গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের শুরুতে ছিল অবাধ মেলামেশা। সবাই সবার। তখন বহুগামিতা বা পরকীয়া ধারণার জন্ম হয়নি। সমস্ত কিছুই ছিল বৈধ। বহুগামিতা বা পরকীয়া ধারণার জন্ম হয়েছে অনেক পরে। এই নিষিদ্ধ ফল দিনে দিনে হয়ে উঠেছে আদরণীয়। আইনত অপরাধ না হলেও, সমাজ কিন্তু পরকীয়াকে সুনজরে দেখে না। তাতে কী? যাঁরা ঝাঁপানোর তাঁরা ঝাঁপাবেনই। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও। আসলে প্রেম কোনও বাধা মানে না। মানে না কোনও বারণ। পরকীয়া তো দশ কদম এগিয়ে। আরও সাহসী। বেপরোয়া। যুগে যুগে পরকীয়ায় জড়িয়েছেন, পরকীয়াকে প্রশ্রয় দিয়েছেন পৃথিবীর বহু সৃষ্টিশীল মানুষ। বাংলা সাহিত্যে পরকীয়া প্রেম নিয়ে লেখা হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস। ভরে উঠেছে পাতার পর পাতা।
বৈষ্ণব পদাবলী এবং রাধা-কৃষ্ণ
বৈষ্ণব পদাবলীতে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদান প্রমুখ পদকর্তা রাধা-কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে অসংখ্য পদ রচনা করেছেন। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম কিন্তু পরকীয়া প্রেমের উজ্জ্বল উদাহরণ। কারণ শ্রীরাধিকা ছিলেন পরস্ত্রী। তাঁর স্বামী আয়ান। কৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন রাধা। সমাজকে অস্বীকার করে। ফলস্বরূপ পরকীয়ার দায়ভার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শ্রীরাধিকাকেই বইতে হয়েছে। কেননা স্বকীয়ার সংজ্ঞা নিরূপণে অধিকাংশ ব্যাখ্যাকারই উল্লেখ করেছেন, ‘বিধি অনুসারে বিবাহিতা এবং পতিব্রতে অবিচালিকা সেই নায়িকাগণই স্বকীয়া’। সুতরাং সমাজদর্শন অনুযায়ী নির্মিত এই গণ্ডিরেখা অতিক্রম করে কোনও বিবাহিতা নারী অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করলে প্রথমে তিনিই দায়ী হবেন। তবে দ্বাপরের সেই কলঙ্কিনী শ্রীরাধিকা কলিতে এসে হয়ে উঠেছেন আদর্শ প্রেমিকা। রাধা-কৃষ্ণের ভালবাসা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমগাথা রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু প্রেমের ও সম্পর্কের সংজ্ঞায় তা পরকীয়া। বৈষ্ণব পদাবলির ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে শ্রীরাধিকার তীব্র আকুতি, যন্ত্রণা। সুললিত ছন্দে বর্ণনা করছেন কবিগণ। আবার স্বয়ং পদকর্তা চণ্ডীদাসও পরকীয়ায় লিপ্ত হয়েছিলেন বিবাহিতা রজকিনীর সঙ্গে। সৃষ্টির সঙ্গেই স্রষ্টা যেন খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের স্বরূপ। হয়তো সে কারণেই তাঁর পদের নায়ক-নায়িকা অনেক বেশি রক্তমাংসের।
মধ্যযুগীয় সাহিত্যে পরকীয়া
মধ্যযুগের সাহিত্যেও দেখা গেছে পরকীয়ার উপস্থিতি। ছুঁয়ে দেখা যাক মঙ্গলকাব্য। আগেই বলা হয়েছে, সমাজের মানদণ্ডে নারীর পরকীয়া গর্হিত কাজ। কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে তা পৌরুষত্ব প্রকাশের অন্যতম অলঙ্কার। তাই তো সুন্দরী গৃহিণী লহনাকে ঘরে রেখে খুল্লনায় মজেছিলেন ধনপতি সওদাগর। এই ঘটনায় তাঁকে নিন্দিত হতে হয় না। বরং তাঁর গৌরব বাড়ে। তবে এটাও ঠিক, ধনপতি খুল্লনার সঙ্গে শুধুমাত্র পরকীয়ায় আটকে থাকেননি, সামাজিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন সম্পর্ককে। বহুবিবাহের উদাহরণ আরও আছে। ঘরে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সিংহলের রাজকুমারী পদ্মাবতীকে বিয়ে করতে ছুটে ছিলেন রাজা রত্নসেন। অনেকেই বলতে পারেন, এ তো স্বকীয়ার নামান্তর, এর সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্ক কোথায়? কিন্তু এই ঘটনা যদি কোনও বিবাহিতা নারী ঘটাতেন, তখনই তা হত পরকীয়া এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে অমান্য করার মতো অপরাধ।
