“জয় মা কালী, পাঁঠা বলি!”

রাজনীতির আঙিনায় কিছু সাধক আছেন, যাঁরা ভৈরবী শক্তির জাগরণকে আশ্রয় করে হিংসার প্রসৃতি ঘটাতে চান। সেই হিংস্র ডাকাতরা দেবীর রণচণ্ডী মূর্তি দেখেই চম্পট দেবে। লিখছেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

Must read

প্রতিবেদন : শোনা বৎস! সম্বোধন-শব্দে তিনটি প্রকার আছে, এবং তাতে আবার স্বরক্ষেপের মাত্রাভেদ আছে— ইংরেজিতে যেমনটা rising intonation, falling intonation, এবং rising and falling intonation. আমাদের ব্যাকরণ এবং দর্শনশাস্ত্রে সম্বোধন-শব্দ নিয়ে বহুল আলোচনা আছে, সেই বিস্তারে না গিয়ে শুধু এইটুকু বলি যে, সম্বোধনের মধ্যে একটা রসশাস্ত্রীয় প্রকরণ আছে, যেটা অনেকে জানেনই না। বিশেষত, আমাদের এই ভারতবর্ষে সেই প্রকরণ সবচেয়ে বেশি যুক্ত হয়েছে শাস্ত্রীয় সম্বোধন কিংবা দেবতা-সম্বোধনের সঙ্গে, সেকথা সামান্য উচ্চারণ করলেই বুঝে ফেলবেন আপনারা। এমনকী ধর্ম-সম্প্রদায়-ভেদে আমাদের সেই দেবতা সম্বোধনই মঙ্গলামঙ্গল সূচনা করতে পারে, সম্বোধন সেখানে কুশল এবং অকুশলের অন্বয়ী হয়ে উঠতে পারে। আজ এই কালীপুজোর দিনে যেখানে শ্মশান-কালী, ভৈরবী শক্তির সমস্ত জাগরণ ঘটবে, সেখানে যাঁরা কালীপুজো করেন, তাঁরা দুইভাবে শক্তির সম্বোধন-সম্মোহন করেন। প্রথম প্রকারের কালীভক্তরা কালীপুজো করেন নিজেদের মধ্যে সেই শক্তি-সঞ্চয়ের জন্য, যাতে করে সেই অন্তঃসূত দৈবীশক্তির করুণায় অনন্ত অশুভ-শক্তিকে দূরীভূত করে আপন সাধ্য বস্তুকে অতি সহজেই করায়ত্ত করতে পারেন। এখানে দ্বিতীয় প্রকারের যে সাধকরা আছেন, তাঁরা কিন্তু সেই ভৈরবী শক্তিকে জাগ্রত করতে চান শুধুমাত্র হিংসার জন্য, প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য, অথবা যে কামনার পূর্তি ঘটল না, সেটাকে অশুভ প্রকারে প্রতিহিংসা-ভরে আদায় করার জন্য। ঠিক এইখানেই কিন্তু আজকের দিনের বঙ্গভূমিতে প্রতিনিয়ত যুযুধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রসঙ্গ এসে পড়ে এবং এসে পড়ে সম্বোধনের কথাটাও। আমরা জানি, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত নিষ্ঠাভরে কালীপুজো করেন। কিন্তু তাঁর কালীভক্তি এবং কালী-সম্বোধন তাঁর গৃহ-চত্বরের মধ্যেই অর্গলাবদ্ধ থাকে, তিনি ভক্তিমতী শক্তিকে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে নিয়ে আসেন না। অথবা যে দেবতা তাঁর আন্তর শক্তি জাগ্রত করে, সেই শক্তিকে তিনি জনকল্যাণী শক্তিতে পরিণত করেন সর্বতোভদ্রা এক উন্নয়নী ভাবনায়। অর্থাৎ কালী সেখানে তাঁর রাজনৈতিক ব্যবহারের পণ্য হয়ে ওঠে না কখনও। এমনকী একটি ক্ষুদ্র জন-সমাজে, সামান্যতম ইষ্ট-গোষ্ঠীর মধ্যেও ‘কালী মা’ তোমার মঙ্গল করুন, এমন শুভেচ্ছা-সম্বোধনও তাঁকে করতে দেখিনি কখনও। তিনি জানেন, ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মাচরণ নিতান্ত ব্যক্তিগত জায়গা। সেটাকে বহুধর্ম-ভাবিত ভারতবর্ষে রাজনৈতিক পণ্য করে তোলা যায় না। এইবার যুযুধান অপর একটি রাজনৈতিক দলের কথা বলি। এই দলের ধর্মাবতার রামচন্দ্র ভগবান বিষ্ণুর অবতার। অথচ তথাকথিত রামভক্তদের আচরণ মােটেই বৈষ্ণবোচিত নয় এবং