কৃষ্ণচন্দ্র ভৌমিক, অঙ্কের মাস্টারমশাই। আয়লা আসুক বা রিমেল— ক্রিং-ক্রিং ঘন্টি বাজিয়ে ছাত্রের বাড়িতে পৌঁছানোর রেকর্ড রয়েছে তাঁর। স্টাইলিশ এডুকেশন সেন্টারের যুগে এখনও আদ্যিকালেই রয়ে গেছেন ভৌমিক স্যার। বড় সরকারি অফিসার ছিলেন তিনি। কিন্তু পড়ানোর নেশা আর তার সাধের সাইকেলটা আজও ছাড়তে পারেননি তিনি। অবসরের পর শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সাইকেল-চড়ে আজও ছাত্র পড়িয়ে বেড়ান। প্রচণ্ড ঝড়-জলে ওই সাইকেলের ক্রিং-ক্রিং শব্দ শুনলেই বিরক্ত হয়ে যেত অনিকেত। বৃষ্টির দিনেও রেহাই নেই! স্যার আসছেন পড়াতে।
আরও পড়ুন-জিটিএ-র উদ্যোগে কার্সিয়াঙে পর্যটকদের জন্য প্যারাগ্লাইডিং
সাইকেলের সঙ্গে আমাদের শৈশব- কৈশোরের কত স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে কাকুতি-মিনতি করে আদায় করা সেই সাইকেলের প্যাডেলে পা রাখলেই নিজেকে মনে হত খোলা আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো পাখির মতো। সাইকেলে চড়েই কোচিং, স্কুল, বন্ধুর বাড়ি সব।
সাইকেলের বেলের টিং-টিং শব্দ শুনলেই মনে পড়ে যায় ছড়াকার মোহিত ঘোষ সেই ছড়াটি—
“টিং টিং বাজে বেল ওই চলে সাইকেল, চাকা দুটো ঘুরঘুর নিয়ে যায় বহুদূর।” আজও মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়।
চেনওয়ালা সাইকেলের জনক ছিলেন স্কর্টিশ কারপ্যাট্রিক ম্যাকমিলন। একবার একটি বাচ্চা মেয়েকে সাইকেল থেকে ধাক্কা মেরেছিলেন বলে পাঁচ শিলিং জরিমানা দিতে বাধ্য হন।
কবি সুনির্মল বসুর সেই কবিতা
“ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং, সবে সরে যাওনা, চড়িতেছি সাইকেল দেখিতে কি পাওনা, ঘাড়ে যদি পড়ি বাপু প্রাণ যাবে অন্ত, পথ মাঝে রবে পড়ে ছিরকুটে দন্ত।’’
পড়ে মনে হয় যেন তিনি যেন সেই ম্যাকমিলনের কথাই মনে করে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
আজ থেকে বছর ১৫-২০ আগেও সাইকেল চালানোর একটা রেওয়াজ ছিল। সেই সময় এত পেট্রোল-চালিত যানবাহনের এত রমরমা ছিল না। তখন তরুণ-তরুণীর স্বপ্নের মূল্যবান রতন ছিল এই দূষণহীন যানটি। অতিমারির সময় করোনা সংক্রমণের ভয়ে ছোঁয়াচ এড়িয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে সাইকেলের জনপ্রিয়তা রাতারাতি বেড়ে গিয়েছিল কয়েক গুণ। কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরু-দিল্লি-চেন্নাই, সব বড় শহরের রাস্তাতেই আনলক পর্বে আরও বেশি করে দেখা মিলেছে সাইকেল আরোহীদের। ভারতের মতো দেশে সাইকেল নামক বাহনটির অবদান কিন্তু কম নয়। অনেকেই হয়তো জানেন না যে এই দেশে এমন একটি রাজ্য আছে যা সাইকেল রাজধানী নামে পরিচিত। সেই রাজ্যটি হল পশ্চিমবঙ্গ। ২০১৯ থেকে ২০২১ জাতীয় স্বাস্থ্য সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের ৭৮.৯% পরিবারে আছে দু’চাকার সাইকেল। রাজ্য সরকারের ‘সবুজ সাথী’ প্রকল্পের কারণে এই নজির। সারা দেশ জুড়ে প্রায় ৫০.৪% মানুষ সাইকেল চালায়। বাংলায় সেখানে সাইকেল চালানোর হার ৭৮.৯%। বাংলার পরেই আছে উত্তরপ্রদেশ। দেশের প্রথম সাইক্লিং হাইওয়ে উত্তরপ্রদেশের আগ্রা থেকে ইটাওয়া পর্যন্ত। উত্তরপ্রদেশে সাইকেল চালানোর হার ৭৫.৬%।
