চরম মূল্যবৃদ্ধি, আর বেকারত্বের জোড়া ফাঁদে বিপর্যস্ত দেশবাসীকে ২০৪৭ সালের স্বপ্ন দেখিয়ে ২৪’-এর ভোট চাইতে বেরিয়েছেন। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি রোধে তাঁর সরকারের অবস্থান কী— সেই দিশাই নেই মোদির বক্তব্যে। দেশের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি এড়িয়ে মেরুকরণ, বিভাজন ও প্রতিশ্রুতির ‘বেসাতি’ করছেন নরেন্দ্র মোদি। তৃণমূল নেত্রী যথার্থই বলেছেন, ‘মূল্যবৃদ্ধিই গদি ওল্টাবে মোদির।’ তাঁর কথায়, ‘জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। প্রচারবাবুর মুখে তো কোনও কথাই নেই!’ সত্যিই তাই। মূল্যবৃদ্ধির এই ঝাঁজেই বীতশ্রদ্ধ মানুষ ছুঁড়ে ফেলে দেবে বিজেপি সরকারকে। আস্ফালন করে লাভ হবে না বিজেপির। প্রথম দু’দফার ভোটে এপাশ-ওপাশ-ধপাস হয়ে গিয়েছে। দফারফা অবস্থা। আর বাকি যে পাঁচটা দফা হবে, তার জন্য বুক দুরু দুরু করছে ওদের। ৪০০ পার তো দূরের কথা। ২০০ ভি নেহি হোগা পার। ইস বার পগার পার। এবার আর কেন্দ্রের ক্ষমতায় ফেরা হচ্ছে না নরেন্দ্র মোদির। বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়া আটকে যাবে ২০০ আসনে। কেন্দ্রে পরিবর্তন এখন সময়ের অপেক্ষা।
আরও পড়ুন-নির্বাসিত হর্ষিত, বরুণ-বন্দনায় রাসেল নাইটদের সামনে এবার মিশন মুম্বই
জিনিসপত্রের দাম কত বেড়েছে, কই মোদিবাবু আপনার মুখে তো একটাও কথা নেই? ব্লাড শুগার, ক্যান্সার, ব্লাড প্রেশার, কোলেস্টরেলের মতো নিত্যদিনের ওষুধের দাম কতটা বাড়িয়ে দিয়েছে এই মোদি! গ্যাসের দাম কত? বিজেপিকে বলুন, কেন ভোট দেব? বিনা পয়সায় আমরা দিচ্ছি রেশন, আর তুমি বিনা পয়সায় দিচ্ছ ভাষণ! আগামীতে খাব কী, পরবই কী? প্রচারবাবু ফিরলে, জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়বে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, হাওয়া কিন্তু রটে গিয়েছে। একটাই আওয়াজ দেশ জুড়ে— ‘বিজেপি হটাও দেশ বাঁচাও’।
আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে দেশের মানুষের জীবনে দুর্দিন নামিয়ে এনেছেন নরেন্দ্র মোদি। আর নয়! এবারই সঠিক সময়। প্রধানমন্ত্রী পাল্টে দিতেই হবে।
আরও পড়ুন-ফেডারেশনের উদ্যোগে সংগ্রহশালা হতে পারে কলকাতায়
গত ১০ বছর ধরে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী পদে থেকে দেশের মানুষকে ঠকিয়েছেন। তাই এবার উচিত শিক্ষা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে পাল্টাতে হবে। ইতিমধ্যে দু’দফায় নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। তাতে বাংলার ৬টি কেন্দ্র সহ দেশের ১৯০টি আসনে নির্বাচন হয়েছে। তৃতীয় দফার নির্বাচন ৭ মে। তার আগে সাধারণ মানুষের কাছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যথাযথ বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। বলেছেন, এমনভাবে এবার ইভিএম-এ ভোট দিতে হবে যাতে তার অভিঘাত দিল্লি অবধি পৌঁছে যায়। অভিষেকের ভাষায়, বোতাম টিপবেন এখানে, ভূমিকম্প হবে দিল্লিতে। আগামী দিন বিজেপিকে বিসর্জন দিতে হবে। বাংলার হকের টাকা কেড়ে নেওয়া মোদি সরকারের কাছ থেকে এবার দিল্লির গদি কেড়ে নিতে হবে। এমনভাবে ভোট দেবেন, যাতে ৪ জুন বাক্স খোলার পর বিজেপি নেতারা চোখে সর্ষে ফুল দেখে। ওদের উচিত শিক্ষা দিন। পাল্টে দিন।
২০১৯-এর ভোটে লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে মোদির দল একাই দখল করে ৩০৩টি আসন। কিন্তু শাসক দল ভোট পায় ৩৭ শতাংশের কিছু বেশি। এর অর্থ, দেশের বেশিরভাগ মানুষ মোদির দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে অনাস্থা জানিয়েছেন। কিন্তু ভোট ভাগাভাগির মারপ্যাঁচে প্রতিপক্ষ থেকে অনেকটা এগিয়ে দৌড় শেষ করে (সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটের প্রতিনিধি না হয়েও) মোদির দল। রাজনীতির এই আশ্চর্য ললাটলিখন নিয়ে সংসার চালানো মোদিবাহিনী যথেষ্ট বিদ্রুপ ও কটাক্ষের জবাব দিতে প্রথমে ঘোষণা করেছিল এবার ৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৪০০ আসন পাবে এনডিএ। কিন্তু ১৯ ও ২৬ এপ্রিল দু’ দফার নির্বাচনে ভোট পড়ার হার দেখে কপালে ভাঁজ পড়েছে গেরুয়া শিবিরের। যার জেরে মুখ থেকে শরীরের ভাষা বদলে গিয়েছে পদ্ম নেতাদের। আর সেইভাবে শোনা যাচ্ছে না ৪০০ পারের বজ্র নির্ঘোষ, উন্নয়নের ‘অসত্য’ দাবি, বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চকে ১৫০ আসনে আটকে রাখার দম্ভ। বরং সব ছেড়ে ধর্মীয় মেরুকরণের স্পষ্ট বার্তা ফেরি করতে শুরু করেছে মোদি অ্যান্ড কোম্পানি। কিন্তু বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, অসাম্যের নাগপাশে বন্দি মানুষকে বিভাজনের ভোকাল টনিকে ভুলিয়ে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফেরা যাবে কি না— সেই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে বিজেপির অন্দরেই। তবে তারাও কি অশনি সঙ্কেত দেখছে?
