শিক্ষা ও বিনোদনের মাধ্যম যা, তারই মেলা কলকাতার বুকে

বই এক বহনযোগ্য জাদুর নাম। আজ থেকে শুরু তারই মেলা। অনন্য এর বৈভব, অনবদ্য এর গ্রহণযোগ্যতা। দুর্গাপুজো ছাড়া এই একটা উৎসব বঙ্গজদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষক। লিখছেন অধ্যাপক ড. রূপক কর্মকার

Must read

ইয়োহানেস গুটেনবার্গ-এর নাম আমরা কমবেশি সকলেই জানি। ছাপাখানা আবিষ্কারের জনক ছিলেন। গুটেনবার্গ-এর বাসস্থান ছিল জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের অদূরে মেঞ্জ শহরে। পঞ্চদশ শতকে গুটেনবার্গ ছাপাখানার ছাপানো বই নিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে আসতেন বিক্রি করতে। তাঁর দেখাদেখি স্থানীয় কিছু বই বিক্রেতাও তাঁদের প্রকাশিত বই নিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে আসতেন বিক্রি করতে। সেই থেকেই বইমেলার রূপ নেয়। ১৪৬২ সালে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের মেসে বিশ্বের প্রথম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়, যা ‘দ্য ফ্রাঙ্কফুর্ট বুকফেয়ার’ নামে পরিচিত। জার্মান পাবলিশার্স আ্যন্ড বুক সেলার আ্যসোসিয়েশন আয়োজিত ‘দ্য ফ্রাঙ্কফুর্ট বুকফেয়ার’ এখনকার সময়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বইমেলা। ১৯৬৪ সালে যা আন্তজার্তিক স্বীকৃতি পায়।
আসলে বইমেলা মানেই কিছু অপ্রত্যাশিত বইয়ের হঠাৎ করে দেখা পাওয়া, কিছু নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, লেখক ও পাঠকের মধ্যে সরাসরি ভাব বিনিময় বা লিটিল ম্যাগাজিন স্টলে ছোট ছোট পত্রিকার স্বাদ আস্বাদন করা। পুরোনো বইয়ের মলাট হোক বা নতুন পৃষ্ঠার গন্ধ, কত না স্মৃতি ঘুরে বেড়ায় বইমেলার সেই মাঠে। বঙ্কিমের উপন্যাস হোক বা টেনিদার সাহসিকতা অথবা অগন্তিক হাড় হিম করা ভৌতিক গল্প যেন নস্টালজিয়ার জন্ম দেয় বইমেলার প্রাঙ্গণে। বই মানুষের এমন এক বন্ধু যা সমস্ত ভাল, খারাপ মুহূর্তগুলিকে ফ্রেমবন্দি করে রাখতে পারে। জীবনের এই অমূল্য সম্পদ, যা কিনা মানুষের মধ্যে চেতনার বিকাশ, পরিবর্তনের আওয়াজ এবং জ্ঞানপিপাসু মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করে। সুকুমার রায়ের পাগলা দাশু বা বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালি পড়ে বেড়ে ওঠা বাঙালির প্রাণ এক অচেনা পৃথিবীকে দেখেছে। তাই এই নামগুলি শুনলেই যেন মন পাগল হয়ে ওঠে আর পাঁচিলের বাধা পার করে ছুটে যাই সেই বইমেলার মাঠে, যেখানে কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের রঙ মেশে।