এরা এমনই একপ্রকার ভস্মাসুর, যারা দেবতার কাছে বর চায়— যার মাথায় হাত রাখব, সে-ই যেন ভস্ম হয়ে যায়, তার পর বরলাভ করার পরেই সে বরদাতা দেবতার মাথাতেই হাত রাখতে চায়! সবচেয়ে বড় সমস্যা এটাই যে, বাল্মীকি রামায়ণ, তুলসীদাসের রামায়ণ এবং বহুকাল-চর্চিত রামভক্তদের যে ব্যবহার প্রচলিত ছিল, তাতে রামচন্দ্র কোনওদিন কোনও প্রতিহিংসামূলক স্লোগানে পরিণত হননি। কিন্তু এই বিশেষ রাজনৈতিক দল ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে ভয়, বিদ্বেষ এবং প্রতিহিংসার সূচনা তৈরি হয়, তাতে একদিকে যেমন রাম-নরচন্দ্রমার চন্দ্রিকা তামসী, তমোময়ী হয়ে ওঠে, তেমনই সঙ্গে সঙ্গে এই ধ্বনি দ্বিতীয় প্রকার কালীভক্তদের ‘জয় মাকালী’ ধ্বনির সঙ্গে তুলনীয় হয়ে ওঠে। এই প্রকারের ভক্তদের হিংসাবৃত্তি এমনই যে, মহামহিম কালীও তাঁদের নামেই সম্বোধিত হন— কালী হয়ে ওঠেন ‘ডাকাত কালী’। ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে ডাকাতের সর্দার দলবদ্ধ ডাকাতদের নিয়ে কালীপুজো করতেন মনোবল লাভের জন্য। তারপর কালী-কালী বলেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন গৃহস্থের বাড়িতে। বিজেপি ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে। লক্ষণীয়, পরিচিত এবং অপরিচিত গার্হস্থ্য প্রদেশগুলির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বিজেপি দল যে ভগবদ্ধনিকে শক্তিধ্বনি হিসেবে ব্যবহার করে সেটা কিন্তু রামধুনের সুর নয় কোনও, সেটা গলার শির ফাটানো ‘জয় শ্রীরাম’। এমন ধ্বনি শোনা যদি আমার প্রভু পতিতপাবন সিয়ারামজি’র শোনা থাকত তা হলে এই পশ্চিমবঙ্গে অন্তত একটি মন্দিরের নাম হত ‘ডাকাতে রাম’। কিন্তু এমন মন্দির নেই কোথাও। নরচন্দ্রমা রামচন্দ্রের নামে ডাকাতি চলে না। অথচ ডাকাতে কালীভক্তদের অনুকরণে যাঁরা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে শুধু ভোট লুঠ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের কীভাবে তাঁর ঘরের মধ্যে থেকে শুধু কালীমায়ের বিগ্রহ প্রদর্শন করে তাড়িয়ে দিলেন, তার জন্য একটা সত্যকাহিনি শুনতে হবে এক বিখ্যাত মহিলার জবানিতে। এই মহিলা বিখ্যাত ব্রাহ্মধর্মের আচার্যগুরু কেশবচন্দ্র সেনের বড় মেয়ে কোচবিহারের মহারানি সুনীতি দেবী। ১৯১৬ সালে বিখ্যাত Thacker Spink  থেকে তাঁর বই বেরোয় ইংরেজি ভাষায়। সেখানে একটি সত্যকাহিনি হল ‘Girl As Kali Ma’. অর্থাৎ একটি মেয়েই কালী হয়ে উঠেছে। এই বাংলার এক সমৃদ্ধ পরিবারে হঠাৎই একটা চিঠি এল যে, বাড়িতে ডাকাত পড়বে। সেকালে বিখ্যাত ডাকাতরা এইভাবে আগেভাগে জানিয়েই ডাকাতি করত। বাড়ির লোকজন সজাগ হয়ে সমস্ত গয়নাপত্তর, জমা টাকা সব নিয়ে নিঃশব্দে বাড়ি থেকে অন্যত্র চলে গেল সন্ধ্যার আগেই। বাড়িতে রয়ে গেল একটি অল্পবয়সি বউ এবং তার বাচ্চাটি। সে চিঠির কথাও জানত না, অন্যরাও কেউ বলেনি। প্রথম রাতে বউটি বাচ্চা পাশে নিয়ে ভালই ঘুমোল। কিন্তু গভীর রাতে বাড়িতে শব্দ উঠল, ঢোল-কাঁসি-জয় মা কালী। বউ জানত, এইভাবেই ডাকাত পড়ে বাড়িতে। ত্বরিতে ঘুম থেকে উঠে সে দেখল— ডাকাতরা বাড়ির চত্বরে ঢুকে পড়ছে।

