শুধু কি তাই, ঠাকুরের খুব কাছের মানুষ রামচন্দ্র দত্ত ঠাকুরের সর্বক্ষণের সঙ্গী থাকলেও, থিয়েটারে যাননি, অশুচিতার ভয়ে। রাস্তার যে ফুটপাথে থিয়েটার আছে, সে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতেন না স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যিনি নারীর কল্যাণকর্মে সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তিনিও থিয়েটারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করলেন এই অপরাধের জন্য।
সমস্ত বিশ্ব একটি মঞ্চ
থিয়েটার চিরকালই বাঙালির জীবনে পারফরমিং আর্ট। যা বারে বারে ঋদ্ধ করেছে ব্যতিক্রমী চিন্তাকে। শিখিয়েছে জীবনে মূল্যবোধের দক্ষতা। তাই শেক্সপিয়র ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’ নাটকে অনায়াসে বলতে পেরেছেন— সমস্ত বিশ্ব একটি মঞ্চ এবং সমস্ত পুরুষ ও মহিলারা খেলোয়াড়। থিয়েটার জীবন উদযাপনের এমন এক ফর্ম বা প্ল্যাটফর্ম যা মানুষকে বিকশিত করে। সৃজনশীলতার পথ দেখায়। তৈরি করে আত্মবিশ্বাস। ভিড়ের মুখে দাঁড়িয়ে মঞ্চের চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। অনায়াসে ভেঙে দেয় সব ভয়-ভীতি! ব্যক্তিগত ভাবে এবং পেশাগত ভাবে থিয়েটার সামাজিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। পথ দেখায় সামাজিক উত্তরণের।
কার্যকরী যোগাযোগকে প্রশ্রয় দেয় মঞ্চ বা থিয়েটার। মৌখিক এবং অমৌখিক যোগাযোগের মাধ্যমে তৈরি করে ভারসাম্যের ক্যানভাস। শ্রোতার সামনে পরিষ্কার উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি এবং নিজেকে প্রকাশ করার শৈলী তৈরি করে। সৃজনশীলতা এবং সচেতনতা বাড়াতে থিয়েটারের কোনও বিকল্প নেই। ইম্প্রোভাইজেশন করার দক্ষতা নীরবে শিখিয়ে দেয় প্রতিটি মঞ্চ। শৃঙ্খলা তৈরিতে থিয়েটারের কোনও বিকল্প মাত্র নেই। এই কারণেই ঠাকুর রামকৃষ্ণের লোকশিক্ষার ভাবনা সত্যি হয়ে উঠেছে থিয়েটারের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন-চন্দ্রনাথের বাড়িতে ইডি, নেত্রীর ফোন
পথেই হবে পথ চেনা
ব্রিটিশের হাত ধরে প্রয়োজনের তাগিদে এই দেশে থিয়েটারের চর্চা শুরু হয়। ব্রিটিশ সৈন্য ও নাগরিকদের মনোরঞ্জনের জন্য থিয়েটারের মডেল শুরু হয় বোম্বে, কলকাতা ও মাদ্রাজে। কিছুদিনের মধ্যেই অর্থাৎ উনিশ শতকের শুরুতেই থিয়েটার পৌঁছে যায় দক্ষিণে। নিজস্বতার ছাপ রাখে তামিল এবং মালয়ালম থিয়েটার। স্বাধীনতার পরে অবশ্য থিয়েটার প্রভাবিত হয়েছিল পাশ্চাত্য সাহিত্য, জাতীয়তাবাদ এবং গৌরবময় ভারতবর্ষ নিয়ে। ১৯৫৩ সালের জানুয়ারিতে তৈরি হয় সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি। ঠিক তার ছয় বছর পরে তৈরি করা হয় ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা।
স্বাধীনতার পরে থিয়েটারের চেনা ছক ভেঙে দেয় বিজয় তেন্ডুলকরের মারাঠি নাটক ঘাসিরাম কোতোয়াল।
