মোবাইল ক্যামেরা সেলফি মোডে। এক কিশোর সেই ক্যামেরা অন করেই ইভিএমে দিয়ে চলেছে একের পর এক ছাপ্পা। আর সবটাই বিজেপির হয়ে। উত্তরপ্রদেশের ফারুকাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের ঘটনা। ১৩ মে তোলা ভাইরাল ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, কিশোর বয়সি একটি ছেলে বুথে গিয়ে পরের পর বিজেপির বোতামে আঙুল টিপছে। সে-ই দেখাচ্ছে, ভোট গিয়েছে বিজেপিতেই। ভিভিপ্যাট মেশিনে দেখা যাচ্ছে বিজেপির নির্বাচনী প্রতীক পদ্মফুলের ছবি। আধার কার্ড দেখিয়ে ওই ‘ছাপ্পা ভোটদাতা’ রীতিমতো গর্বের সঙ্গে একটি করে ভোট দিচ্ছে আর বলছে, ‘এই দেখুন আমি এতগুলো ভোট দিলাম। আটটা।’ বুথের আধিকারিকের সামনে কীভাবে এক কিশোর বিজেপি এমপি মুকেশ রাজপুতের নামের পাশে পরপর ভোট দিয়ে গেল? মডেল কোড অব কনডাক্ট তো মোদি কোড অব কনডাক্টে পরিণত করেছে কমিশন। নির্বাচন কমিশন যে বিজেপিরই বি টিম, তা ফের প্রমাণ হচ্ছে। আসলে, মোদি জানেন, এবার তাঁকে গদি ছাড়তেই হবে। তাই ছাপ্পা ভোট করিয়ে ৪০০ পেরতে চাইছেন। আসলে ৪২০-র মতোই কাজ করছে বিজেপি। কমিশন রেফারি হয়েও লাল কার্ড দেখাচ্ছে না। এর পরেও যদি বিজেপি বলে, নিরপেক্ষ ভোট করাতে চাইছে নির্বাচন কমিশন, তবে তিনি মিথ্যেবাদী।
এবারের লোকসভা নির্বাচনের সাত দফার মধ্যে শেষ হয়েছে পাঁচটি পর্যায়ের ভোটগ্রহণ। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতামন্ত্রীরা বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভায় দাবি করতে শুরু করেছেন যে, দল নাকি ইতিমধ্যেই ম্যাজিক ফিগার পেরিয়ে গিয়েছে! বিশেষ করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একাধিক নির্বাচনী জনসভায় চার দফাতেই বিজেপির ম্যাজিক ফিগার পেরিয়ে যাওয়ার দাবি করেছেন। বিজেপি ইতিমধ্যেই ম্যাজিক ফিগার পেরিয়ে যাওয়ার দাবি করছে। কিন্তু এহেন সমীকরণে বাংলায় কত আসন, তারই হিসেব নেই বিজেপির কাছে। এই পরিস্থিতিতে দলের রাজ্য পার্টিকে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জরুরি নির্দেশ দিয়েছে। পঞ্চম দফার ভোটপর্ব মিটলেই বাংলা থেকে ‘জয়’-এর সম্ভাব্য পরিসংখ্যান দিল্লিতে পাঠিয়ে দিতে হবে বাংলার নেতাদের। তারপরেও মিথ্যেবাদী ছাড়া কেউ দাবি করতে পারে বিজেপি ম্যাজিক ফিগার পেরিয়ে গেছে!
