ভূগর্ভস্থ

Must read

অজিতেশ নাগ: মালদায় (Maldah) এই ‘নিভৃত’-এ চলে আসার পিছনে দুটো বড় নিভৃত কারণ ছিল। একটা হল এই যে, অনেকদিন ধরেই মনে পুষে রাখা একটা ইচ্ছাকে বাস্তব রূপদান। আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম রিটায়ার করার পরে আর কলকাতায় (Kolkata) থাকব না। থাকার মধ্যে স্ত্রী ছিল। আজ বছর ছয়েক হল চলে গেছেন। আর দুই ছেলে এক মেয়ে। সবারই বিয়ে-শাদি কমপ্লিট। তারা সবাই নিজের নিজের সংসার নিয়ে জেরবার।

দ্বিতীয় কারণটা অবশ্যই বৃন্দাবনতলার সৌন্দর্য। বেশ গ্রাম্য এলাকা। অ্যাদ্দিন শহরে বাস করে করে চোখ হেজে গেছে। এখানে চারদিকে প্রচুর গাছপালা। আহা! দু-দণ্ড দেখেও শান্তি। বেশির ভাগ মাটির দেওয়াল ঘেরা বাড়ি। এখনও মাঝেমধ্যে মাটির রাস্তা। তবে খুব শিগগিরই শুনছি পিচ, স্টোনচিপস পড়বে। কাছেই একটা মাঠ আছে প্রতি মঙ্গলবার সেখানে হাট বসে।

একটা উপন্যাসে হাত দিয়েছি সবে। একটা মাঝারি পত্রিকা বায়না করেছে। মাঝেমধ্যে এদিক-ওদিকে গ্রামগুলোতে চলে যাই। প্রচুর গ্রাম আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। আশরাফপুর, বাহেরপুর, বাজে ঢুলদা, কুড়িবাড়ি, মানুলি, তুড়ুকমানাইল, দৌলতপুর, ঝকলডাঙা… এই ক’মাসে যে কত গ্রামে ঘুরেছি! সবই আমার লেখালেখির উপকরণ।
–‘কে এল রে?’
–কাল বিকেল থেকে দেখছি পাশের ঘরটায় ঝাড়পোঁছ চলছে। আগে এই ঘরে থাকতেন বিশ্বম্ভরবাবু। খুবই সদালাপী মানুষ। দেখা হলেই দুগাল ভর্তি হাসি। এই ফ্লোরে এখন অবধি আমি আর বিশ্বম্ভরবাবু থাকতাম। আচমকা এক সকালে এক কাপ চায়ে দুটো বিস্কুট চুবিয়ে খেয়েই হার্ট অ্যাটাক হল বিশ্বম্ভরবাবুর। আচমকা দুড়দড়াম শব্দে ছুটে এসে দেখি এই কাণ্ড। বাকি দুটো বিস্কুট আর হাফকাপ চা রয়েই গেল। আমাদের এই বাড়িতে সর্বদাই ডাক্তার মজুত থাকে। কিন্তু সেই ডাক্তার আসার আগেই সব শেষ। তারপর থেকে মাসখানেক ঘরটি তালাবন্ধ।

আরও পড়ুন: পানের সাতকাহন

—‘আমি ঠিক জানি না স্যার। ভৌমিকদা বলতে পারবে।’
ভোলার জবাব শুনে আমি নিচে নেমে এলাম। উপন্যাসের একটা মোড়ে এসে পথ হারিয়েছি। তাই মাথা ছাড়াতে একটু হাঁটাহাঁটি করা দরকার। এখন পৌষের শুরু। কলকাতায় এই সময়টা গরমভাব থাকলেও এখানে বেশ গা-শিরশির টের পাচ্ছি। ভাবছি কাল থেকে একটা হালকা চাদরটাইপের কিছু জড়িয়ে নেব। অযথা অসুখবিসুখ মানে নিজেকে আর অন্যকে বিব্রত করা। কী দরকার?

চমৎকার একটা প্লটের সূত্রপাত মাথায় নিয়ে যখন ফিরে এলাম তখন সন্ধে নেমে এসেছে। ‘নিভৃত’-এ ঢোকার মুখেই যে বিশাল জামরুল গাছটা তাতে রাজ্যের পাখি এসে কিচিরমিচির জুড়ে দিয়েছে। রোজই দেয়। তার এত শব্দ যে পাশের লোকে কথা বললে শোনা যায় না। তা না যাক, আমার বেশ লাগে। দরজার বাইরে থেকেই দেখতে পাচ্ছি, প্রায় প্রতিটি ঘরের জানলা আলোকিত। এইবার প্রায় সক্কলে গুটিগুটি পায় জড়ো হবে নিচের হলঘরে। জমিয়ে খবর দেখবে, না হয় সিরিয়াল। শুনেছিলাম মৃন্ময়ী দেবীর শরীরটা ঠিক যাচ্ছে না।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের ঘরে যাবার আগেই একবার বিশ্বম্ভরবাবুর ঘরের দরজার দিকে চোখ পড়ল। দরজা বন্ধ, তবে হালকা তরল আলো গলে আসছে তলা দিয়ে। তার মানে ঘরে লোক এসেছে। কে জানে কে! কতই তো আসে। দরজার নেমপ্লেটটা পাল্টানো হয়েছে। স্বাভাবিক। তবে বারান্দাটা অন্ধকার থাকায় পড়তে পারছি না। হতভাগা ভোলা। কতদিন বলেছি পাঁচটা বাজলেই বারান্দার লাইট জ্বালবি। তবুও ফাঁকি! বকলেই হলদে দাঁত বের করে বলবে, ‘জল আনতে গেস্‌লুম বাবু’। নিজের ঘরের দিকে এক পা বাড়িয়েও দাঁড়ালাম। কী জানি হয়ত অভদ্রতা, তবুও এক অদম্য ইচ্ছে জেগে উঠল। বুঝতে পারছি আচমকা ঘরের বাসিন্দা বাইরে বেরিয়ে এলে একটা লজ্জাকর অবস্থায় পড়তে হবে, তবু নিজের মোবাইলের টর্চের আলো ফেললাম দরজার উপরে। দেখলাম ‘কুমারিকা নিয়োগী’।

