বাংলাদেশ থেকে কলকাতা সর্বত্র বাঙালির নববর্ষ

কলকাতা হোক বা ঢাকা, নববর্ষ পালনের মূল সুর ধর্ম নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা। খাবারের আয়োজন হোক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সবেতেই এই ভাব। আজ শেষ কিস্তিতে এই কথাটাই লিখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভাইস চ্যান্সেলর ও বাংলাদেশের একুশে পদক প্রাপ্ত লেখক ড. মুহাম্মদ সামাদ

Must read

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের আয়োজনে প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় প্রতি বছরই পয়লা বৈশাখে ঢাকা শহরের শাহবাগ-রমনা এলাকায় এই আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করা শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়। এসবের মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরণ, বিভিন্ন রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার অন্যতম আকর্ষণ হল বিশালাকায় চারুকর্ম হিসেবে বাঘ, হাতি, কুমির, ঘোড়া, ময়ূর, লক্ষ্মীপেঁচা, মাছ, পুতুল-সহ নানা রঙের ও আকারের বিচিত্র মুখোশ এবং সাজসজ্জা, বাদ্যযন্ত্র, নৃত্য ইত্যাদি। এসবই শক্তি ও শান্তির আবাহন এবং অশুভকে দূরে তাড়ানোর প্রতীক।

আরও পড়ুন-বিজেপির দৌরাত্ম্য, পোড়ানো হল তৃণমূল কর্মীর দোকান

আনন্দের কথা এই যে, বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবক্রমে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কোর মানবতার অধরা বা অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার ফলেই সেটি সম্ভব হয়েছিল। উল্লেখ্য, ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র স্থানলাভ উপলক্ষে বাংলাদেশকে একটি সনদপত্র প্রদান করা হয়। সেই সনদপত্রে এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সুরক্ষা দেওয়ার ধারা (Convention for the Safeguarding of the Intangible Cultural Heritage) যুক্ত রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার পয়লা বৈশাখকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে এবং জাতীয় বেতন স্কেলের আওতাভুক্ত সকল সামরিক/বেসামরিক কর্মচারীর জন্য ‘বাংলা নববর্ষ ভাতা’ প্রবর্তনের মাধ্যমে ইউনেস্কোর কনভেনশন অনুযায়ী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সুরক্ষা দান করেছে। বাঙালি সংস্কৃতির অনুরাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক উদ্যোগের ফলেই জাতীয়ভাবে সকলের জন্যে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের এমন সুন্দর ও সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। জানা যায়, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষের দিনটিকে ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু, ৫৬ দিনের মাথায় পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২-ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়ার পর তা আর কার্যকর থাকেনি।

আরও পড়ুন-মাহি-পাথি ঝড়ে ম্লান রো-হিট

৩. ছায়ানটের বর্ষবরণ
বাংলা নতুন বছরকে আবাহন করে রমনা পার্কের লেক সংলগ্ন বটমূলে ছায়ানটের সংগীতানুষ্ঠান পয়লা বৈশাখের অন্যতম সাংস্কৃতিক আকর্ষণ। ১৯৬১ সালে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা ১৩৭১ সালের (ইংরেজি ১৯৬৪ সাল) পয়লা বৈশাখ রমনার বটমূলে ছায়ানট বাংলা নববর্ষ পালন শুরু করে। কালক্রমে এই নববর্ষ পালন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। আমরা ছাত্র জীবন থেকে এই বর্ষবরণ উৎসব দেখে এসেছি। সূর্যোদয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই উৎসব আরম্ভ হয়। প্রথম থেকে রবীন্দ্রসংগীত ছিল এই অনুষ্ঠানের প্রধান পাথেয়। বর্তমানে রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে পঞ্চকবির গান ও লালনগীতি-সহ জনপ্রিয় লোকসংগীতে মেতে ওঠে পয়লা বৈশাখের এই উৎসব। এছাড়া কবিতা আবৃত্তিও হয়। বাঙালির উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্যোগে এবং অংশগ্রহণে এই বাংলা নববর্ষ উদযাপন শুরু হলেও এখন সকল শ্রেণি-পেশার মানুষই এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও ছায়ানট পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ, শারদোৎসব ও বসন্তোৎসব গুরুত্ব সহকারে আয়োজন করে। এই সবই অসাম্প্রদায়িক উৎসব। উল্লেখ্য, সনজিদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক প্রমুখের উদ্যোগে ছায়ানটের বর্ষবরণ বাঙালি সমাজের এক অগ্রণী সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।

