আকাশে রঙিন আলোর বন্যা

হঠাৎ করেই দীর্ঘ একুশ বছর পর আবার বিস্তীর্ণ আকাশের বুকে রঙবেরঙের আলোর ঝলকানি, নয়নাভিরাম দৃশ্য, বিজ্ঞানীদের ভয় হয় ওই আলোর পরেই না কোনও গাঢ় অন্ধকার এই সভ্যতাকে গ্রাস করে ফেলে! লিখছেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

আজকাল বড় বিস্ময়ে মোর কাটে দিবানিশি!
এ-যেন চমকে দিয়ে একবারের জন্য সূর্যের আলো ঝলমলিয়ে উঠল তমসাচ্ছন্ন রাতের আকাশে। গত ১০ মে ভারতবর্ষের লাদাখের হ্যানলে শহরের রাতের আকাশে অকস্মাৎ দেখা মেলে সবুজ, বেগুনি এবং লাল রঙের আলোর রোশনাই। বিস্ময়ে তাই হতবাক! এটি সরাসরি সূর্যের আলো নয়, তবে সূর্যের অন্তঃস্থিত করোনা অঞ্চলের রাসায়নিক তড়িৎচুম্বকীয় বিক্রিয়ার দরুন সৃষ্ট ‘আঘাত তরঙ্গে’র ফলে পৃথিবীর বুকে যে ভূ-চুম্বকীয় ঝড় ধেয়ে আসে, এটা তার প্রভাবে সৃষ্ট আলোর প্রতিপ্রভা। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় অরোরা বোরিয়ালিস বা নর্দার্ন লাইটস। ওইদিন ১০ মে শুক্রবার পৃথিবীর অন্য প্রান্তে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড-সহ আরও বেশ কিছু দেশে দুপুরবেলা নাগাদ আকাশের বুকে লাল-নীল-সবুজের বন্যা বয়ে যায়। ভারতবর্ষে এই ঘটনার একটি সংক্ষিপ্ত প্রভাব দেখা যায় লাদাখের রাতের আকাশে।

আলোর রোশনাই
সাধারণত এই অরোরা সুমেরুপ্রভা হয়ে সুমেরু অঞ্চলে এবং কুমেরুপ্রভা হয়ে কুমেরু অঞ্চলে দেখা গেলেও এবারে তা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষের বুকেও দেখা গেল। রীতিমতো অবাক করে ১০ মে শুক্রবার ওই অঞ্চলে দুপুর ১২টা বেজে ৩৭ মিনিটে, তখন ভারতীয় সময় প্রায় রাত্রি ১০টা বেজে ৭ মিনিট, প্রথম আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মেইন প্রদেশ থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, সিটল ওয়াশিংটন, শিকাগো, মিন্নেপলিশ ফারগো, নর্থ ডাকোটা, গ্রিন বে উইসকনসিন, ও দক্ষিণে আলবামা, জর্জিয়া, ফ্লোরিডায় এবং আইসল্যান্ড, কানাডা, স্ক্যান্ডেনেভিয়া প্রভৃতি স্থানে এই আলোর রোশনাই পরিলক্ষিত হয়।
পৃথিবীর উচ্চ-অক্ষাংশযুক্ত দুই প্রান্ত, আর্কটিক এবং আন্টার্কটিক অঞ্চলেই এই আলোর রোশনাই দেখা যায়। উত্তর গোলার্ধে এটি নর্দার্ন লাইটস বা অরোরা বোরিয়ালিস, আবার দক্ষিণ গোলার্ধে এটি সাদার্ন লাইটস বা অরোরা অস্ট্রালিস নামে পরিচিত। এই আলোর প্রতিপ্রভা আমাদের সৌরজগতের অনেক গ্রহ, প্রাকৃতিক উপগ্রহ, ধূসর খর্ব গ্রহ এবং বেশ কিছু ধুমকেতুর মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত সূর্য থেকে সৃষ্ট সৌর ঝড় বা সোলার স্টর্ম, যা পৃথিবীর বুকে আবার ভূ-চুম্বকীয় ঝড় বা জিও-ম্যাগনেটিক স্টর্ম নামেও চিহ্নিত, তার দরুন এইরূপ অরোরা তৈরি হয় পৃথিবীর আকাশে। সৌর ঝড়ের দ্বারা সৃষ্ট আঘাত তরঙ্গ পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসার সময় বয়ে আনে চার্জড পার্টিকল বা আহিত কণা, যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এবং চুম্বক ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় রাসায়নিক বিক্রিয়া করে এইধরনের আলোর সৃষ্টি করে।

