মাদুর্গার বংশপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন থেকে শুরু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতৃপরিচয় নিয়ে বক্রোক্তি— বক্তা দিলীপ ঘোষ। অন্যদিকে সরকারি প্রকল্পের সুবিধাভোগী কিন্তু সরকারের সমালোচনা করে যে বিজেপির হয়ে ভোট প্রার্থী তাকে যখন মোদিবাবু ফোন করে শক্তিস্বরূপা বলেন তখন কেমন কানে বাজে! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যখন চূড়ান্ত অপমান করা হল তখন বিজেপির রাজ্য মুখপাত্ররা দিলীপ ঘোষের বিরোধিতা করার বদলে দাপটে সমর্থন করল। পরে একটি শোকজের চিঠি এল বটে তাও কোন নির্দিষ্ট সময়ে তার উত্তর দেওয়ার কথা বলা হয়নি। আবার ঘৃণ্য বক্তব্য পেশকারী ঘোষবাবু জনসমক্ষে অনুশোচনা বা ক্ষমা চাওয়ার বদলে বেশ করেছি ধাঁচের কথা বলছেন।
আরও পড়ুন-অবৈধ প্রেমের বৈধ ছবি
অন্যদিকে, তমলুকের বিজেপি প্রার্থী, যিনি সাংবাদিকদের যোগ্যতা নিয়ে অকপট প্রশ্ন তোলেন, আন্দোলনকারীদের বিপথে পরিচালিত করেন, সেই গাঙ্গুলিবাবু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে বলে মন্তব্য করেন। তাঁরও কোনও অনুতাপ নেই। বাংলা বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিদির ‘ধান্দা’ কী এই নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি আবার অধ্যাপক! কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কটূক্তি করে বলেন দিদি নাকি ‘ঠুমকা’য় ব্যস্ত থাকেন। স্বয়ং মোদির সেই ডাক ‘দিদি ও দিদি’ আজও কানকে কষ্ট দেয়।
আরও পড়ুন-পাতায় পাতায় পরকীয়া
বিজেপি মূলত নারীবিদ্বেষী দল। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন কর্নাটকে হিজাব-বিতর্ক চলছে তখন বিজেপি বিধায়ক এম পি রেণুকাচার্য ধর্ষণের জন্য নারীদের পোশাককে দায়ী করে। কারণ তার মতানুযায়ী নারীরা ছোট পোশাক পরে বলে পুরুষরা উত্তেজিত হয়! ওই বছরেরই অক্টোবর মাসে ওই একই রাজ্যের মন্ত্রী ভি সোমান্যা এক মহিলাকে সবার সামনে চড় মারেন শুধুমাত্র ‘সে বাড়ি পাইনি’ এই অভিযোগ করার জন্য। ২০২৩ সালে ওড়িশার সম্বলপুরের বিজেপি বিধায়ক তথা বিরোধী দলনেতা জয়নারায়ণ মিশ্রা কর্মরত এক মহিলা পুলিশ আধিকারিককে সর্বসমক্ষে চড় মারেন। আবার ২০১৮ সালে মিরাটের পৌর প্রতিনিধি ও উত্তরপ্রদেশ বিজেপির মুখপাত্র এক মহিলাকে সর্বসমক্ষে অপমান করেন। ব্রিজভূষণ শর্মা সাক্ষী মালিক-সহ অন্যান্য মহিলা অ্যাথলিটদের মর্যাদাহানি করলেও কেউ কোনও কথা বলে না। বরং যা করেছি বেশ করেছি ধাঁচের বক্তব্য ফুটে ওঠে। হাতরাসে দরিদ্র দলিত কন্যাকে উচ্চবর্ণের ঠাকুর ধর্ষণ করে বলে মধ্যরাতে দেহ জ্বালিয়ে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা হয়। উন্নাও-এর মন্দিরে কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয় এবং বিচার প্রার্থীদের অনেকেই অজ্ঞাতভাবে দুর্ঘটনায় মারা যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিলকিস বানোর হত্যাকারীরা সংস্কারী বলে আখ্যায়িত হন এবং রাজ্য সরকার তাদের ছেড়ে দেয় ও তারা ব্রাহ্মণ বলে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী তাদের সাদরে গ্রহণ করেন ফুল-মালা দিয়ে। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী এমন একটা মোবাইল অ্যাপ যার নাম ‘বল্লি ভাই ও সুল্লি ডিলস’ তৈরি করে, যাতে মুসলিম মহিলাদের অকশন করা হয়। আসলে বিজেপি কোনওভাবেই নারীসম্মানে বিশ্বাসী নয়। তাই কংগ্রেসের প্রাক্তন মহিলা সভাপতি সম্পর্কে বিদেশিনি নাম দিয়ে কটূক্তি কিংবা এক মহিলা সংসদের হাসিকে শূর্পণখার হাসি বলে মোদি ব্যঙ্গ করতে পারে। কিন্তু বিজেপি আজ অবধি কোনও মহিলা সভাপতি নিযুক্ত করেনি। একই হাল আরএসএসেরও।
