কণাদ দাশগুপ্ত : প্রতি রাজ্যে একটি নির্বাচিত সরকার আছে। তার পরেও রাষ্ট্রপতির বা কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট হিসেবে মনোনীত ‘রাজ্যপাল’ পদটি বহাল রাখার যুক্তিসঙ্গত কোনও কারণ নেই, প্রয়োজনীয়তাও নেই৷
সেই ১৯৩৫ সালের Colonial ভারত শাসন আইনে রাজ্যপাল বা গভর্নরের পদের কথা বলা হয়েছিলো৷ ইংরেজরা যখন স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবল চাপে দেশবাসীর হাতে স্বশাসনের আংশিক অধিকার তুলে দেয়, তখনই চালাকি করে তৈরি করে এই গভর্নরের পদ৷ গভর্নরের কাজ ছিলো ব্রিটিশ রাজের প্রতিনিধি হিসাবে প্রাদেশিক সরকারের সব কাজে নাক গলানো৷ কারন, তখনকার দেশ-শাসকরা প্রাদেশিক সরকারকে কাজের যেমন স্বাধীনতা দেয়নি, তেমনই প্রাদেশিক সরকারের গ্রহণ করা কর্মসূচিকেও মনে করতো ‘দেশ-বিরোধী’৷ তাই
গভর্নরের মাধ্যমে সরকারের উপর নজরদারি চালাতো৷
সাম্প্রতিক কিছু ধারাবাহিক ঘটনা বুঝিয়ে দিচ্ছে গভর্নর বা রাজ্যপালের কাজের ধরন স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরেও কিছুই বদলায়নি৷ কেন্দ্রে এবং রাজ্যে একই দলের সরকার থাকলে, তিনি ‘রাজ্যপাল’৷ তাঁর কাজ মূলত দু’টি, মন্ত্রীদের শপথ নেওয়ানো আর বিধানসভায় ভাষন দেওয়া৷
আরও পড়ুন-আজ বিকেলেই প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক, দেখে নেওয়া মঙ্গলবারের কর্মসূচি
আর রাজ্যে কেন্দ্রের বিরোধী দলের সরকার থাকলে তখন তিনি ১৯৩৫ সালের আইনমাফিক ‘গভর্নর’৷ তখন তাঁর কাজ কেন্দ্রীয় সরকার বা কেন্দ্রের শাসক দলের প্রতিনিধি হিসাবে প্রাদেশিক সরকারের সব কাজে নাক গলানো৷ এবং বড়ই বিস্ময়কর, সংবিধান বহির্ভূত এই ‘নাক গলানো’র কাজ ‘গভর্নর’ করেন, সংবিধানের দোহাই দিয়েই৷
তাহলে দেশের সংবিধানে এ বিষয়ে ঠিক কী লেখা আছে ? প্রথমেই বলা আছে, দেশের কোনও রাজ্যপালই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন৷ তাই রাজ্য প্রশাসন যে আইনের ভিত্তিতে চালিত হয়, সেখানে তিনি নির্ভেজাল একজন ‘বহিরাগত’৷ রাজ্যপালের মতামত বা অবস্থান সেই রাজ্যের একজন মানুষেরও মতামত বা অবস্থান প্রতিফলিত করে না। রাজ্যপাল কোনও তথ্য রাজ্য প্রশাসনের কাছে চাইতে পারেন, সেই তথ্যের বিষয়ে কোনও পরামর্শ দিতে পারেন৷ ব্যস, ওইটুকুই। সংবিধানের দোহাই দিয়ে রাজ্য প্রশাসনের কোনও কাজকর্ম নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করা, ট্যুইট করা বা সাংবাদিক সম্মেলন করার অধিকার সংবিধান কোনও রাজ্যপালকেই দেয়নি৷ সংবিধানে বাবাসাহেব আম্বেদকর এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “সংবিধান অনুসারে রাজ্যপাল কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।” আরও বলেছেন, “যে কোনও সরকারকে ঠিক ভাবে কাজ করতে হলে সেই রাজ্যের রাজ্যপালকে তাঁর সীমারেখা মেনেই নিজের ভূমিকা পালন করতে হবে।” ইদানিং দেশে দু-একজন এমন রাজ্যপাল দেখা যাচ্ছে, যারা ওই চেয়ারে বসার পরই গোটা সংবিধান