আরও পড়ুন- মর্মান্তিক! বিমানের ধাক্কায় মৃত্যু ৩৬ টি ফ্লেমিঙ্গো পাখির

ঝড়ের পূর্বাভাস
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি শহরস্থিত ওই দেশের বাণিজ্যিক বিভাগের অধীন জাতীয় সামুদ্রিক এবং বায়ুমণ্ডলীয় প্রশাসনিক সংস্থা ‘ন্যাশনাল ওশিয়েনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নওঅঅ)’ অনেক আগেই বৈজ্ঞানিক মাধ্যমে এইরূপ অকস্মাৎ ভূ-চুম্বকীয় ঝড়ের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল। এই সংস্থাটি অন্তরীক্ষ এবং সামুদ্রিক আবহাওয়া, গভীর সমুদ্র উন্মোচন, জলজ বাস্তুতন্ত্র তথা সামগ্রিক পরিবেশের তদারকি করে। এই সংস্থাটির অধীন স্পেশ ওয়েদার প্রেডিকশন সেন্টার ১০ মে পৃথিবীর বুকে ধেয়ে আসা সোলার স্টর্মের ব্যাপারে আগেই সচেতন করেছিল; তবে ওইদিন সম্ভাব্য সময়ের আগেই পৃথিবীর প্রান্তে এর প্রভাব দেখা যায়। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর এই সংস্থা কর্তৃক প্রেরিত আবহাওয়া সম্পর্কিত উপগ্রহ ‘জিওস্টেশনারি অপারেশনাল এনভায়রনমেন্টাল স্যাটেলাইট-১৬ (গোজ-১৬)’-এর সৌর অতিবেগুনি চিত্রগ্রাহক বা সোলার আল্ট্রাভায়োলেট ইমেজার গত ৯ মে ইস্টার্ন ডে-লাইট টাইম অনুযায়ী ওই অঞ্চলের স্থানীয় সময় দুপুর ২টো, ভারতীয় সময় রাত্রি ১১টা ৩০ মিনিটে সক্রিয় সৌর কলঙ্ক বা ‘সানস্পট ৩৬৬৪’তে কিছু উচ্চপর্যায়ের কার্যকলাপ লক্ষ্য করে। ওইগুলো হল উচ্চশক্তিসম্পন্ন সূর্যের করোনা অঞ্চলের ভর নিষ্কাশন প্রক্রিয়া বা করোনাল মাস ইজেকশনস, যা সোলার স্টর্ম নামে চিহ্নিত।
আমেরিকান সংস্থা ‘নওঅঅ’ মহাশূন্যে কর্তব্যরত উপগ্রহের মাধ্যমে কমপক্ষে সাতটি ‘করোনাল মাস ইজেকশনস (সিএমই)’ (Coronal Mass Ejections) সম্পর্কে সচেতন করেন। এদের মধ্যে প্রথম স্টর্মটি আমেরিকার বুকে আছড়ে পড়ে ১০ মে শুক্রবার দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ; বৈজ্ঞানিকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রায় তিন-চারদিন ওই নির্দিষ্ট এলাকায় এর প্রভাব দেখা যায়।

