ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ৯৬৩ হিজরিতে তথা ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ আকবর-এর সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে আমাদের বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। প্রথমে ৯৬৩ হিজরিকে বাংলা সনের বয়স ৯৬৩ বছর ধরে নিয়ে তারপর প্রতি সৌর বছর অন্তর ৯৬৪, ৯৬৫, ৯৬৭— এরূপ হিসেবে গণনা করা হয়ে আসছে। সেই হিসেবে আজ থেকে শুরু হল বাংলা ১৪৩১ সাল। প্রসঙ্গত, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ প্রভৃতি ১২ মাসের নামের সঙ্গে রাশিচক্রের নক্ষত্রদেরও নাম জড়িয়ে রয়েছে। প্রতি মাসেই একবার করে পূর্ণিমা হয়। প্রতি মাসের পূর্ণিমার চাঁদ কোন রাশির কোন নক্ষত্রে অবস্থান করে তা দেখে সেই মাসের নামকরণ করা হয়েছে। যে মাসটিকে আমরা বৈশাখ বলি, সেই মাসে পূর্ণিমার চাঁদ বিশাখানক্ষত্রে থাকে বিধায় মাসটির নাম হয়েছে বৈশাখ। বাংলা সালের প্রথম মাস বৈশাখ। তাই দীর্ঘদিন ধরে সমগ্র বাঙালি সমাজে বৈশাখের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ নববর্ষ উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে।
আরও পড়ুন-মহেশতলার শতায়ু-পার-করা প্রতিভা শামিল গণতন্ত্রের উৎসবে
পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের বর্ষবরণ
বাংলা নববর্ষ উৎসব মূলত আবহমান বাংলার কৃষি সমাজের উৎসব। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়— পৃথিবীর সভ্য-অর্ধসভ্য সমস্ত জাতি এক আনন্দময় পরিবেশে নববর্ষ পালন করতেন এবং এখনও করেন। নেচে, গেয়ে, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে পানাহারে মেতে, আত্মীয়-পরিজনের সাথে মিলিত হয়ে, স্থানে স্থানে আড্ডা দিয়ে হই-হুল্লড় করে নববর্ষের বাঞ্ছিত উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি করা হত এবং এখন পর্যন্ত তা হচ্ছে। বাংলা নববর্ষ সচরাচর পহেলা বৈশাখে প্রতিপালিত হলেও এটি বৈশাখ মাসব্যাপী পালনীয় উৎসব। বাংলা নববর্ষের কিছু উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ রয়েছে। সেসব অনুষঙ্গ এবং বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের বহুমাত্রিকতা এখানে উল্লেখ করা হল—
আমানি: নববর্ষের একটি অনুষঙ্গ ‘আমানি’ (আমপানীয়) খাওয়া। প্রধানত উত্তরবঙ্গের গৃহিণীরা চৈত্রসংক্রান্তির দিন সন্ধ্যায় অথবা রাতে একহাঁড়ি পানিতে স্বল্প পরিমাণ অপক্ব বা অর্ধসিদ্ধ চাল ছেড়ে দিয়ে তার মধ্যে একটি কচি আমের ডাল বসিয়ে রাখেন। পহেলা বৈশাখের ভোরবেলায় সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠে তারা ভেজা চাল গৃহের সকলকে খেতে দেন। ঘরের সবাই মিলে একে একে তা খেতে থাকে; আর হাঁড়িতে ডোবা ডালের পাতা দিয়ে গৃহিণীরা সকলের গায়ে পানি ছিটাতে থাকেন। তাঁদের ধারণা, এতে করে গৃহে নতুন বছরের শান্তি নেমে আসবে এবং ফসলের কোনও ক্ষতি হবে না। যদ্দুর জানা যায়, আমানিই বাংলা নববর্ষের প্রথম ও প্রাচীন অনুষ্ঠান।
আরও পড়ুন-রাজবংশীদের সঙ্গে বৈঠকে পাশে থাকার বার্তা অভিষেকের
পুণ্যাহ: পুণ্যাহ অর্থ কোনও পুণ্য কাজ শুরু করার জন্যে জ্যোতিষশাস্ত্র অনুমোদিত প্রশস্ত দিন। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল— জমিদার কর্তৃক প্রজাদের কাছ থেকে নতুন বছরের খাজনা আদায়ের প্রারম্ভিক অনুষ্ঠানসূচক দিন। এই দিনে প্রজারা ভাল কাপড়চোপড় পরে জমিদার-তালুকদারদের বাড়িতে খাজনা দিতে আসতেন। কোথাও কোথাও জমিদার-তালুকদারেরা পান-সুপারি অথবা মিষ্টিমুখ করিয়ে আপ্যায়ন করতেন। মুহম্মদ এনামুল হকের লেখায় উল্লেখ পাওয়া যায় যে, ১৯২০ সাল পর্যন্ত পহেলা বৈশাখে পুণ্যাহ অনুষ্ঠিত হত।
গরুর দৌড়: মুহম্মদ এনামুল হকের মতে ‘গরুর দৌড়’ নববর্ষের স্থানীয় অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম। অনুষ্ঠানটি এখন একরকম লোপ পেতে বসেছে। তৎকালীন ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জ মহকুমা ও তার সন্নিহিত অঞ্চলের গ্রামে-গ্রামে পহেলা বৈশাখে এই অনুষ্ঠান সমারোহসহকারে উদযাপিত হত। যে-সমস্ত জায়গায় গরুর দৌড় হত, সেসব এলাকায় ছোটখাটো মেলাও বসত। এদিন সঙ্গতিসম্পন্ন গৃহস্থেরা তাদের হালের গরুর গায়ে রঙের ছোপ দিয়ে, গলায় কড়ির মালা পরিয়ে সাজাতেন এবং গরুগুলোকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিযোগিতায় যোগ দিতেন। যাদের গরু এই প্রতিযোগিতায় জিতত, গর্বে তাদের বুক ফুলে উঠত এবং তাঁরা আনন্দে মেতে উঠতেন।