স্বকীয়ার পক্ষে বঙ্কিমচন্দ্র
এবার আসা যাক আধুনিক সাহিত্যে। শুরুতেই বাবু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ তাঁর সামাজিক উপন্যাস। বর্ণিত হয়েছে রোহিণী, ভ্রমর এবং গোবিন্দলালের ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি। পরকীয়ার গন্ধে ম ম। বিবাহিত গোবিন্দলাল পড়েছিলেন বিবাহিতা রোহিণীর প্রেমে। যদিও তার ফল হয়েছিল মারাত্মক। রোহিণীকে দিতে হয়েছিল জীবন। গোবিন্দলালকে পেতে হয়েছিল শাস্তি। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসেও রয়েছে পরকীয়ার ছায়া। নগেন্দ্রনাথ গোবিন্দপুরের জমিদার। তাঁর স্ত্রী সূর্যমুখী। নগেন্দ্রনাথ একটা সময় যুবতী বিধবা কুন্দনন্দিনীর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। কুন্দও নগেন্দ্রের প্রতি অনুরক্তা হন। সমস্তকিছু জানার পর সূর্যমুখী তাঁদের বিয়ে দেন। এর ফলও হয়েছিল ভয়ঙ্কর। মৃত্যু হয়েছিল কুন্দর। আসলে পরকীয়া প্রেমের প্রতি সমর্থন ছিল না সাহিত্যসম্রাটের। বিশ্বাস করতেন স্বকীয়ায়৷ তাই পরকীয়ায় কী ধরনের পরিণতি হতে পারে, দেখিয়েছেন। হয়তো ‘পরকীয়া’ নামক বিষবৃক্ষকে সংসার থেকে উপড়াতেই চেয়েছিলেন তিনি।
ভিন্নপথে রবীন্দ্রনাথ
স্বকীয়া-পরকীয়া দ্বন্দে বঙ্কিমচন্দ্রের ভিন্নপথে হেঁটেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্বদেশি আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত তাঁর উপন্যাস ‘ঘরে-বাইরে’। তিনটি মানুষের জীবনের টানাপোড়েন এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু। উদারমনা ব্যক্তিত্ব নিখিলেশ। তার স্ত্রী বিমলা। নিখিলেশের প্রতি অনুরাগ সত্ত্বেও বিমলা স্বামীর বন্ধু বিপ্লবী সন্দীপের প্রতি তীব্রভাবে আকর্ষিত হন। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসেও পরকীয়ার ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ। আশার স্বামী মহেন্দ্র। তিনি প্রেমে পড়েন বিধবা যুবতী বিনোদিনীর। তুমুল ঢেউ ওঠে সংসারে। লাগে ভাঙন। এবার ছুঁয়ে দেখা যাক রবীন্দ্র-ছোটগল্প ‘নষ্টনীড়’। ভূপতীর স্ত্রী চারুলতা। তাঁর একাকিত্ব দূর করেন অমল। সম্পর্কে তিনি ভূপতির ভাই। চারুলতার সঙ্গে অমলের এক আশ্চর্য সম্পর্ক রচিত হয়। যাকে কোনওভাবেই স্বাভাবিক বন্ধুত্ব বলা যায় না। ভূপতি সমস্তকিছু বুঝতে পারেন। এও বোঝেন যে, তিনি কী হারিয়েছেন। পরকীয়া-আশ্রিত গল্প। তবে পাঠকের মনে কলুষতা স্পর্শ করে না। পাঠশেষে বরং চারুলতার সব হারানোর হাহাকারে ভিজে ওঠে পাঠকের মনও। রবীন্দ্রনাথ জানতেন পরকীয়ার শিকড় অনেক গভীরে। ফলে একে অস্বীকার করা যায় না।
নীতির কাছে শিল্পীর পরাজয় মানেননি শরৎচন্দ্র
বিভিন্ন গল্পে উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে, বিধবা, পতিতা তথা সমাজ-বিগর্হিত নারীর মনেও আছে নিষ্পাপ প্রেম। তিনি কোনও নীতির কাছে শিল্পীর পরাজয় মেনে নেননি। কেননা নারীর সতীত্বের চেয়ে নারীর নারীত্বই তাঁর সাহিত্যে নারী চেতনার মর্মবাণী। তাই তো উচ্চবংশের গৃহিণী হওয়া সত্ত্বেও ‘দেবদাস’ উপন্যাসের পার্বতী তীব্র অনুরাগ পুষে রাখতে পারেন পুরোনো প্রেমিক দেবদাস মুখোপাধ্যায়ের জন্য। দেবদাসও ভুলতে পারেন না পার্বতীকে। এও কিন্তু এক ধরনের পরকীয়া। শরৎচন্দ্রের অমর সৃষ্টি ‘গৃহদাহ’। এই উপন্যাস আবহমান বাংলার প্রণয়সঙ্কটে ভুগতে থাকা তিনজন নর-নারীর ত্রিভুজ প্রেমের আখ্যান। চরিত্ররা হলেন মহিম, সুরেশ এবং অচলা। উপন্যাসে শরৎচন্দ্র সমসাময়িক বাঙালির আত্মিক বৈশিষ্ট্য, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ব্যক্তিমানসের পারস্পরিক সম্পর্ক, তাদের প্রেম-পরিণয়, বিশ্বাসকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। পরকীয়ার মৃদু গন্ধ লেগে রয়েছে উপন্যাসের কাহিনির ভাঁজে ভাঁজে।