করোনাল মাস ইজেকশনস
করোনাল মাস ইজেকশনস (Coronal Mass Ejections) হল সূর্য থেকে বহির্মুখী আহিত প্লাজমা এবং করোনা অঞ্চল থেকে চৌম্বক ক্ষেত্রের নির্গমন। সূর্যের নিম্নকরোনা অঞ্চলে আহিত প্লাজমার মধ্যে একটি উচ্চশক্তিসম্পন্ন পাকানো চৌম্বক ক্ষেত্র যখন ভিন্নধর্মী ঘূর্ণন বেগের দরুন শক্তির বিপুল পার্থক্য তৈরি করে তখন ওই অঞ্চলে ‘ম্যাগনেটিক রিকানেকশন’ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে নতুন চৌম্বক ক্ষেত্র গঠিত হয়। এই সময় হঠাৎ করেই তড়িৎচুম্বকীয় শক্তির একটি আহিত স্রোত পৃথিবীর দিকে বইতে শুরু করে, যা সোলার স্টর্ম বা জিও-ম্যাগনেটিক স্টর্ম বা ভূ-চুম্বকীয় ঝড় হিসেবে পরিগণিত।
সূর্য থেকে বহির্মুখী এই ঝড় তার মধ্যে স্থিত উচ্চপর্যায়ের চৌম্বক ক্ষেত্র বয়ে নিয়ে আসে পৃথিবীর বুকে, প্রায় ২৫০০-৩০০০ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড গতিবেগে। মহাকাশের প্রায় এক চতুর্থাংশ আকারের সবচেয়ে দ্রুত ঝড়টি সূর্য থেকে প্রায় ১৫-১৮ ঘণ্টার মধ্যে পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়, বাকিরাও দু’এক দিনের মধ্যে এসে পড়ে; সঙ্গে নিয়ে আসে বিলিয়ন সংখ্যক চার্জড পার্টিকলস বা আহিত কণা। এই সব আহিত কণা এবং চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ম্যাগনেটোস্ফেয়ার এবং আয়নোস্ফেয়ারে বিক্রিয়া ঘটালে এই ঝড়ের প্রভাব আমরা অনুভব করি। সূর্যের এল-১ কক্ষপথ অঞ্চলে স্থিত আমেরিকার ‘ডিপ স্পেস ক্লাইমেট অবজারভেটরি’ উপগ্রহ সর্বপ্রথম এই ধরনের স্টর্মের আগমনের কথা জানান দেয়।

ঝড়ের অনুভূতি
সারা বিশ্ব জুড়ে সেই ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর-নভেম্বরের হ্যালোউইন সোলার স্টর্মের পর আবার এ-বছর ১০ মে আমরা চাক্ষুষ করলাম এই ধরনের ভূ-চুম্বকীয় ঝড়। বৈজ্ঞানিকদের মতে সূর্য তার ১১ বছরের চক্র পূরণের উচ্চ পর্যায়ের ‘সোলার ম্যাক্সিমাম’ স্তরে অবস্থান করছে; তাই বিভিন্ন সানস্পট খুব শক্তিশালী সোলার স্টর্ম তৈরি করছে। এই স্টর্মের জন্যই পৃথিবীর আকাশে দেখা যায় রঙিন আলোর রোশনাই। ভূ-চুম্বকীয় এই ঝড়ের কারণে উপগ্রহীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হতে পারে, রেডিও কমিউনিকেশন সিস্টেম এবং জিপিএস ডিগ্রেডেশন সিস্টেমও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঝড়ের ফলে পৃষ্ঠতলীয় এবং পৃথিবীর নিকট-কক্ষপথীয় পরিকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে; বৈদ্যুতিক ‘পাওয়ার গ্রিড’ নষ্ট হয়ে ভোল্টেজ কন্ট্রোল জাতীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে, নেমে আসতে পারে অন্ধকার! বৈজ্ঞানিক মহল ব্যস্ত। যদিও সাধারণ মানুষ খালি চোখে এই জিও-ম্যাগনেটিক স্টর্মের জন্য যে নৈসর্গিক সৌন্দর্য অবলোকন করেছেন তাতেই তাঁরা বিস্মিত! নওঅঅ-এর স্পেস ওয়েদার প্রেডিকশন সেন্টারের নির্দেশক বিজ্ঞানী ক্লিনটন ওয়ালেস মন্তব্য করেছেন, এটি একটি অস্বাভাবিক এবং উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা।

Latest article