শেষ পর্যন্ত ঝুলি থেকে কেবলমাত্র বিড়াল নয়, বনবিড়াল, হাঙর, বাঘ সবই বাহির হতে শুরু করেছে। নির্বাচন কমিশন নামক শ্রদ্ধেয় সংবিধানিক সংস্থাটিকেও বিজেপি দল তাদের হাতের পুতুলে পরিণত করতে চলেছে। যেমন আর পাঁচটা সংগঠনকে ইতোমধ্যেই করে ফেলেছে। এখন নির্বাচন কমিশনের একমাত্র কাজ হচ্ছে বিজেপি-বিরোধী নেতাদের নির্বাচনী কর্মসূচি ও প্রচারকার্যে বাধা সৃষ্টি করা। ইতোমধ্যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচার-হেলিকপ্টার আয়কর বিভাগের আধিকারিকরা গিয়ে তল্লাশি করেছে। হেলিকপ্টারের কোনে কোনে কতখানি ধুলোবালি জমে আছে সেটা তারা নিশ্চয় দেখেছে। কিন্তু আপত্তিজনক কিছু দেখতে পায়নি। তা পাবার কথা নয় সেটা আমরা জানি। কিন্তু বিজেপির চেষ্টা হচ্ছে উত্তেজনা ছড়ানো। বাংলায় প্রধান দলের অন্যতম প্রধান নেতার নামে কুৎসা ছড়ানো অপচেষ্টা এটা সবাই জেনে গিয়েছে। নির্বাচন কমিশন নীরব। তাদের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য সুষ্ঠু ভোট করা এবং করানো। তার জন্য তাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না করে বিরোধী দলের নেতাদের কাজে যারা বাধা সৃষ্টি করছে অযথা তাদের প্রতি নীরব থেকে উৎসাহিত করছে। এমনই ঘটনা ঘটেছে রাহুল গান্ধীর প্রতি। তাঁরও হেলিকপ্টারে আয়কর দফতরের হানা হয়েছে।
আরও পড়ুন: অন্তহীন অগ্নিপরীক্ষায় নারীরা
আর একটু সাম্প্রতিক অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দিই। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। যখন গ্রেফতার করা হয়েছে তখন নির্বাচনী বিধি চালু হয়ে গিয়েছে। একটা করা যায় কি না তা নিয়ে পরিষ্কার মতামত দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। কিন্তু তারা পাথরের মতো নীরবতা পালন করে চলেছে। যদি তারা ‘হ্যাঁ’ বলে তাহলে ব্যাপারটা বিজেপির পক্ষে গেল। আর ‘না’ বলে তাহলে বিজেপির বিপক্ষে গেল। নির্বাচন কমিশনের সাহস হচ্ছে না এ ব্যাপারে পরিষ্কার মতামত দিতে। তাহলে তারা কীসের সাংবিধানিক নিরপেক্ষ সংগঠন? যদি কমিশন ‘হ্যাঁ’ বলে তাহলে বিজেপি দুর্নীতির ছুতো দিয়ে বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার করতে শুরু করবে। আসলে সেটাই শুরু করেছে।
বিজেপি’র পক্ষ থেকে বাংলার তৃণমূলের বুথ সভাপতিদের নাম তুলে দেওয়া হয়েছে। এনআইএ তাদের ডেকে পাঠাচ্ছে এ কাজটা কতবড় গর্হিত কাজ সেটা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েও কোনও উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের আসন যেন জগদ্দল পাথরের মতো অনড় হয়ে আছে। ঝড়ে বিধ্বস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়াবে রাজ্য সরকার। তার অনুমতি দিতে গড়িমসি করছে নির্বাচন কমিশন। ৩৯/৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় মানুষগুলো অসহায় অবস্থায় আকাশের নীচে বাস করছে। সম্বল রাজ্য সরকারের দেওয়া ২/৩টা ত্রিপল। রাজ্য সরকার তাকিয়ে আছে নির্বাচন কমিশনের দিকে। এতবড় স্বনামন্য একটা সংঘঠন এমন অমানবিক হচ্ছে কী করে? শুধুই রাজনীতি? বিজেপির হাতের পুতুল হয়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা? ভবিষ্যতের মসৃণ পথগুলো যাতে সঠিক থাকে তার প্রত্যাশায়? নামীদামি আমলারা