আরও পড়ুন : পায়ে-পায়ে পীঠস্থানে

বাড়িতে কেউ নেই— নিজে বাঁচতে হবে, বাড়িটাকেও বাঁচাতে হবে— এই বুদ্ধিতেই সে এক অভিনব কৌশল গ্রহণ করল। বউটির গায়ের রং বেশ কালো, আরও কালো সাজার জন্য কালির দোয়াতের যত কালি সে মেখে নিল হাতে-মুখে সর্বত্র। তারপর ঘুমন্ত বাচ্চাটিকে লুকিয়ে রেখে দোতলার সিঁড়ির মুখে হাতে দা নিয়ে নিশ্চল, অনড় শ্বাস-রুদ্ধ-প্রায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল বউটি। ডাকাতরা নিচতলায় কিছু পেল না। কিন্তু তিন-চারটে টর্চের আলো ফেলে যেই না তারা ওপরে উঠতে যাবে, অমনি নজর পড়ল মুক্তকেশী কালীমূর্তির ওপর। দু’পাশে এলো চুল, আলতা-রাঙা জিভ বেরিয়ে আছে, কপালে এই বড় সিঁদুরের ফোঁটা নিষ্পলক বিস্ফারিত চক্ষুর ওপর টর্চের আলো পড়তেই ডাকাতরা কেঁপে উঠল। তিন-চারজন ডাকাত সিঁড়ির মুখেই দাঁড়িয়ে পড়ল। হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে বলল, ‘‘দয়া করো, মা! দয়া করো। আমাদের ভুল হয়ে গেছে।’’ ডাকাতের সর্দার সবাইকে বলল— চলো ভাইসব। যে বাড়িতে এমন কালী-মা আছেন, সে-বাড়িতে আমরা ডাকাতি করি না। চলো ভাইসব।

এই বঙ্গভূমিতে ২০২১ সালে আবারও এই ঘটনা ঘটল ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে ভোট-ডাকাতি করতে এসে বঙ্গভূমির দুয়ার আগলে-দাঁড়ানো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভয়ঙ্করী মূর্তি দেখেই পালিয়ে গেল সব। বেঁচে রইল এই বঙ্গ-মাতৃভূমির ধ্বনি— ‘জয় মা কালী। পাঁঠা বলি।’

Latest article