সর্পাঘাত! প্রতি বছর অন্তত ১৮ থেকে ২৭ লক্ষ মানুষকে সাপে কাটে। ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, যাঁদের মধ্যে অন্তত ৫৮০০০ জন ভারতীয়! সাপের বিষ (বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘ভেনাম’) আরও অন্তত ৪ লক্ষ মানুষকে আজীবন পঙ্গু করে দেয়! তৃতীয় বিশ্বের উষ্ণপ্রধান অঞ্চলে সর্প-ভেনাম সাক্ষাৎ যমদূত হয়ে হাজার হাজার পরিবারকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।
আরও পড়ুন-আজ ভুবনেশ্বর যাচ্ছেন দিমিত্রি-কাউকোরা, সাহাল পুরো ফিট : হাবাস
প্রতিষেধক বলতে একটিই— অ্যান্টি-ভেনাম। অর্থাৎ, সাপের বিষে যেসব বিষাক্ত প্রোটিন অণুঘটক আছে তাদের নিষ্ক্রিয় করে যে অ্যান্টিবডি। একাধিক সাপের বিষ অল্প পরিমাণে ঘোড়া, ভেড়া, উঠের দেহে ইঞ্জেক্ট করা হলে তাতে জন্তুটির মৃত্যু হয় না, বরং ‘বিদেশি প্রোটিন’র বিরুদ্ধে একাধিক অ্যান্টিবডি তৈরি করে শরীরের রোগ-প্রতিরোধকারী ইমিউন ব্যবস্থা। এই অ্যান্টিবডি সমষ্টির নাম অ্যান্টি-ভেনাম।
মুশকিল হচ্ছে, অ্যান্টি-ভেনাম সব সময় কাজ করে না। এই পদ্ধতিতে অনেক অ্যান্টি-ভেনাম প্রস্তুত করাও বেশ ঝক্কির ব্যাপার, সবসময় গুণগত মান বজায় থাকে না। যেমন, দক্ষিণ ভারতের সাপের বিষ থেকে তৈরি অ্যান্টি-ভেনাম বাংলায় সর্পাঘাত চিকিৎসা করতে মাঝেমধ্যে ব্যর্থ হয়, নয়ত প্রচুর পরিমাণে লাগে। আবার পশুদেহ থেকে নিষ্কাশিত বলে অ্যান্টি-ভেনামের প্রভাবেই কখনও রোগীর ভয়ানক অ্যালার্জি দেখা যায়। তাই বহুদিন ধরে চেষ্টা চলছে এক ইউনিভার্সাল অ্যান্টি-ভেনাম বানাতে— যা পৃথিবীর বেশিরভাগ সর্প-ভেনামের বিরুদ্ধে কার্যকরী হবে এবং প্রভূত পরিমাণে ল্যাবরেটরিতেই বানানো সম্ভব হবে। এ-মাসে এমনই একটি দুর্দান্ত গবেষণার ফলাফল বিশ্বখ্যাত জার্নাল সায়েন্টিফিক অ্যাডভান্সেস-এ প্রকাশিত হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার স্ক্রিপ্স রিসার্চ ইন্সটিটিউট, লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান অফ সায়েন্সের বিজ্ঞানীদের এই যৌথ প্রচেষ্টার খবরে সর্বত্র সাড়া পড়ে গেছে।
আরও পড়ুন-মহিলা ভোট চাই, আমাকেই সহ্য করতে পারে না! মোদিকে খোঁচা মুখ্যমন্ত্রীর
কাজটি দুরূহ, এবং তার বড় কারণ হল সমস্ত বিষধর সাপের বিষে আছে ১০টির বেশি অণুঘটক। নানা ধরনের ফস্ফোলাইপেস, মেটালোপ্রোটিনেস, হায়ালুর্যাকনিডেস, সেরিন প্রটিএস, নিউক্লিএস, লেকটিন, মায়োটক্সিন ইত্যাদি দিয়ে পরিপূর্ণ সব বিষধর সর্পভেনাম। সেই জন্যেই সাপে কাটলে একাধিক অঙ্গে নানা ধরনের বিষক্রিয়া দেখা যায়। তার সঙ্গে আছে দুই ‘রাঘব বোয়াল’ বিষ— এলাপিড গোষ্ঠীর সাপেদের (গোখরো, কেউটে, কিং কোবরা, ক্রেইত বা কালাচ, ইত্যাদি) ভেনামে থাকে স্নায়ু-ধ্বংসাত্মক নিউরোটক্সিন বিষ। আর ভাইপার গোষ্ঠীর সাপের (যেমন চন্দ্রবোড়া) বিষে থাকে রক্তকোষ এবং রক্তজালিকা ধ্বংসকারী হেমোটক্সিন। মুশকিল হল বিভিন্ন সাপের ভেনামে এইসব বিষাক্ত অণুঘটক অভিন্নও নয় এবং বিষগুলির পরিমাণও সমান নয়। এইসব প্রতিকূলতার জন্যে এক সাথে সব ক’টি করাল ককটেলের বিরুদ্ধে প্রথাগত পদ্ধতিতে ইউনিভার্সাল অ্যান্টি-ভেনাম তৈরি করা অসম্ভব।
এখানেই কাজ করেছে বিজ্ঞানী দলের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা। প্রবল পরাক্রমশালী সর্পবিষের কেল্লায় একটি ছিদ্র খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা। ব্যাপারটা হল— এলাপিড গোষ্ঠীর সাপদের বিষে আছে থ্রি ফিঙ্গার টক্সিন (3FTx) নামক এক ধরনের বিষ-প্রোটিন। নিউরোটক্সিন। 3FTx-এর বিষক্রিয়ায় শুরু হয় পক্ষাঘাত, অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু অনিবার্য।
আরও পড়ুন-এর নাম বোমা! আদালতের রায় ৪৮ ঘণ্টা আগে গদ্দার জানল কীভাবে? প্রশ্ন নেত্রীর
বিভিন্ন সাপের ভেনামে আছে হরেকরকমের 3FTx। কিন্তু, ১৬টি বিষধর এলাপিড সাপের 3FTx বিষ-প্রোটিনদের নিয়ে বায়োইনফোরম্যাটিক্স বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখালেন যেহেতু সবগুলিই 3FTx প্রোটিন-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, এদের সবার মধ্যে অন্তত কিছুটা মিল আছে। যেমন একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আংশিক সাদৃশ্য দেখা যায়, তেমনি সবগুলি 3FTx বিষ-প্রোটিনগুলি মধ্যে একটি অংশ ‘common’।
এই প্রাথমিক তালিকা থেকে তিনটি ক্রেইত, তিনটি কোবরা এবং দুটি মাম্বার 3FTx-কে ইউনিভার্সাল অ্যান্টি-ভেনাম তৈরির জন্যে বেছে নিলেন বিজ্ঞানীরা। এরপর এই ৮টি 3FTx বিষ-প্রোটিনগুলিকে সেল কালচারের সাহায্যে গবেষণাগারের প্লেট/ ফ্ল্যাস্কে প্রভূত পরিমাণে তৈরি করা হয়েছে। ফলে, আর সর্প-গ্রন্থি থেকে ভেনাম বের করার প্রয়োজন নেই; যা দরকার ল্যাবেই তৈরি হচ্ছে।
আরও পড়ুন-কলকাতা পুলিশের কৃতিত্বেই চক্রান্তের পর্দাফাঁস
এবার অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে অ্যান্টিবডি তৈরির পালা। প্রথাগত ভাবে নয়, এক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি তৈরি হল এককোষী ছত্রাক Saccharomyces cerevisiae-এর কোষের মধ্যে। জটিল প্রক্রিয়া, কিন্তু মোদ্দা কথা এই পদ্ধতিতে তৈরি হল ৬ হাজার কোটি (হ্যাঁ!) অ্যান্টিবডি। লাইব্রেরির তাকে যেমন বই সাজানো থাকে, তেমনি ছত্রাক কোষগুলির গায়ে সাজানো এই সুবিশাল অ্যান্টিবডি-লাইব্রেরি। এর মধ্যে থেকে বাছতে হবে এমন একটি অ্যান্টিবডি যেটি সব 3FTxকেই নিষ্ক্রিয় করতে পারে। এক অস্ত্রে সবাই ঘায়েল। যত বড় লাইব্রেরি তত বেশি সম্ভাবনা জীবনদায়ী অ্যান্টিবডি খুঁজে পাবার।
