আজ যখন এই সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে তাকাচ্ছি বড্ড বেশি একা লাগছে নিজেকে। কোনও জেঠু কোনও কাকা বা কোনও পিসি এসে আমার সঙ্গে গল্প করতে বসছে না। এমনকি নেড়ুদি বা ফালুদা বা ঘন্টু কাউকেই সামনে আর দেখতে পাচ্ছি না রোয়াকে বসে আড্ডা মারার জন্য। কানের ওপর চেপে-ধরা মুঠোফোনে কথা বলার সময় বোঝার চেষ্টা করেই চলেছি কোন তৃতীয় ব্যক্তি আমাদের অগোচরে আমাদের কথা শুনছে বা টুকে নিচ্ছে! চতুর্দিক যেন বড্ড বেশি-বেশি করে একা হয়ে আসছে। আলাদা হয়ে আসছি ক্রমশ বেশি করে সঙ্গীসাথীদের থেকে। সমস্ত জায়গা থেকেই জীবন ক্রমশ বিচ্ছিন্ন থেকে বিচ্ছিন্নতর হয়ে যাচ্ছে প্রতিটি দিনের সঙ্গে সঙ্গে।
আরও পড়ুন : গোর্খাল্যান্ড দাবি ছেড়ে রাজ্যের পাশে বিনয় তামাং
আমি কি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছি নাকি পৃথিবী আমাকে অপছন্দ করছে? আমি তো নিজের কাছে পরিচ্ছন্ন আছি। গুটিয়ে নেওয়ার মতো কোনও গ্লানিকর কিছু মাথাকে ভারী করে নেই। প্রত্যেকটি প্রকাশ আমি আমার মতো করে করতে এখনও পর্যন্ত সফল এবং স্বচ্ছন্দ। যতদূর দেখেছি আমার চারপাশের লোকজন আমার বলা কথায় খুব বেশি বিতর্কিত অবস্থান নেয় তা-ও তো নয়। তাহলে কি আমি ভয় পাচ্ছি? আমি কি ভয় পাচ্ছি নিজেকে প্রকাশ করতে? আমার প্রকাশের স্বাধীনতা কি আজ বিপন্ন?
আরও পড়ুন কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা, মিলল হারানো মোবাইল ফোন
এমন তো হওয়ার কথা নয়। বিগত পঁচাত্তর বছর ধরে আমি যে স্বপ্ন লালন-পালন করেছি সেই স্বপ্ন তো আমাকে জানিয়েছে আমার নিজস্ব অধিকারের কথা। যে মানবাধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার আশ্বাস আমাকে দেওয়া হয়েছে, তার মাঝে তো আমার মতপ্রকাশের অধিকারও পড়ে। সে-প্রকাশ আমি করি বা বলা ভাল কিছু দিন আগেও করতাম পাড়ার চায়ের দোকানে বা ট্রেনের আড্ডায় এবং অবশ্যই আমার মুঠোফোনে। এখন কেন আমি এত সতর্ক থাকছি মনখোলা আবেগ নিয়ে সেই প্রকাশে?
আমার সামনে ভেসে উঠছে কিছু মুখ যারা আড়ি পাতছে আমার ভুবনে।
কাদের হয়ে আড়ি পাতছে এরা! যাদের আমি নয় আমরা আমাদের প্রতিনিধি করে বৃহত্তর সমাজে আমাদের হিসেব বুঝে নিতে পাঠিয়েছি। তারা আজ আমার, আমাদের, মুঠোফোনে ঢুকিয়ে দিচ্ছে গ্রিক পুরাণের বজ্র বয়ে আনা পেগাসাস নামের শ্বেত অশ্বকে। তারা পাঠিয়ে দিচ্ছে মাথায় ফেট্টিবাঁধা অবাঞ্ছিত যুবকদের কলেজের কমনরুমে। কখনও লুকিয়ে শুনছে আমার মতের প্রকাশ। কখনও আমায় থামিয়ে দিচ্ছে ঝান্ডালাগানো লাঠির প্রবল আস্ফালনে। তারা, সেই তারা, আজ আমাকেই থামিয়ে দিচ্ছে। সরিয়ে রাখছে ভয়ের পৃথিবীর আবডালে। তাদের হয়ত আমি বা হয়তবা আমি নই কিন্তু অবশ্যই আমরা, আমাদের দাবিদাওয়া বুঝে নিতে দায়িত্ব দিয়েছি।
ছিল না, এমন হওয়ার কথা ছিল না। আমি জানতাম আমার বিরুদ্ধমত থাকতেই পারে। আমার বিরুদ্ধস্বর আমাদের মধ্যেকার প্রকৃত সংহতিকে প্রকাশ করে বলেই আমার জানা ছিল। আমাদের মিলিত যৌথ মতামত হল এমন এক বর্ণালি যাতে প্রতিটি রং সমানভাবে খেলা করে, এই ছিল আমাদের ধারণা। এক হাজার পঁচাত্তর বা একশো পঁচাত্তর বা পঁচাত্তর বছর আগে কখনও সে-ধারণা থেকে আমাদের, আমরা যারা গড়পড়তা সাধারণ তাদের, সরে আসার কোনও কারণ ঘটেনি।
দেশীয় রাজতন্ত্র বা বিদেশি শাসন আমাদের মুখ চেপে রাখতে চেয়েছে চাবুকের আঘাতে। আমাদের ফিসফিসানি কান পেতে শোনার তাগিদে সেই স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের দল আমাদের মুষ্টিমেয়কে শাঁসেজলে রেখে আমাদের মাঝে ছেড়ে দিয়েছে। আমাদেরকে স্তব্ধ বাকরুদ্ধ করে রাখতে চেয়ে নামিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতা ও অধিকারহরণের একের পর এক প্রকৌশল।
এই বিগত পঁচাত্তর বছর তো আমরাই আমাদের জনগণমনঅধিনায়ক। কোনও স্বৈরশাসকের ভূমিকা তো আজ অনুপস্থিত। আমাদের প্রতিনিধি আমাদেরই শাসক। আমাদের হাতে তা হলে কোনও অজানা কারণে কি আজ আমরাই তুলে দিচ্ছি আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাহরণের ভার! আর সর্বাধিক আশ্চর্য এই যে খোলামনে বলতে পারছি না এমনকী এই বিপন্নতার কারণ।
অনেক অনেক দূরের পশ্চিমে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। সেখানে এক যুগের ব্যবধানে কণ্ঠ আবারও আজ রুদ্ধ। আমরা দেখতে পাচ্ছি কেমন করে সেখানে চেপে বসছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বজ্রপাশ। স্বাভাবিক মতপ্রকাশ সেখানে এ মুহূর্তে মৃত্যুপরোয়ানার অণুঘটক।
মুক্তমত প্রায় অবরুদ্ধ। ভয় পেতে পেতে নেড়ুদি বা ফালুদা বা ঘন্টু বা আরও মানুষের মাঝে আমার বা আমাদের এই ধারাবাহিক গুটিয়ে থাকা, গণতন্ত্রের এই অবিসংবাদিত ভূমিতে, তেমনই কোনও পশ্চিমা নব্যতন্ত্র নব্যবেশে আসার ঘৃণিত সুযোগ করে দিচ্ছে না তো?