আরও পড়ুন-ভোটের প্রচারে দেওয়াল লিখনে ফিরে এসেছে আবার কার্টুনের ব্যবহার
নির্বাচনে ভোটের হার কম হলে তা শাসক গোষ্ঠীর সর্বনাশ ডেকে আনে, এটাই চেনা দস্তুর। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬৭ শতাংশের বেশি। ২০১৪-তে ৬৬ শতাংশের বেশি। দু’বারই ৫০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে সরকার গঠন করেন নরেন্দ্র মোদি। নিজেদের ভোটের হার বাড়াতে এবার সর্বতোভাবে চেষ্টা শুরু করেছে বিজেপি। কিন্তু দু’দফার ভোট শেষে দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে গতবারের চেয়ে ভোট পড়েছে কম। ডাবল ইঞ্জিনের রাজ্য যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে দ্বিতীয় দফার ভোটে মথুরাতে ৪৭ শতাংশ, মিরাটে ৫৫ শতাংশ, বাগপতে ৫২.৭ শতাংশ, আলিগড়ে ৫৪.৪ শতাংশ, গাজিয়াবাদে ৪৮.০২ শতাংশ ভোট পড়েছে। এইসব কেন্দ্রে গতবারের চেয়ে গড়ে ১০ শতাংশ কম ভোট পড়েছে। ভোট কম হওয়ার কারণ হিসেবে তীব্র গরমকেই ঢাল করেছে বিজেপি নেতৃত্ব। কিন্তু আসল কথাটা অন্য। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাতের মতো ডাবল ইঞ্জিনের রাজ্যগুলিতে সংখ্যালঘু ও যাদবদের বেশি সংখ্যায় ভোটের লাইনে দেখা গেলেও তেমনভাবে চোখে পড়েনি রাজপুত ও ক্ষত্রিয়দের। অন্য একটি ব্যাখ্যা হল, এবার গেরুয়া শিবিরের প্রচারে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে ‘মোদি গ্যারান্টি’র কথা। কিন্তু ২০১৪ বা ২০১৯-এর মতো এবার মোদি-ম্যাজিক বা মোদি-ঝড়ের অস্তিত্ব চোখে পড়ছে না। তাই ভোটের লাইনে গেরুয়া সমর্থকদের চেনা মুখের অনুপস্থিতিও চোখে পড়েছে।
আরও পড়ুন-কোভিশিল্ডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, জানাল অ্যাস্ট্রোজেনেকা
১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা, গ্রাম সড়ক যোজনা-সহ একাধিক প্রকল্পের টাকা না দিয়ে বাংলাকে ভাতে মারার চক্রান্ত কেন্দ্রের বিজেপি সরকার করেছে। বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আমলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার-সহ যেভাবে উন্নয়ন হচ্ছে, আগামীদিন ইন্ডিয়া জোট কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর ঠিক সেভাবেই দেশের মানুষকে নাগরিক পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার সঙ্কল্প তৃণমূল কংগ্রেসের। তবে তার আগে চব্বিশের মহারণে মোদি হটানোর লক্ষ্যে একজোট হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতেই হবে।
কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে এবার ভোট বাক্সে বিজেপিকে যোগ্য জবাব দেবেন বাংলার মানুষ। ইন্ডিয়া সরকার গঠনে আপামর বাংলার মানুষ অগ্রণী ভূমিকা নেবেন। প্রগতিশীল, সংবেদনশীল সরকার তৈরি করব আমরা। পরিবর্তনের সরকারে চালিকাশক্তি হবে তৃণমূল কংগ্রেস।
এবারের লড়াইটা দেশের ঐক্য, সম্প্রীতি আর সংবিধান বাঁচানোর। দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার… এই লড়াইটা জেতা তাই খুব দরকার।