আরও পড়ুন-অবৈধ ইস্তাহার
বিজেপি মূলত মনুবাদী ও পিতৃতান্ত্রিক দল। মনুসংহিতায় যেমন বলা— ‘বাল্যে পিতুর্বশে তিষ্ঠেৎ পাণিগ্রাহস্য যৌবনে। পুত্রাণাং ভর্তরি প্রেতে ন ভজেৎ স্ত্রী স্বতন্ত্রতাম।’ (৫/১৪৮) অর্থাৎ, নারী বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রদের অধীন; কখনও স্বাধীনভাবে থাকবেন না। যা ভারতের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে তাদের বক্তব্যেই পরিষ্কার। সেজন্য এরা সারদা মায়ের ছবি বিকৃত করতেও পিছপা হয় না।
মণিপুরে মহিলাদের নগ্ন করে ঘোরানো হলেও বিজেপি চুপ থাকে; শাহিনবাগে ১০১ দিন মহিলাদের আন্দোলন, কৃষিবিলের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মহিলাদের আন্দোলন, আশা কর্মীদের আন্দোলন, ১০০ দিনের কাজের বঞ্চিত মহিলাদের আন্দোলন— সব ক’টি ক্ষেত্রেই চুপ থাকে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে লিঙ্গজনিত হিংসার (সেক্স্যুয়াল ভায়োলেন্স) সংখ্যা ছিল ৪২৮২৭৮; যা ২০২২-এ হয় ৪৪৫৮৫৮। উল্লেখ্য, ২০২২ সালেই প্রতিদিন ৮৬টা ধর্ষণ হয়, এক বছরের সংখ্যা ৩১৫১৬। এ-বিষয়েও তারা চুপ। তাদের সকলের দৃষ্টি শক্তিস্বরূপার দিকে। স্বাভাবিক। কারণ বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই নারীরা শক্তিস্বরূপা হয়েছেন।
আরও পড়ুন-শোভাযাত্রায় ধামসা-মাদল সৌগতর প্রচারে চন্দ্রিমাও
একদিকে কেন্দ্রীয় সরকার কন্যাদের উন্নয়নের কথা বলেন, কিন্তু কার্যকরী ক্ষেত্রে বাজেট-বরাদ্দ করতে ব্যর্থ হন। আবার তারা ২০১৯ সালের নির্বাচনী প্রতিজ্ঞায় মহিলাদের জন্য সংসদে ও বিধানসভায় ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০২৪-এ ভোটের আগে সেই সংক্রান্ত আইনও আনে! মাঝে পাঁচ বছর কেটে যায়! কিন্তু মানুষকে এ-বিশ্বাস দিতে তারা সচেষ্ট যে তারা কথা দিয়ে কথা রাখে কিন্তু। কিন্তু সত্যটা কী? ২০২১ সালে জনগণনা হয়নি। ভবিষ্যতে জনগণনা কবে হবে তাও জানা নেই! আর সংরক্ষণের ক্ষেত্রে জনগণনা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই আপাতত মহিলাদের জন্য সংসদ ও বিধানসভায় আসন সংরক্ষণ বিশ বাঁও জলে। অন্যদিকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংসদে, বিধানসভায়, পৌরসভায় কিংবা গ্রাম পঞ্চায়েতে নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি করেন। কন্যাশ্রীর মাধ্যমে স্কুলছুট ও বাল্যবিবাহ বন্ধে উদ্যোগী হন। রূপশ্রী, সবুজ সাথী, গর্ভাবস্থায় নারীদের পুষ্টির দিকে খেয়াল রাখা প্রভৃতি প্রকল্পের মাধ্যমে কিংবা আশা কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি, মহিলা সরকারি কর্মীদের দু’বছর মাতৃত্বকালীন ছুটি— তা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা প্রভৃতির মাধ্যমে নারীদের প্রকৃত অর্থেই শক্তিস্বরূপা করে তুলেছেন। আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নারীদের মধ্যে একটা ‘বিশ্বাস’ গড়ে তুলেছেন। সেই বিশ্বাস নারী-ক্ষমতায়নের বিশ্বাস, নারীমুক্তির বিশ্বাস, শক্তিস্বরূপা সৃষ্টির বিশ্বাস। বিজেপি সেই বিশ্বাসটিকে ভাঙার চেষ্টা করছে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন এক বিশ্বাস যাকে ভাঙা এত সহজ নয়। বরং এই শক্তিস্বরূপারাই বিজেপির মাথাব্যথার কারণ। আগামীর ভোট তার প্রমাণ করবে। তাই নজরুলের কথায় শেষ করি— ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর; অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’