আরও পড়ুন-নারীবিদ্বেষী বিজেপিকে হারানোর ডাক দিয়ে বর্ধমানের রাজপথে মহিলাদের ঢল

৪. সুরের ধারার বর্ষবরণ
১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত গানের স্কুল সুরের ধারা প্রথমে ঘরোয়াভাবে বাংলা নববর্ষ পালন আরম্ভ করে। পরে, ২০১২ সাল থেকে দেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রিজওয়ানা চৌধুরী বন্যার তত্ত্বাবধানে সুরের ধারা সারা দেশের হাজার সংগীতশিল্পীর অংশগ্রহণে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে চলেছে। শুরুতে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও রবীন্দ্রসংগীতের অনুরাগীরা আমন্ত্রিত হয়ে সুরের ধারার বর্ষবরণ অনুষ্ঠান উপভোগ করতেন। এখন সুরের ধারার পয়লা বৈশাখের এই নববর্ষ উৎসব সকলের জন্যে উন্মুক্ত। বলা বাহুল্য, ২০১২ সালে চ্যানেল আই সুরের ধারার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

আরও পড়ুন-রাজবংশীদের সঙ্গে বৈঠকে পাশে থাকার বার্তা অভিষেকের

প্রবাসে পয়লা বৈশাখ
বিশেষভাবে বলা আবশ্যক যে, ২০১৭ সাল থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে কলকাতায় প্রতি বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। কলকাতার গাঙ্গুলিবাগান থেকে শুরু হয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে বিদ্যাপীঠ ময়দানে গিয়ে শেষ হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। পশ্চিমবঙ্গে আরও কয়েকটি মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন হয়। এসব শোভাযাত্রায় দুই বাংলার শিল্পীদের আঁকা নানান লোকজ চিত্রকর্ম, পুতুল প্রভৃতি বহন করা হয়। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রধানত বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে কোথাও ছোট আবার কোথাও বড় পরিসরে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের আয়োজন বেড়েই চলছে। এ-বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে কবিতা, গান, লোকজ মেলা, বাংলাখাবার ইত্যাদির সমাহারে পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বিশাল আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাঙালিরা নিশ্চয়ই তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে এবার নিউ ইয়র্কের এই নববর্ষের উৎসবে মেতে উঠবেন।

আরও পড়ুন-

পয়লা বৈশাখ সকলের উৎসব। বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষের জন্যে এই নববর্ষ উৎসবটি ধর্ম নিরপেক্ষ উৎসব। পয়লা বৈশাখে আয়োজিত বাঙালির নববর্ষের উৎসবে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র এবং অনেকাংশে রাজনৈতিক বিশ্বাস নির্বিশেষে সকলেই উদার ও আনন্দিত চিত্তে অংশগ্রহণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা যে ধর্ম নিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করেছি। পয়লা বৈশাখের নববর্ষ উদযাপন সেই চেতনা ও ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান ধারক-বাহক। উল্লেখ্য, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর থেকে প্রায় আড়াই দশক ধরে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির ওপর ভয়াবহ আঘাত হানে। সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সেসব আঘাতের অন্যতম একটি জবাব হল ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন এবং জাতীয়ভাবে সাড়ম্বরে পয়লা বৈশাখ উদযাপন। এখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সারা দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো পয়লা বৈশাখ উদযাপন করে বাঙালি সংস্কৃতির জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। প্রতিটি আয়োজনে সমস্বরে ধ্বনি ওঠে— ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’
(শেষ)

Latest article