আরও পড়ুন-গ্রেফতার সেবক হাউসে হামলার মূল পাণ্ডা ধৃত
সিনেমার সাইকেলরা
সাইকেলের একটি সুন্দর বাংলা নাম আছে। সেটি হল দ্বিচক্রযান। পৃথিবীর বহু দার্শনিক লেখক এই দ্বিচক্র যানের সঙ্গে সমাজ সংসারের তুলনা করেছেন। যেমন আইনস্টাইন বলেছেন,‘‘জীবন হল বাইসাইকেল চালানোর মতো, সব সময় চালাতে হয়, নাহলে পড়ে যেতে হয়”। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন যে, “আধুনিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বাইসাইকেল, তাতে তেল লাগে না কয়লা লাগে না। মানুষ বলতে গেলে নিজের পায়েই চলছে কিন্তু গতি কত বেড়ে গেছে’’। ১৯৪৮ সালের মুক্তি পাওয়া ইতালীয় সিনেমা ‘বাইসাইকেল থিপস’ দেখেনি সিনেমা- প্রিয় এমন মানুষ খুব কম আছেন। সৌদি আরবের প্রথম নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা হাইফা আল মনসুরের সিনেমা ওয়াজদা সাইকেল নিয়ে নির্মিত এক অনবদ্য সিনেমা।
সিনেমায় সাইকেলের কথা আসতেই মনে পড়ে যায় আমির খান অভিনীত ছবি জো জিতা ওহি সিকান্দারের। সেই সিনেমাটির আসল বিষয়ই ছিল বাইসাইকেল রেস। ‘বিচারক’ সিনেমায় উত্তমকুমার তো সাইকেল থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন অরুন্ধতী দেবীর মুখে আমার মল্লিকা বনে গানটি শুনে। পিকু সিনেমাতে অমিতাভ বচ্চন হইচই ফেলে দিয়েছিলেন কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে। দিল্লি প্রবাসী এই চরিত্রটির সাইকেল মানেই ছিল নস্টালজিয়া।
আরও পড়ুন-উন্নয়ন ও সমুদ্রসাথী প্রকল্পে কাঁথির মন জয় করেছেন মুখ্যমন্ত্রী
সাইকেল প্রেমে মগ্ন বাঙালি
কলকাতার বুকে এমন একটা সময় ছিল যে সময় ক্লাবে সন্ধবেলার আড্ডাতে যে সমস্ত সাহেবরা যোগ দিতে যেতেন তাঁরা সকলেই সাইকেল চালিয়ে আসতেন। সুন্দরী বিদেশিনীরা সাইকেল চালিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতেন, ডাক্তারবাবু রোগী দেখতে যেতেন সাইকেল চালিয়ে। উনিশ শতকের শেষ দশকের সাইকেল চালানো নিয়ে এতটাই মাতামাতি ছিল যে ১৮৯৭ সালে বেঙ্গল সাইকেল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা হয়। সেই সময় সবাই সাইকেল প্রেমে মগ্ন ছিল। সাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে ইংরেজরা সংখ্যায় বেশি হলেও বাঙালিরাও কিন্তু সাইকেল চালানোতে পিছিয়ে ছিল না। জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রী অবলা বসু যখন ইংল্যান্ডে ছিলেন সেই সময় তাঁরা সাইকেল চালানো রপ্ত করেন। এবং এই সাইকেল চালানোর বিদ্যা তাঁরা তাঁদের বিশিষ্ট বন্ধু তথা প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ডাঃ নীলরতন সরকার ও তাঁর স্ত্রী নির্মলাদেবীকেও সাইকেল চালানো শিখিয়ে দেন। না এনারা সকলে মিলে সকালবেলায় মেছুয়া বাজার স্ট্রিটে সাইকেল চালাতেন।