আরও পড়ুন-ট্রেনের মহিলা কামরায় আগুন, আতঙ্ক

সংস্কৃতির রাজধানী কলকাতার বইমেলাকে ‘বাঙালির চতুর্দশ পার্বণ’ বলে অভিহিত করা হয়। বইমেলার ইতিহাসটা বেশ মজাদার। শোনা যায় ১৯৭০ দশকের প্রথম দিকে কলেজ স্ট্রিটের আইকনিক কফি হাউসে একদল বইপ্রেমী, লেখক এবং প্রকাশকদের আড্ডা চলছিল ফাঙ্কফুর্ট বইমেলা নিয়ে। সেখান থেকেই কলকাতা বইমেলার ধারণা মনে করা হয়। ১৯৭৬ সালে কলকাতা পাবলিশার্স আ্যন্ড বুক সেলার্স গিল্ডের উদ্যোগে কলকাতা বইমেলার শুভ সূচনা হয়৷ তবে কলকাতা বইমেলার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে বেশি সময় লাগেনি। ১৯৮৪ সালেই তা ঝুলিতে চলে আসে। কলকাতা বইমেলা আন্তজার্তিক বইমেলা হলেও, এই মেলার সিংহভাগ জুড়ে আছে বাঙালিয়ানার ছোঁয়া। হাজারেরও বেশি স্টল-সমৃদ্ধ কলকাতা বইমেলার এবারের থিম কান্ট্রি হল ‘জার্মানি’। ১৯৯১ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার আদলে একটি ফোকাস থিম চালু করা হয় কলকাতা বইমেলায়। সেই বছর থেকে ভারতের কোনও না কোনও রাজ্যকে ফোকাস থিম হিসেবে তুলে ধরা হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল সেই রাজ্যের সংস্কৃতি, পরম্পরাকে তুলে ধরা। অসম ছিল প্রথম ফোকাস রাজ্য।
১৯৯৭ সাল থেকে ফোকাস থিম হিসেবে বিদেশি দেশকে তুলে ধরার রীতি চালু করা হয়। ফ্রান্স ছিল তার সূত্রপাত। এই ৪৮তম বইমেলার মাহাত্ম্য হল যেই দেশে বইমেলার সূত্রপাত সেই দেশকে সামনে রেখেই শুভ সূচনা হতে চলেছে। থিম কান্ট্রিকে সম্মান জানানোর জন্য বইমেলার আকর্ষণীয় প্যাভিলিয়ান তৈরি করবেন ভারতীয় স্থপতি অনুপমা কুন্ডু। বই বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে বইকে ঘিরে যে মেলা, যেখানে বহু মানুষের সমাগম হয় তা কিন্তু নানান ধরনের ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যথেষ্ট। ক্ষুদ্র শিল্পের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্মসংস্থানের যে জোয়ার এনেছে এবং উৎসব ও মেলার মাধ্যমে যে কত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে তা বিগত দিনেও দেখিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

আরও পড়ুন-বিরল স্নায়ুরোগে প্রথম মৃত্যু আক্রান্ত শতাধিক, আতঙ্ক

২০২৪ সালে আন্তজার্তিক কলকাতা বইমেলায় প্রায় ২৭ লাখ বইপ্রেমী এসেছিলেন। বই বিক্রি হয়েছিল প্রায় ২৭ কোটি টাকার। ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়েও বই পড়ার ঝোঁক যে বিন্দুমাত্র কমেনি তা কলকাতা বইমেলার মানুষের উপস্থিতি ও বই বিক্রির হিসাবই বলে দিচ্ছে। উদ্যোক্তারা আশা করছেন এই বছর দর্শকদের সংখ্যা ও বই বিক্রির পরিমাণ আগের বছরের থেকে অনেকটাই বাড়বে। বইমেলা অগণিত পাঠক, পাঠিকাদের মননশীল ঐতিহ্যের অংশ। সাহিত্য, সংস্কৃতি, জাতিসত্তার মান নিরূপণে বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম। বইমেলার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, প্রথা ও মিথের সম্পৃক্ততা হয়ে গিয়েছে।
স্পেনের বার্সেলোনায় বইমেলাকে সেখানকার লোকজন গোলাপের দিন বা প্রেমিকের দিন নামে আ্যখায়িত করে। আসলে খুদে পড়ুয়ারা যেখানে সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট, মোবাইলের লেন্সে সীমাবদ্ধ, সেখানে রহস্যের গল্প, ঠাকুমার ঝুলির অমোঘ আকর্ষণ যেন তাদের মেলামুখী করে তোলে এই শীতের সন্ধ্যায়। নবীন ও কিশোর প্রজন্মের মধ্যে বইমেলার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে না কমেছে সেটা একটা বিবেচ্য বিষয় ঠিকই তবে বইমেলার যে ঐতিহ্য বা তার গুণাগুণ তার ধার যে উত্তারত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে কিন্তু কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে সরকারের উদ্যোগে ও আর্থিক সহায়তায় বিভিন্ন জেলায় জেলায় বইমেলার যে আয়োজন তা বইপ্রেমীদের বইয়ের স্বাদ যে নিবারণ করবে তাতেও কিন্তু সন্দেহ নেই।
২০২২ সাল থেকে জেলায় অনুষ্ঠিত বইমেলার জন্য সরকারি বরাদ্দ ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬ লাখ টাকা করেছে। কলকাতা বইমেলা শুধু এখন একটি মেলা নয়, বাঙালিদের আবেগ যা দেশ-বিদেশেও সমাদৃত। অনেক ছোটখাটো প্রকাশক আছে যাদের কাছে বইমেলা শব্দটাই শিহরন জাগানো স্বপ্ন পূরণের কান্ডারি। কলকাতার দুর্গাপুজার মতো বইমেলাও একটি অন্যতম উৎসবের রূপ নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কলকাতা বইমেলাকে যে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

Latest article