বইটিকে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে রেখেছেন৷ এবং এরা সেই সব রাজ্যের রাজ্যপাল, যেখানে কেন্দ্রের শাসক দলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দল রাজ্যের ক্ষমতায় রয়েছে৷ এনাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে পদটির নাম ‘গভর্নর’ লেখা থাকলেও, আসলে তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের একজন ‘এজেন্ট’ মাত্র৷ যে কোনও এজেন্টের কাজের ধরনই হলো তাঁর নিয়োগকর্তার স্বার্থরক্ষা করা৷ এক্ষেত্রেও তো তাই-ই হচ্ছে৷ দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রের শাসক দলের বিরোধী কোনও দলের সরকার রাজ্যে ক্ষমতাসীন থাকলে সেই সরকারকে কাজ করতে বাধা দেওয়াই এই ধরনের রাজ্যপালদের মূল কাজ৷ সমস্যা হলো, এ ধরনের ঘোরতর অসাংবিধানিক কাজের প্রতিকারের কোনও পথ সংবিধান প্রণেতারা বলে যাননি৷
আরও পড়ুন-অসম-মিজোরাম সীমান্তে সংঘর্ষ : ক্ষোভ ও শোকপ্রকাশ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্যপাল প্রায়শই বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দলের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে অভিযোগ করেন, পশ্চিমবঙ্গে আইনবিধির শাসন নেই। শুনতে অবাক লাগে এসব৷ যে রাজ্যের রাজ্যপাল, যিনি ঘটনাচক্রে রাজ্যের উচ্চতম সাংবিধানিক পদাধিকারী, তিনি নিজেই তো সংবিধানকে তোয়াক্কা করেন না৷ সংবিধান মেনে চলতেও বিশেষ পছন্দ করেন না৷ অথচ তিনি গলা ফুলিয়ে চিৎকার করেন, রাজ্য প্রশাসন নাকি সংবিধান মেনে চলে না৷ বিষয়টি শুধু হাস্যকরই নয়, দুর্ভাগ্যজনক বটে৷ ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই রাজভবনে প্রবেশ করার পর রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় ঠিক কতবার যে তাঁর সাংবিধানিক সীমা অতিক্রম করেছেন, তা তিনি নিজেও জানেন না৷ রাজ্যপাল পদটি নেহাতই আলঙ্কারিক শীর্ষপদ৷ মোগল আমলের সুবেদারদের মতো স্বাধীন ভারতের রাজ্যপালদেরও কোনও নিজস্ব ক্ষমতাই নেই৷ এটাই বাস্তব, একথাই সংবিধান বলছে৷ মানতে খুব কষ্ট হলেও এটা মানতেই হবে৷ রাজ্য সরকারের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন রাজ্যপাল, সংবিধানের কোথায় আছে এসব লেখা? ধনকড়কে মাথায় রাখতে হবে, বিজেপি-প্রেরিত বহিরাগত কোনও ‘পর্যবেক্ষক’ তিনি নন৷ ঘটনাচক্রে তিনি একজন রাজ্যপাল, যে রাজ্যপালের অনুরাগ এবং উৎসাহ সাংবিধানিক সীমা অতিক্রম করা৷ প্রথম দিন থেকেই দেখা গিয়েছে, বাংলা এবং বাংলার বাসিন্দাদের স্বার্থ তাঁর ভাবনায় নেই। এমন একটি নজিরও দেখা যায়নি৷ আর সব বাদ দিলেও ভয়াবহ এই করোনা-কালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন রাজ্যবাসীর স্বার্থে ভ্যাকসিন জোগান সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করেই চলেছেন, বারংবার প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছেন, চিঠি দিচ্ছেন, তখন তো এই ইস্যুতে অন্তত মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াতে পারতেন রাজ্যপাল৷ বিজেপি’র স্বার্থ সুরক্ষিত করতে তিনি যতখানি এনার্জি খরচ করছেন, তার একআনা চেষ্টাও তিনি করেননি বঙ্গবাসীকে সুরক্ষিত রাখতে৷ বাংলার রাজ্যপাল হলেও তিনি তাঁর নিজের কাজের মাধ্যমেই প্রমান করেছেন আসলে তিনি বাংলার মানুষের ভালো চাননা, তিনি বঙ্গ-বিরোধী৷