বিপ্লবের অনুপ্রেরণা
উনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই বিদেশে মেয়েরা ব্যাপকভাবে সাইকেল চালানো শুরু করে। সেই সময় স্বাধীন চেতনার বিকাশ ঘটানোর গতি আর বাড়ির বাইরে আসার স্বাধীনতা দিয়েছিল এই সাইকেল। শুধু বিদেশে নয়, সেই সময় বাংলাতেও মেয়েদের সাইকেল চালানোর কথা শোনা যায়। রবীন্দ্রনাথের অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্ত বিপ্লবী কার্যকলাপে যুক্ত হওয়ার জন্য রোজ ভোরবেলা বেথুন কলেজের ক্যাম্পাসে সাইকেল চালানো শিখতেন। এছাড়াও সে-সময় যাঁরা বিপ্লবী ছিলেন তাঁরা সাইকেলে চড়েই তাদের মিটিং-মিছিলে যেতেন। এছাড়া অন্যান্য কাজের জন্যও তাঁরা সাইকেল ব্যবহার করতেন। বলা যেতে পারে সেই সময় সাইকেলই ছিল তাঁদের একমাত্র বাহন। বর্তমানে আমাদের জীবনযাপন শৈলী অনেকটাই বদলে গেছে। বদলে গেছে সমাজের পরিকাঠামো। আজ মানুষের কাছে সময় বড়ই কম। সবাই ছুটছে। আর এই ছোটার দৌড়ে খানিকটা পিছিয়ে গেছে সাইকেল। আর সেই কারণেই বাইসাইকেলের গুরুত্ব বোঝাতে পালিত হয় বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস।
আরও পড়ুন-যৌন-কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত রেভান্নার ৬ জুন পর্যন্ত হেফাজত
বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস
২০১৮ সাল থেকে ক্যালেন্ডারের পাতায় যুক্ত হয়েছে একটি বিশেষ দিন। সেই দিনটি হচ্ছে বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস। আমরা যারা ছোটবেলা থেকে সাইকেল চালিয়ে অভ্যস্ত বা যারা ছোটবেলায় বাবা-মায়ের কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করে তবেই নতুন সাইকেল পেতাম তারা ভাবতেই পারি না যে ক্যালেন্ডারে এমন একটি দিন যুক্ত হতে পারে। আসলে কথায় আছে দিন বদলায় রং বদলায়। আর এই দিন বদলের কাব্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে আমাদের ছোটবেলার সেই সাইকেল।
লেসজেক সিবিলক্সি (Leszek Sibilski) ছিলেন একজন পোলিশ প্রফেসর। তিনিই প্রথম তাঁর কমিউনিটির মানুষদের নিয়ে অর্থাৎ পোলিশ কমিউনিটির মানুষদের নিয়ে জাতিসংঘের (UN) কাছে বিশ্ব সাইকেল দিবস পালন করার জন্য আবেদন করেন। এর আগে তিনি তাঁর সমাজবিজ্ঞানের ক্লাস থেকে শুরু করেছিলেন একটি প্রচারণা অভিযান। ২০১৫ সালে তিনি বাইসাইকেল নিয়ে রীতিমতো একটি অ্যাকাডেমিক প্রোজেক্ট চালু করেছিলেন। খুব দ্রুতই এটি ব্যাপক এক আন্দোলনের রূপ নেয়। তার সাথে সাথে সেই সময় ৫৬টি দেশ বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস পালনের সমর্থন জানায়। আর এরপরেই রাষ্ট্রসংঘের মহাসভা অর্থাৎ ইউনাইটেড নেশন জেনারেল অ্যাসেম্বলি ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে ঘোষণা করে, ৩ জুন বিশ্বব্যাপী বাইসাইকেল দিবস পালন করা হবে। আর