আরও পড়ুন-কোচবিহারে রোড শো-তে জনসমুদ্র, রাজবংশীদের সঙ্গে বৈঠকে অভিষেক
হালখাতা: পহেলা বৈশাখে হালখাতা অনুষ্ঠানটি হাটে-বাজারে-গঞ্জে দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত প্রতিপালিত হয়। এটি সাধারণত ব্যবসা-বাণিজ্যের সাংবাৎসরিক হিসাব রাখা এবং মেলানোর প্রয়োজনে ব্যবসায়ী ও দোকানদারগণ আয়োজন করেন। এখানে বাকিতে কিছু কেনার টাকা পরিশোধের প্রচলন ছিল। আমাদের ছোটবেলায় দর্জির দোকানে শার্ট কিংবা পায়জামা বানানোর সময় বাবাকে এক/দেড় টাকা বাকি রাখার বায়না ধরতাম- যাতে হালখাতার দিন মিষ্টি-নিমকি-বাতাসা ইত্যাদি খাওয়ার সুযোগ মেলে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের প্রধানত মফসসল শহর এবং গাঁয়ে-গঞ্জের দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আজও হলখাতার প্রচলন রয়েছে।
মেলা: মেলা নববর্ষের অন্যতম প্রধান আনন্দময় অনুষঙ্গ। দেশ জুড়ে সারা বৈশাখ মাসেই অনেক মেলা বসে এবং অধিকাংশ মেলা পহেলা বৈশাখে আয়োজিত হয়। মেলায় এসে মানুষ একে অপরের সাথে মিলিত হয়, ক্ষুদ্র মানুষ বৃহৎ হয়, সীমাবদ্ধ মানুষ সীমা ছাড়িয়ে নিজেকে অপরের মধ্যে সঞ্চারিত করে এবং অপরকে নিজের মধ্যে ঠাঁই দেয়। মানুষের মেলার আনন্দ নির্মল ও নিঃস্বার্থপরতার আনন্দ। মেলার সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির যোগাযোগ নিবিড়। বাঙালির এই উৎসবে ফুঠে ওঠে সকল ধর্মের সকল শ্রেণির মানুষের সংস্কৃতির সমন্বয়। কয়েকটি গ্রামের সংযোগস্থলে, নদী তীরে বা কোনও খোলা মাঠে মেলার আয়োজন করা হয়। মেলাকে ঘিরে গ্রামীণ জীবনে সকলের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য আসে। গ্রামের মেলায় যাত্রা, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, জারি-সারি, রামায়ণপাঠ, পুঁথিপাঠ, গম্ভীরা, কীর্তন, পালাগানের আসর, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠিখেলা, হাডুডু খেলা ইত্যাদি নানাবিধ আয়োজন আগত দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। এখনও নাগরদোলা সব বয়সিদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। মেলায় নাটক বা যাত্রাপালারও আয়োজন করা হয়। গ্রামীণ মৃৎশিল্প ও কারুপণ্যের বিকিকিনি মেলার আরেক আকর্ষণ। এসব মৃৎশিল্পের মধ্যে শখের হাঁড়ি এবং বিভিন্ন ধরনের মাটির পুতুল বেশ জনপ্রিয়।
আরও পড়ুন-চৈত্রশেষে বাংলাদেশের শতাব্দীপ্রাচীন কাচ নাচ কাটোয়ায় বড় আকর্ষণ
মঙ্গল শোভাযাত্রা: আজকের দিনে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হয়ে উঠেছে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উদযাপনের প্রধান আনন্দময় অনুষঙ্গ। ১৯৮০-এর দশকের শেষ ভাগে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একই সঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম সর্বস্তরের জনসমাজের অংশগ্রহণে আনন্দ শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৬৬ সালে তৎকালীন ছাত্রনেত্রী বাংলার অগ্নিকন্যাখ্যাত মতিয়া চৌধুরীর (বর্তমানে জাতীয় সংসদের উপনেতা) নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকায় এবং ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি যশোরের চারুপীঠ বাংলা বর্ষবরণ উপলক্ষে সীমিত পরিসরে বৈশাখী শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিল বলে জানা যায়।
১৯৯৬ সাল থেকে সূচিত এই আনন্দ শোভাযাত্রা নতুন রূপে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে আয়োজিত একটি অনন্য বর্ষবরণ উৎসবে পরিণত হয়েছে। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ এখন বাংলাদেশের নবতর সর্বজনীন সাংস্কৃতিক এবং প্রধান ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসেবে বাঙালির জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই আয়োজনে হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, আদিবাসী এবং দেশি-বিদেশি সর্বস্তরের ও সকল শ্রেণির নারী-পুরুষ-শিশু সকলেই বাদ্য-বাজনার তালে তালে নেচে-গেয়ে মাতোয়ারা হয়ে অংশগ্রহণ করে থাকে।
(এরপর আগামিকাল)