রাজ্য-রাজ্যপাল বিরোধ এই প্রথম নয়৷ ১৯৫৯ সালে কেরলে নাম্বুদ্রিপাদের নেতৃত্বাধীন প্রথম কমিউনিস্ট সরকারকে বরখাস্ত করার পর রাজ্যপাল পদ নিয়ে প্রথম বিতর্ক শুরু হয়েছিল৷ বিক্ষিপ্তভাবে বাংলা-সহ আরও দু-একটি রাজ্যে এই বিরোধ দেখা দিয়েছিলো৷ কিন্তু কখনই সিরিয়াসলি ভাবা যায়নি এই পদটি বহাল রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে৷ ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও এই পদটি কেন রাখা হয়েছে, তা নিয়ে কখনই গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়নি৷ সংবিধান তৈরির সময়ও ভাবা হয়নি৷
সংবিধান প্রণেতারাও এ বিষয়ে সহমত ছিলেন না৷ সুকৌশলে বিষয়টি ছাড়া হয়েছিলো লোকসভার হাতে৷ পাশাপাশি বলা হয়েছিলো, এই পদের অবলুপ্তি ঘটানো হবে না৷ তখনই প্রশ্ন ওঠে, পদটি না হয় থাকলো, কিন্তু এই পদে যিনি আসবেন, তিনি নির্বাচিত হবেন? নাকি কেন্দ্রের শাসক দলের মনোনীত হবেন? লোকসভা জানায়, নির্বাচিত নন, মনোনীতই হবেন রাজ্যপালরা৷ এর পর থেকেই Colonial ভারত শাসন আইন অনুসরন করে রাজ্যপালদের বানানো হলো কেন্দ্রের এজেন্ট৷ সমস্যা ক্রমশ বাড়তেই থাকলো৷ পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রের শাসক দলের নির্দেশে সেই দলের স্বার্থরক্ষা করার অভিযোগ ওঠে একাধিক রাজ্যপালের বিরুদ্ধে৷ আইনপ্রণেতারা কখনই ভাবলেন না, রাজ্যপাল সমান্তরাল প্রশাসন চালাতে পারেন না। এ ধরনের অভিযোগ বৃদ্ধি পেলেও রাজ্যপালের সাংবিধানিক কর্তব্য ও তাঁর লক্ষ্ণণরেখা কী, তার পর্যালোচনা লোকসভায় হয়নি৷ রাজ্যপাল সাংবিধানিক পদ। তার নির্দিষ্ট কিছু দায় ও দায়িত্ব আছে । কিন্তু সব ক্ষেত্রেই নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রিসভার পরামর্শ মেনে তাঁকে চলতে হয়। যারা চলেন না, তাঁরা পরিকল্পিতভাবে সংবিধান অমান্য করছেন সাংবিধানিক পদে থেকেই৷ সংবিধানের অমর্যাদা করা অপরাধ৷ অথচ আইন না থাকায় সংবিধান লঙ্ঘন করেও পার পেয়ে যান এই অপরাধে যুক্ত ‘অপরাধী’ রাজ্যপালরা৷
আরও পড়ুন-পেগাসাসে অচল সংসদ, ভরকেন্দ্র তৃণমূল, এককাট্টা বিরোধীরা
এই ফাঁক পূরণ করার জন্য আইন আনা দরকার৷ বিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা এখন বড়ভাবে দেখা দিয়েছে৷ আলোচনা প্রয়োজন:
◾রাজ্যপাল পদ কতখানি প্রয়োজনীয়?
◾ রাষ্ট্রপতি যদি নির্বাচিত হন, রাজ্যপাল কেন নির্বাচিত হবেন না ?
◾যে সব রাজ্যপাল সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর চেষ্টা করছেন, তাঁদের অপসারনের পদ্ধতি কী?
◾রাজ্যপাল নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের মতামত আবশ্যিক হবে না কেন ?