আরও পড়ুন- মর্মান্তিক! বিমানের ধাক্কায় মৃত্যু ৩৬ টি ফ্লেমিঙ্গো পাখির
প্রধানমন্ত্রী মানে বিজেপির প্রচারমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দাবি করছেন, তিনি সবাইকে পাকা ঘর দিয়েছেন, কারও প্রতি ভেদাভেদ করেননি। আর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘সভা করে কেউ যদি বলে মোদি আবাসের টাকা দিয়েছেন, তাঁকে গ্রামে বেঁধে রাখুন। কারণ, ২০২১ সালে বিজেপি এ রাজ্যে হেরে যাওয়ার পর গ্রামীণ আবাসের একটা টাকাও দেয়নি। আমি যেগুলো বলছি রেকর্ড করে রাখুন। মোদিজি যদি প্রমাণ করতে পারেন, ২০১৭-১৮ সালে তৈরি আবাসের তালিকার উনি ১০ পয়সাও দিয়েছেন, আমি প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইব। রাজনীতি ছেড়ে দেব।’ বোঝাই যাচ্ছে, ‘মিথ্যাবাদী’ এই একটি শব্দই নরেন্দ্র মোদির প্রচারের জবাব হতে পারে।
রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদারও তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ আবাস যোজনায় ২০২২-২৩ থেকে ২০২৪-২৫— এই তিনটি অর্থবর্ষে বাংলার জন্য অর্থবরাদ্দ করেনি কেন্দ্র। অথচ এই তিন অর্থবর্ষেই অসমের মতো ছোট রাজ্যের জন্য কেন্দ্র বরাদ্দ করেছে ১২ হাজার ৭৬ কোটি টাকা, আর গুজরাতের জন্য ১ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। দেশের ২৭টি রাজ্যের জন্য এই প্রকল্পে কেন্দ্র টাকা দিলেও, বাংলাকে দেয়নি। নরেন্দ্র মোদি বারবার বলছেন, বৈষম্য করেন না। অথচ, ধর্মের ভিত্তিতে মেরুকরণের অঙ্ক তাঁর ভাষণে শোনা যাচ্ছে। বাংলাকে বঞ্চনার বিষয়টি নির্দ্বিধায় ‘ভুলে’ গিয়ে দাবি করছেন, তিনি টাকা দিয়েছিলেন। তৃণমূল সরকার মানুষের কাছে পৌঁছয়নি। এরপরেও যদি কেউ বলেন তিনি বা তাঁর দল বাংলাকে বঞ্চনা করেননি, তাহলে তিনি বা তাঁরা মিথ্যেবাদী ছাড়া আর কিছুই নয়।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর একটা অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন। তিনি বলছেন, ‘১০০ দিনের টাকা, আবাস যোজনা… সব আটকে রেখেছে কেন্দ্রের মোদি সরকার। জঙ্গলমহলের ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ায় চাষযোগ্য জমি কম। ১০০ দিনের কাজের উপর মানুষ নির্ভরশীল। সেই টাকা বিজেপি বন্ধ করে রেখেছে। পুরুলিয়ার বান্দোয়ানে দেখেছি, দুই আদিবাসী ভাই তাঁদের মাকে নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। রাত তখন ১০টা। তাঁদের প্রশ্ন করলাম, আপনারা বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে কেন? তাঁরা বলেছিলেন, ১০০ দিনের টাকা পাইনি। ব্যবস্থা করে দিন। এই দুর্দশা প্রত্যেকের। তাই, আপনাদের অনুরোধ, খাল কেটে কুমির আনবেন না। বিজেপিকে একটাও ভোট নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপনাদের ১০০ দিনের কাজের টাকা ফিরিয়েছেন। ঘরও বানিয়ে দেবেন।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘ওরা (বিজেপি) সংবিধান বদলাতে চাইছে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করতে নেমেছে। এর ফলে আদিবাসী জনজাতির মানুষও আতান্তরে পড়বেন। আমাদের সরকার আপনাদের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিচ্ছে, আর মোদি সরকার প্যান-আধার লিঙ্ক করার নামে হাজার টাকা কেটে নিচ্ছে। আপনারাই বিচার করুন, কাকে ভোট দেবেন।’
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশের কীর্তিকলাপ গত কয়েক বছরে যে ভয়ঙ্কর মাত্রায় পৌঁছেছে, তার পরে তার কর্তা এবং নেপথ্য-নায়কদের কাছে সুশাসন, রাজধর্ম, নৈতিকতা ইত্যাদি আশা করাও বাতুলতা। সর্বোচ্চ আদালতের কঠোর ভর্ৎসনার পরে তাঁদের নতজানু হয়ে মার্জনা ভিক্ষা করা উচিত ছিল। বলা উচিত ছিল, রাষ্ট্রক্ষমতা এবং আইনের ছক কাজে লাগিয়ে এই বেআইনি অত্যাচার তাঁরা আর কখনও করবেন না। কিন্তু মার্জনাভিক্ষা দূরস্থান, ন্যূনতম চক্ষুলজ্জার বোধটুকুরও কোনও চিহ্নমাত্র এই শাসককুলের আচরণে দেখা যায়নি। লজ্জা নিজেও বোধ করি এমন নির্লজ্জ দুঃশাসনের সামনে মুখ লুকোতে ব্যস্ত। সমালোচক বা প্রতিবাদীকে মাসের পর মাস অন্যায় ভাবে বন্দি করে রেখে মোদি সরকার বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছে, চুলোয় যাক আইন প্রয়োগের যথাযথ পদ্ধতি, গোল্লায় যাক নৈতিকতা, শিকেয় উঠুক গণতন্ত্র— রক্ষকরা অনায়াসে ভক্ষকের রূপ ধরবে। এটাই রামরাজ্যের নয়া মডেল।
এই সব মিথ্যেবাদীদের দূর করে সত্যনিষ্ঠ রাজনীতির সপক্ষে সরকার গড়ার জন্য এবারের ভোট। আগামী দফাগুলোতে তাই বেছে নিন জোড়া ফুল প্রতীককে, আপনার নিজের প্রতীক হিসেবে।