২০১৫ সালে দেশ জুড়ে আলোড়ন তুলেছিল একটি ঘটনা। নিজের মেয়ে শিনা বরাকে হত্যার অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়। তিনি আইএনএক্স মিডিয়ার এক্স সিইও। তদন্তকারী সংস্থার দাবি, ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে প্রাক্তন স্বামী সঞ্জীব খান্না ও গাড়িচালক শ্যাম রাইয়ের সঙ্গে পরিকল্পনা করে তিনি নাকি শিনাকে নৃশংসভাবে খুন করেছিলেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তিন বছর পর ইন্দ্রাণী গ্রেফতার হন। তার পরেই গ্রেফতার করা হয় সঞ্জীব ও শ্যামকেও।
এই ঘটনার পর ঝড় ওঠে গোটা দেশে। ইন্দ্রাণীর পক্ষে ও বিপক্ষে মত প্রকাশ করেন বহু মানুষ। তারপর পেরিয়েছে দীর্ঘ সময়। কারাগারে বসেই চলতে থাকে ইন্দ্রাণীর লড়াই। ২০১৫ সালে গ্রেফতারের প্রায় সাত বছর পরে, ২০২২ সালে অবশেষে জামিন পান ইন্দ্রাণী। গত বছর, ২০২৩ সালে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই, ‘আনব্রোকেন : দি আনটোল্ড স্টোরি’। তারপর তৈরি হয়েছে একটি ডকু-সিরিজ। শিনা বরা হত্যা মামলার উপর ভিত্তি করে। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে নেটফ্লিক্সে। সিরিজের নাম, ‘দি ইন্দ্রাণী মুখার্জি স্টোরি : ব্যারিড ট্রুথ’ (The Indrani Mukerjea Story)। ইতিমধ্যেই দেখেছেন বহু মানুষ।
সিরিজটি নিয়ে কথা বলার আগে একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। আলো ফেলা যাক শিনার উপর।
১৯৮৭ সালে মেঘালয়ের শিলংয়ে জন্ম। সিদ্ধার্থ দাস এবং ইন্দ্রাণীর কন্যা। গুয়াহাটির মামারবাড়িতে বেড়ে ওঠা। অন্য দিকে ইন্দ্রাণী কলকাতায় গিয়ে সঞ্জীব খান্নাকে বিয়ে করেন। এক কন্যাসন্তানেরও জন্ম দেন। ২০০২ সালে সঞ্জীবের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর ইন্দ্রাণী বিয়ে করেন পিটার মুখোপাধ্যায়কে। ২০০৬ সালে শিনা মুম্বইয়ে তাঁর মায়ের কাছে চলে যান। মুম্বইয়ে গিয়ে কলেজের পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে যোগ দেন। পুলিশ সূত্রে খবর, শিনাকে নাকি তখন বোনের পরিচয়ে নিজের কাছে রেখেছিলেন ইন্দ্রাণী।
ইন্দ্রাণী এবং পিটারের পুত্র রাহুল। এই যুবকের সঙ্গে নাকি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন শিনা। দুজনের সম্পর্ক মন থেকে মেনে নিতে পারেননি ইন্দ্রাণী। শুরু হয় অশান্তি। ২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে শিনা হঠাৎ রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান। ইন্দ্রাণী জানান যে, তাঁর কন্যা উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় গিয়েছেন। ইন্দ্রাণীর গাড়ির চালক পরে পুলিশকে জানান যে, ইন্দ্রাণী নাকি পরিকল্পনা করে শিনাকে খুন করেছেন। ২০১৫ সালে শিনাকে খুনের অপরাধে গ্রেফতার করা হয় ইন্দ্রাণীকে।
আরও পড়ুন- ওয়াশিং মেশিন ভাজপা এজেন্সির নিরপেক্ষতা নিয়ে তোপ ব্রাত্য বসুর