তারাশঙ্কর, মানিক, বুদ্ধদেব এবং…
‘কবি’ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক অসামান্য সৃষ্টি। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নিতাই। তিনি নিম্নবর্গের দুধর্ষ ডাকাত বংশীয়। ধীরে ধীরে কবি হয়ে ওঠেন। এসময় রাজার শ্যালিকা ঠাকুরঝির সঙ্গে নিতাইয়ের পরিচয় ঘটে। ঠাকুরঝি ছিলেন পাশের গ্রামের বধূ। কৃষ্ণবর্ণা, দ্রুতহাসিনী, ছিপছিপে গড়নের মিষ্টি-মেয়ের দেহখানাই শুধু লতার মতো নয়, মনও যেন দীঘল দেহের অনুরূপ। নিতাইয়ের গানের নীরব ভক্ত এই নারী। দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেম। এই পরকীয়া প্রেমের সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজ। তারাশঙ্করের ‘হাঁসুলীবাকের উপকথা’র পাখি ছিলেন বিবাহিতা। তিনি সমাজের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে ভালবেসেছিলেন সুজনকে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে লেগে রয়েছে অবৈধ প্রেমের স্বাদ। খুবই সাবলীলভাবে এসেছে কুবের-কপিলার পরকীয়া প্রেমের বিষয়টি। ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ উপন্যাসে বুদ্ধদেব বসু পরকীয়া প্রেমকে আশ্রয় করে গড়ে তুললেন উপন্যাসের আখ্যান। অংশুর স্ত্রী মালতী। জয়ন্তের প্রেমিকা। মালতীকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের যাবতীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সূচনা। বিমল মিত্রের ‘স্ত্রী’ উপন্যাসে চোখ রাখা যাক। জমিদারের পারিষদ সীতাপতি জমিদারপত্নীর সঙ্গেই জড়িয়ে পড়েন অবৈধ প্রেমের বন্ধনে। গজেন্দ্রকুমার মিত্রের উপন্যাসত্রয়ী ‘কলকাতার কাছেই’, ‘উপকণ্ঠে’ আর ‘পৌষ ফাগুনের পালা’য় রয়েছে অবৈধ প্রেমের উপাদান। সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ একটা সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সুখেন। তাঁর দাদা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কেশব একাধিক বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। বিবাহিত মহিলা এবং যুবতী মহিলাদের সঙ্গে। পরকীয়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। ‘মাধুকরী’ উপন্যাসে পৃথুর সঙ্গে কুর্চির বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কথা পাঠকদের অজানা নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’-এর বিবাহিত গঙ্গানারায়ণ তীব্রভাবে আকৃষ্ট হন বিধবা বিন্দুবাসিনীর প্রতি। সুনীলের আরও অনেক লেখায় দেখা যায় পরকীয়া প্রেমের উপাদান। ‘মেয়েলি আড্ডার হালচাল’-এ বাণী বসু পরকীয়াকে বিশেষভাবে স্থান দেন। জয় গোস্বামীর ‘সাঁঝবাতির রূপকথারা’ উপন্যাসে সাঁঝবাতির বাবা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন তাঁর একসময়ের ছাত্রী দীপুর সঙ্গে। চোখের সামনে বাবাকে অন্য নারীর বাহুডোরে দেখার পরে তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায় সাঁঝবাতির সাজানো দুনিয়া। মৃত্যু হয় মায়ের। নেমে আসে শূন্যতা। নারী-স্বাধীনতার জয়ধ্বজা উড়িয়েছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য, মল্লিকা সেনগুপ্ত, তসলিমা নাসরিন প্রমুখ। তাঁদের বিভিন্ন রচনায় বিকষিত হয়েছে পরকীয়া প্রেম।
আরও কবি-সাহিত্যিক পরকীয়া প্রেমের বীজ বপন করেছেন তাদের বিভিন্ন রচনায়। স্বকীয়া সমাজের চোখে বৈধ। তবে পরকীয়াকে কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না। ভালবাসা কবেই বা নিয়মের চোখরাঙানিকে তোয়াক্কা করেছে? সে শুধু শোনে হৃদয়ের কথা। আর হৃদয়? চিরকাল সমাজকে দেখিয়ে এসেছে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ। তাই পরকীয়া-সাহিত্যের কদর ছিল, আছে, থাকবে।