ভূলে গেছেন রাজনীতির চাইতে মানুষের জীবনের দাম অনেক বেশি। নির্বাচন কমিশন গঠন এবং পূর্বের কথা একটু বলা প্রয়োজন বোধ করছি। পূর্বে ১ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন ছিল। পরে আইন করা হয় যে ৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিশন হবে। কারা সদস্য হবেন তা ঠিক করার জন্য একটি কমিটি সংসদ ঠিক করে দিয়েছে। দেশের প্রধান বিচার পতি প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলনেতা হলেন সেই ৩ জন। নামের কোনও প্রস্তাব থাকলে তাদের তাদের জীবনপঞ্জি অন্য দু’জন সদস্যকে পাঠাবেন প্রধানমন্ত্রী। যদি একমত না হন তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে হবে। প্রধান বিচারপতি এবং বিরোধী দলনেতা আলাদা নাম প্রস্তাব করতে পারেন। মোদিবাবু দেখলেন এটা মহামুশকিল। নিজের পেটোয়া লোকদের কমিশনে যুক্ত করা খুব মুশকিল। সুতরাং সবচাইতে ভাল গঠন প্রক্রিয়ার আইন ও নিয়মকেই পাল্টে দেওয়া হল। প্রধান বিচারপতি বাদ হল। একজন ক্যাবিনেট পার্যায়ের মন্ত্রীকে যুক্ত করা হল এবং তিনি নির্বাচিত হবেন প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা। ফলে সদস্য দাঁড়াল প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা এবং একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। নিজের বশংবদের কমিশনের সদস্য করতে আর কোনও সমস্যা রইল না। এমন একটা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে আমাদের সত্যি ভাল বোধ হয় না। কিন্তু তাদের কাজকর্ম ইদানীং দেশবাসীকে যুগপৎ হতাশ এবং ভীত করে তুলেছে। নির্বাচনী বিধি চালু হয়ে যাবার পর প্রধানমন্ত্রী বাংলার মানুষের একটা টাকা ফেরত দেবার ঘোষণা করেছেন। তিনি একবারও বলেননি তিনি নির্বাচন কমিশনের অনুমতি বা পরামর্শ নেবেন। তিনি বলেছেন আইনের পরামর্শ নেবেন। নির্বাচন কমিশন ‘টুঁ’ শব্দটি করেননি। প্রধানমন্ত্রীর কি কোনও ছাড় আছে? গত লোকসভা নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রীর এক বিমান থেকে অন্য হেলিকপ্টারে বিরাট কালো বাক্স পাল্টানোর ছবি সবাই দেখেছেন। নির্বাচন কমিশন সেদিনও চুপ ছিলেন আজও চুপ! এবারও কত বাক্স পাচার হয়ে এবং তাতে কী থাকবে সে-ব্যাপারে কমিশন চুপ থাকবে— তাদের এখনকার কাজকর্ম দেখেই তা মনে হয়।
বিজেপি’র নেতাদের গাড়িতে প্রচুর প্রচুর টাকা পাওয়া যাচ্ছে। বিজেপি নেতারা লাঠি বা ত্রিশূল হাতে ভোট প্রচার করছেন। উত্তেজনা ছাড়াচ্ছেন। বিজেপি নেতারা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে সবচাইতে খারাপ কথাগুলো প্রচারে ব্যবহার করছেন। প্রত্যেকটা বিষয় হল নির্বাচনবিধির বাইরে। নির্বাচন কমিশনের কোনও হেলদোল নেই। তাহলে এদের কাজ কী? বিজেপির তল্পিবাহক হয়ে নির্বাচন চালানো? মানুষ তা সহ্য করবে ন।
১৯৫২ সালে সুকুমার সেন নামে বঙ্গসন্তানের নেতৃত্বে সাড়ে ৪ মাসে ভারতে প্রথম লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল। ভোট করতে ৩ মাসের বেশি সময় লাগছে। বিজেপি দেশটাকে পিছনে টানছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেষ করছে। একমাত্র প্রতিষেধক ইভিএম মেশিনে বিজেপি-বিরোধী বোতাম টেপা। বাংলায় ঘাসের উপর জোড়া ফুলে ছাপ দিন— এটাই এখন কর্তব্য।