বিচারাধীন বিষয়। তীব্র নাটকীয়তায় মোড়া। ‘দ্য ইন্দ্রাণী মুখার্জি : ব্যুরিড ট্রুথ’ (The Indrani Mukerjea Story) ডকু-সিরিজে ইন্দ্রাণী এবং এই মামলার সঙ্গে অন্যান্য জড়িতদের মন্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে। তবে ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের জবানবন্দিই এই সিরিজের মূল আকর্ষণ। কারণ এর আগে তিনি নিজের জীবনকাহিনি নিয়ে কোনও সংবাদমাধ্যম বা বিনোদন মাধ্যমে সেইভাবে কথা বলেননি। ফলে তিনি ঠিক কী বলেন, জানার জন্য তুমুল আগ্রহ ছিল সাধারণের মধ্যে। একাধিকবার ইন্দ্রাণী দাবি করেছেন যে, ওই ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত নন। তারপরেও শিনা বরা হত্যা মামলা চলাকালীন তাঁকে বারবার মিডিয়া ট্রায়ালের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাঁকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে বহু স্টোরি, মিম।
সিরিজে ইন্দ্রাণীর সামনে রাখা হয়েছে চোখা চোখা প্রশ্ন। তিনি খেলেছেন স্ট্রেট ব্যাটে। কখনও ডিফেন্স করেছেন। কখনও হাঁকিয়েছেন ওভার বাউন্ডারি। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘আপনি কি আপনার কন্যা শিনা বরাকে খুন করেছেন?’ উত্তরে ইন্দ্রাণী বলেছেন, ‘হোয়াট আ স্টুপিড কোয়েশ্চেন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আদর্শ জননী আমাকে কোনওভাবেই বলা যাবে না। তবে আমি খুনি নই। কাউকে হত্যা করার কথা আমি চিন্তা করতে পারি না।’
এখানেই থামেননি ইন্দ্রাণী। তাঁর ধারণা, আজও জীবিত আছে শিনা। লক্ষ্য রাখছে সবকিছুর উপর। এর আগেও তিনি একই দাবি জানিয়ে বলেছেন, ‘শিনার মতো দেখতে এক তরুণীকে গুয়াহাটিতে দেখতে পেয়েছেন দু-জন আইনজীবী। ওই তরুণী তখন গুয়াহাটি বিমানবন্দরে একটি বিমানে উঠছিলেন। আদালত যেন অবিলম্বে ওই ভিডিয়ো ফুটেজ খতিয়ে দেখে সত্যি ঘটনাটি জানার চেষ্টা করে।’
ইন্দ্রাণী জোর গলায় দাবি করেছেন, ফাঁসানো হয়েছে তাঁকে। এর পিছনে রয়েছে গভীর চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র। কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ক্ষমার অযোগ্য এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। তিনি যে অপরাধী, সেটা কিন্তু এখনও প্রমাণ হয়নি। তদন্ত চলছে। তাঁর আশা, একদিন তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন।
সিরিজে ব্যবহার করা হয়েছে রাহুলের ফোন কল। এ-ছাড়াও ইন্দ্রাণীর দ্বিতীয় কন্যা বিধি মুখোপাধ্যায় এবং শিনার ভাই মিখাইল অনেক কিছু জানিয়েছেন। সবমিলিয়ে চার এপিসোডের টানটান সিরিজ। পরিচালনা করেছেন উরাজ বহাল এবং শানা লেভি। চিত্রনাট্য লিখেছেন সুদীপ নিগম। আবহ রচনা করেছেন জোয়েল ক্রাস্টো। দৃশ্য গ্রাহক জন ডব্লিউ রুটল্যান্ড। ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় অপরাধী কিনা, সেটা সময় বলবে। তবে এটা জোর দিয়ে বলা যায়, সিরিজটি হার মানাতে পারে যে-কোনও মৌলিক মার্ডার মিস্ট্রিকে।