এরপর থেকেই প্রতিবছর ৩ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস। আর এই বাইসাইকেল দিবসের উদ্দেশ্য হল আমাদের সাধারণ জীবনযাত্রার নিত্যনৈমিত্তিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে আগের মতোই সাইকেল চালানোর অভ্যাস যাতে গড়ে ওঠে। আর এই সাইকেল চালানোর মধ্য দিয়েই মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য যাতে মজবুত হয় সেদিকেই লক্ষ্য রাখা। এই বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস পালন করার আরও একটি লক্ষ্য হচ্ছে সাইকেলের দীর্ঘায়ু অর্থাৎ সাইকেল যাতে আমাদের কাছে লুপ্তপ্রায় হয়ে না যায়। এছাড়াও সাইকেলের স্বতন্ত্রতা এবং বহুমুখিতাকে স্বীকৃতি দেওয়া। এছাড়াও সাইকেলকে নির্ভরযোগ্য, সাশ্রয়ী, পরিচ্ছন্ন, সহজ এবং পরিবেশগত ভাবে উপযুক্ত টেকসই পরিবহণের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়ার বার্তা দেওয়ার জন্য বিশ্ব সাইকেল দিবস পালন করা হয়ে থাকে।
সাইকেল যোদ্ধারা
মনে আছে চন্দন বিশ্বাস এবং নীলাঞ্জন সাহাকে? একজন পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান এবং আর একজন স্ট্রিট মিউজিক করেন শহরের রাস্তা থেকে সুন্দরবনের গ্রামে। ২০২২ সালে বিশ্ব বাইসাইকেল দিবসে এঁদের দু’জনকেই সম্মান জানানো হয়েছিল। কারণ এঁদের দু’জনেরই বাহন ছিল একটি করে সাইকেল। সাইকেল নিয়ে চন্দন বেরিয়ে পড়তেন পাহাড়ের চড়াই- উতরাইয়ে। তিনি এমন রাস্তায় ঘুরতে পছন্দ করেন যেখানে কম লোকই পাড়ি দেন। শুধু সাইকেল চলে ঘুরে বেড়ানোই নয়, তিনি সবকিছু নিয়েই বানিয়ে ফেলেন একটি ডকুমেন্টরি। যার নাম ‘চরৈবেতি’। আন্তর্জাতিক কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে এই ডকুমেন্টরিটি দেখানোও হয়েছিল।
আরও পড়ুন-কন্যাশ্রী, সবুজসাথী-সহ নানা আর্থিক পরিষেবা আদিবাসী পড়ুয়াদের সাফল্যের চাবিকাঠি
নীলাঞ্জন কলকাতার রাজপথে স্ট্রিট মিউজিক নিয়ে কাজ করবেন বলে ঠিক করেন। আর সেই কারণেই তিনি মিউজিক্যাল স্যান্ডউইচ নামে একটি মিউজিক ব্যান্ড বানিয়ে ফেলেন। এখন অনেকেই তাঁকে মিউজিক্যাল স্যান্ডউইচ নামেই চেনে। নীলাঞ্জন কলকাতা স্ট্রিট মিউজিক ফেস্টিভ্যাল, মাউন্টেন মিউজিক্যাল ফেস্টিভ্যালের মতো অনুষ্ঠানে পারফর্ম করেছেন। নিজের উদ্যোগে তিনি কলকাতা ইন্সট্রুমেন্টাল জ্যামিং ফেস্টিভ্যালের মতো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। গোলপার্কের মোড়ে বাইসাইকেলকে সঙ্গী করে নীলাঞ্জন স্যান্ডউইচ বিক্রির পাশাপাশি পথ চলতি শ্রোতাকে গানও শোনাতেন। সাইকেল নিয়ে বলতে গেলে একজন পাগল প্রেমিকের কথা বললে শেষ হয় কথা। ওড়িশা রাজ্যের এক গাঁয়ের তরুণ শিল্পী প্রদ্যুগ্নকুমার মহানন্দিয়া প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করার জন্য ছয় হাজার কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে চলে গিয়েছিলেন বালটিক সাগরের তীর ঘেঁষা দেশ সুইডেনে।