কয়েক রাউন্ড খোঁজাখুঁজির পরে হাতে এল সাকুল্যে ১৬টি অ্যান্টিবডি (অর্থাৎ, ৬ হাজার কোটি থেকে ১৬!)। এদের মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট অ্যান্টিবডিটিকে বেছে নিয়ে তাকে মানব দেহের পক্ষে আরও উপযোগী করে (humanize) ফেলা হল; নাম দেওয়া হল 95Mat5. দেখা গেল 95Mat5 ৭টি সাপের 3FTx বিষ-প্রোটিনের সঙ্গে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এঁটে যায় এবং একবার আটকে গেলে চট করে ছেড়ে দেয় না।
কিন্তু, 95Mat5 সর্পদংশন থেকে প্রাণ বাঁচাতে পারে কি? একদল ইঁদুরের দেহে ব্ল্যাক মাম্বা, কেউটে, শঙ্খচূড় (কিং কোবরা) এবং many-banded krait-এর ভেনাম ইঞ্জেক্ট করা হল চামড়ার তলায় (subcutaneous) আর শিরায় (intravenous)। আরেক দল ইঁদুরের ক্ষেত্রে ইঞ্জেক্ট করার আগে ভেনামের সঙ্গে 95Mat5 অ্যান্টিবডি মিশিয়ে দেওয়া হল। ফলাফলে সবাই চমৎকৃত। কারণ, প্রথম দলের সব ইঁদুরের মৃত্যু হলেও, 95Mat5 মাম্বা, কেউটে এবং ক্রেইতের ভেনাম থেকে দ্বিতীয় দলের প্রায় সব ইঁদুরদের রক্ষা করল। এমনকী পক্ষাঘাতও রোধ হল। ব্যতিক্রম শঙ্খচূড়ের ভেনাম। ‘রাজা সাপের’ বিষের বিরুদ্ধে ১২ ঘণ্টা লড়াই করে শেষে ব্যর্থ হল 95Mat5। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, শঙ্খচূড়ের ভেনামের জন্যে কেবল 95Mat5 যথেষ্ট নয়, আরও অ্যান্টিবডি প্রয়োজন।
আরও পড়ুন-ফের আমেরিকায় দুই ভারতীয় পড়ুয়ার মৃত্যু!
শেষ পরীক্ষা। কেউটে আর মাম্বার বিষ ইঞ্জেক্ট করা হল আগের মতোই। কিন্তু, তার ৫ থেকে ২০ মিনিট পরে দেওয়া হল 95Mat5 ‘প্রতিষেধক’। ঠিক যেমন সাপে কাটার অন্তত কিছুক্ষণ পরে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অ্যান্টি-ভেনাম দেওয়া হয়।
আবার সাফল্য! পরে দেওয়া হলেও 95Mat5 প্রাণ বাঁচাতে সফল। পরিমাণেও কম লাগছে। IISc-এর অধ্যাপক কার্তিক সুনাগারকে জানালেন যে ওঁদের বড় কাজ এখন ভারতের সব প্রান্তের বিষধর এলাপিড সাপের বিরুদ্ধে এই 95Mat5-এর কার্যকারিতার মাপযোগ করা। হ্যাঁ, বিজ্ঞানীরা নিজেরাই গবেষণাপত্রে লিখেছেন 95Mat5 একা ইউনিভার্সাল অ্যান্টি-ভেনাম হতে পারে না। একই পদ্ধতিতে আরও নতুন অ্যান্টিবডি, বিশেষত ভাইপার ভেনামের বিরুদ্ধে বানাতে হবে। এখনও পথ চলা বাকি। তবে, সব বিষধর সাপের বিরুদ্ধে একটি সহজলব্ধ ইউনিভার্সাল অ্যান্টি-ভেনাম তৈরির প্রয়াস বেশ কয়েক কদম এগিয়ে গেছে।