বি ভি করান্থ, আবিভ তানভীর, বংশী কৌল, রতন থিয়াম এবং ফিরোজ খানের মতো পরিচালকেরা আধুনিক থিয়েটারের ভাষা বদলে দেন। আবার চলচ্চিত্রের আঙিনা থেকে মঞ্চের দুনিয়ায় সাবলীল যাতায়াত করেছেন গিরিশ কারনাড, অমল পালেকর, নাসিরুদ্দিন শাহ, জয়া বচ্চন, সতীশ কৌশিক, ফারুক শেখ এবং শাবানা আজমি। ভারতে লোকশিক্ষার এই মাধ্যমে প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে দুর্নীতি, দারিদ্র, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, নিম্নবৈষম্য, বর্ণবৈষম্য, গার্হস্থ্য হিংসা প্রভৃতি বিষয়গুলি। গ্রামীণ ভারতে প্রধান গণমাধ্যম থিয়েটার। সচেতনতা তৈরি করতে অবশ্য স্ট্রিট থিয়েটারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যাপ্লায়েড থিয়েটার
বিশ্ব জুড়ে থিয়েটার নিয়ে নানা পরীক্ষামূলক কাজ চলছে। প্রতি মুহূর্তেই বদলে যাচ্ছে ফর্ম ও ফরম্যাট। অগ্যস্ত বোয়াল নানারকম ব্যতিক্রমী থিয়েটার নিয়ে কাজ করছেন। অ্যাপ্লায়েড থিয়েটারের খোঁজ যাঁরা রাখেন তাঁরা জানেন, নিউজ পেপার থিয়েটার, ইমেজ থিয়েটার, ফোরাম থিয়েটার, ইনভিজিবল থিয়েটার, লেজিসলেটিভ থিয়েটারের কথা। প্রত্যেকটিই থিয়েটারকে একটি শক্তিশালী যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরেছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ভাবনায় পথ দেখাল গোয়েলের ইনভিজিবল থিয়েটার।
আরও পড়ুন-মুস্তাফিজের দাপটে চেন্নাই দুর্গ অক্ষত
বিশ্ব থিয়েটার দিবস
বিশ্ব থিয়েটার দিবস উদযাপনের জন্য ২৭ মার্চ দিনটিকে বেছে নেওয়া হল আন্তর্জাতিক থিয়েটার কমিটি এবং আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধানে। উদযাপন শুরু হল ১৯৬১ সালের ২৭ মার্চ। আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের ফিনিশ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ আর ভি কিভিমায় বিশ্ব থিয়েটার দিবস উদযাপনের প্রস্তাব দেন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলি সম্মতি দেওয়ার পরেই বিশ্ব জুড়ে শুরু হয় থিয়েটার দিবসের উদযাপন।
থিয়েটার শুধুমাত্র শিল্পমাধ্যম নয়, শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে নিজেকে তুলে ধরল। বিশ্ব নাট্যসাহিত্যের সূচক হয়ে উঠল ইসকাইলাসের ‘প্রমিথিউস বাউন্ড’, সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’, ভবভূতির ‘স্বপ্নবাসবদত্তা’, কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’, শেক্সপিয়র-এর ‘হ্যামলেট’, গেটের ‘ফাউস্ত’, ইবসেনের ‘ডলস হাউস’, স্ট্রিন্ডবার্গের ‘রিপ্লে’, জন বার্নার্ড শ-এর ‘ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান’, চেখভের ‘দি চেরি অরচাড’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘দি লোয়ার ডেপথ’ ইত্যাদি।
পারদিওয়েজ-এর ড্রামা থেরাপি
ব্রাজিলের বিখ্যাত মনোবিদ ড. রিতোর পরদিওয়েজ থিয়েটার নিয়ে এক ভিন্ন ভাবনার কথা ছড়িয়ে দিলেন গোটা পৃথিবীতে। তাঁর বিশ্বাস, ওষুধ ছাড়াও সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে দিয়ে মানসিক রোগের চিকিৎসা করা যায়। তাঁর বিশ্বাস থিয়েটারের মধ্যে দিয়েই মানুষ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে আত্মসচেতন। মুক্তি পেতে পারে হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকে। দীর্ঘদিন ধরে নিজ দ্য সিলভিরা মেন্টল হেলথ ইনস্টিটিউট-এর রোগীদের থিয়েটারে অভিনয় করানোর মধ্যে দিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসছেন। তাঁরই নির্দেশনায় সমুদ্রের তীরে মানসিক রোগীরা শেক্সপিয়র-এর ম্যাকবেথ নাটকে অভিনয় করেছেন, সঙ্গী শুধু আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ও ঢোল-তবলা। শেক্সপিয়র ছাড়াও মানসিক রোগীদের সিরিয়া, ফিলিস্তিন এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তৈরি নাটকে অভিনয় করিয়েছেন।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
পারদিওয়েজের ড্রামা থেরাপিতে রোগীরা তাঁদের আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশ করতে পারে। অভিনয়-দৃশ্য পাঠ করে নিজেদের অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা করতে পারে। অন্যদের সাথে মত-বিনিময়ের সময় কীভাবে ভাব প্রকাশ করতে হবে তার শিক্ষা নিতে পারে। যাঁরা সিজোফ্রেনিয়া, ক্রনিক সাইকোসিস এবং হতাশায় ভোগেন থিয়েটারই পারে তার থেকে মুক্তি দিতে। একসময় পারদিওয়েজের হাসপাতালে কিছু রোগী আসতেন যাঁরা ভাল করে কথা বলতে পারতেন না। কিন্ত দীর্ঘমেয়াদি থিয়েটার চর্চা করার পর তাঁরা সাবলীল ও স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন, গান গাইতে পারেন।
পালমেরো-র ড্রামা থেরাপি
লিওনার্দো পালমেরো ড্রামা থেরাপিকে মানসিক রোগ নিবারণে পরিপূরক পদ্ধতি হিসেবে দেখেছেন। তাঁর বিশ্বাস এই মাধ্যমকে একমাত্র পথ মনে না করা উচিত। ওষুধ, কাউন্সেলিং ও অন্যান্য আরও পথের সঙ্গে থিয়েটারও একটি পথ। মানসিক রোগীকে থিয়েটারের মাধ্যমে চিকিৎসা করানোর ধারণা প্রথম আবিষ্কার করেন নাট্যকর্মী ও পরিচালক অগাস্ট বোওয়াল। ১৯৫০ সালে তিনি এ-নিয়ে কাজ শুরু করেন ব্রাজিলে। এ-ছাড়া মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য ১৯২০ সালে ওসোরিও সিজার চিত্রশিল্পকে ‘থেরাপি’ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ক্রমে এটি জার্মানি, লন্ডন, স্কটল্যান্ডেও জনপ্রিয়তা পায়।
থিয়েটার অফ স্পন্টিনিউটি
জীবনের নাট্যমঞ্চে প্রত্যেকেই ইম্প্রোভাইজিং অ্যাক্টর এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী মোরিনো ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনার অভিনয় শিল্পীদের করুণ পরিণতি থেকে মুক্তি দিতে তৈরি করেছিলেন এক নতুন ঘরানা, ব্যতিক্রমী কাঠামো। যার মধ্যে দিয়ে এমন এক থিয়েটারের বিকাশ ঘটবে, যাতে গুরুত্ব পাবে সৃজনশীলতা, তৈরি হবে এক নিবিড় যোগাযোগ। বিকাশ ঘটবে থিয়েটার অফ স্পন্টিনিউটি ঘরানার। এই ঘরানাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ১৯২২ সালে ভিয়েনাতে গড়ে তোলেন থিয়েটার অফ স্পন্টিনিউটি। থিয়েটারকে দেন স্ক্রিপ্ট থেকে মুক্তি। ইম্প্রোভাইজেশন থিয়েটার বদলে যায় থিয়েটার অফ থেরাপিতে। যার অন্য নাম সাইকো ড্রামা। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে মোরিনো যখন ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনা মেডিক্যাল স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন; তখন সেখানে অধ্যাপনা করতেন সিগমন্ড ফ্রয়েড। এ-সময় ফ্রয়েড তাঁর সাইকো-অ্যানালাইসিস বা মনোবিশ্লেষণ তত্ত্বের বিকাশ ঘটাতে পেয়েছিলেন কিছু মানুষকে, যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মোরিনো। কিন্তু মোরিনো পরবর্তীকালে ফ্রয়েডের অনুসারী না হয়ে; বিপ্লবীর মতো ফ্রয়েডকে প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘‘ড. ফ্রয়েড, আপনার যেখানে সমাপ্তি আমার সেখানে শুরু। আপনি মানুষের স্বপ্ন বিশ্লেষণ করেন; আর আমি তাঁদের পুনরায় স্বপ্ন দেখাতে উৎসাহিত করি; শেখাই কীভাবে নিজেই নিজের স্রষ্টা হতে হয়। আপনি মানুষের সঙ্গে মেশেন আপনার অফিসে একটি কৃত্রিম পরিবেশে। আর আমি মেলামেশা করি তাঁদের বাড়িতে, রাস্তায়— সর্বোপরি প্রকৃতির সংস্রবে।’’
আরও পড়ুন-মৌলেদের রক্ষায় নদী, খাঁড়িতে বাড়তি নজরদারি
দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাবী কাল
একাকিত্বের সমস্যায় থিয়েটার বিকল্প পথ হয়ে ওঠে। মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বাস করেন— ‘কারও যদি সমস্যাটাই হয় একাকিত্বের, তা হলে তিনি কোনও থিয়েটার গ্রুপে যোগ দিলে সেটাই তাঁর সমস্যার ওষুধ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু যদি তাঁর আরও কিছু গভীর সমস্যা থেকে থাকে, কোনও অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব, উদ্বেগ, অবসাদ থেকে থাকে, তা হলে কোনও নাটকের দলে যোগ দিলে তাঁর সাময়িক একটা মুক্তি হতে পারে। কিন্তু তিনি যখন আবার নিজের কাজে ফিরে যাবেন, তাঁর ফের সেই চিন্তাগুলো উঠে আসবে। সেক্ষেত্রে থেরাপি নিজের সঙ্গে একটি সংলাপে নিযুক্ত হতে শেখায়।’
অবসাদ থেকে জন্ম নেয় অসহায়তা। অসহায়তা থেকে বেড়ে ওঠে নীরবতা। মরা মনগুলো নিস্তব্ধতা উদযাপন করে। তখন ‘বুক ঝিম এক ভালোবাসা’য় চাঁদ সুলতানা আর মনসুরকে ভেসে যেতে দেখে বাঁধ ভাঙে— ‘পানি যায়, ভেসে যায়, দূরে যায় দরিয়ায়।’ আলো নিভে যায়। চুপ করে বসে থাকেন সুলতানা আর মনসুর। আরামের এই মুহূর্তই বলে দেয় থিয়েটার থেরাপিস্ট নয়, অবসাদের ওষুধ নয়। তবুও এক পথ হয়ে ওঠে। যা যুগ যুগ ধরে যোগাযোগ স্থাপন করে চলছে সকলের সঙ্গে সকলের— ‘মানুষটা পড়েই থাকবে?
নাকি সে ধড়মড় উঠে গা থেকে জড়ানো
ওই লৌহসর্প খুলে বাঁকিয়ে আবার গড়বে রূপ, মূর্তি, ছন্দ, বাঁক?
ধরবে? সে অদৃষ্টপূর্ব গতি আর পথ?
কী হবে জানি না,
শুধু আমরা দূর থেকে দেখছি,
জানলা দিয়ে আলো আসছে,
খসখস পেন্সিল চলছে
আর জানলার বাইরে রাত জেগে লেখা নিতে এসে
একা দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাবী কাল।’