ঘরে ফিরে আসাইস্তক উপন্যাসে মন বসাতে পারলাম না। মাথায় বয়ে নিয়ে আসা প্লট হাওয়া। কুমারিকা! এই একটা নাম— কত বছর এই নামটা ভুলে ছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম কি! হয়ত হ্যাঁ, হয়ত না। পরক্ষণেই ভাবলাম, ধুস! কত কুমারিকা নিয়োগী আছে এই দুনিয়ায়। তবে কিনা যতদূর সম্ভব মনে পড়ছে কলেজের উত্তাল রাজনীতির এলাকা টপকে কুমারিকা নামের উচ্ছল হলুদ শাড়িটা কোন এক নাম না জানা নিয়োগী পরিবারের অন্দরমহলে সেঁধিয়ে গিয়েছিল। আর আমরা যারা বাইরে রয়ে গেলাম বিশেষ করে আমি, তাদের জন্য একগুচ্ছ হতবাক হাল।
স্কটিশের সেইগুলোতে খুব ছন্নছাড়া কাটছিল। ক্লাস বিশেষ হতই না। বেশিরভাগ দিন একরাশ দামাল ছেলেমেয়ে দাপিয়ে বেড়াত কলেজময়। আমিও ছিলাম সেই দলে। অম্লান মুখার্জির নাম তখন ছেলেছোকরা পড়ুয়াদের মুখে মুখে। ক্লাসের পর ক্লাস বাঙ্ক করতাম। নেহাত স্কটিশ বলেই আমাদের হালটা শিক্ষকেরা ধরে রেখেছিলেন। পলিটিক্স আর এডুকেশন চলত পাশাপাশি। অনেক মুগ্ধ মুখের মধ্যে হলুদ শাড়ি কেমন করে যেন জড়িয়ে গেল। একদিন আউটরাম ঘাটে—
—‘আপনি লেখেন?’
—‘লিখি। কেন আপত্তি আছে?’
—‘আপনি এত রুড কেন? একটা নর্মাল কোয়েশ্চেনই তো করেছিলাম।’
—‘ন্যাকা-বোকাদের কথা আমি পছন্দ করি না।’
—‘আমি ন্যাকা!’
—ফোঁস করে উঠেছিল হলুদ শাড়ি। অম্লান মুখার্জিকে ফোঁস করছে মানে দম আছে। মনে মনে খুশিই হয়েছিলাম।
—‘ন্যাকা নয়? দেখছ তো কলেজ ম্যাগাজিনে আমি এডিটর। লেখাও পড়েছ নিশ্চয়ই। তার পরেই… একে ন্যাকামো ছাড়া কী বলব!’
—‘লেখেন যদি, তাহলে এত বলেন কেন? সারাদিন বকেই চলেছেন! বকেই চলেছেন! আপনি নিজেকে কি সব্যসাচী ভাবেন? মুখে দাড়ি রাখলেই কেউ ইয়ে হয় না।’
—রেগে উঠতে গিয়ে হেসে ফেললাম। পড়ন্ত সূর্যের আলো ধুয়ে দিচ্ছিল কুমারিকার মুখটা। আমার মনে হয়েছিল এ মেয়েটা আলাদা। একদমই সাজগোজ পছন্দ করে না। ঠোঁটে লিপস্টিক তো নয়ই। তবুও আসন্ন সন্ধের কোমলগান্ধার খেলে যাচ্ছিল ওর দুটো পাপড়িতে। আমার চোখ অনুসরণ করছিল ওর চোখদুটি, চশমার আড়াল থেকেও। লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়নি। আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম। থুতনির ভাঁজটার দিকে চেয়ে ভাবছিলাম আর কিছুদিনের মধ্যেই ওর নামটা কুমারিকা মুখার্জি লিখলে কেমন দাঁড়ায়!

অনেক রাত অবধি ঘুম এল না। এপাশ-ওপাশ করা সার হল। একবার উঠে কলম বাগিয়ে বসলাম। নাঃ। হচ্ছে না। যে প্লটটা নিয়ে ফিরেছিলাম, সেটা গুলিয়ে গেছে অথবা আগের সিক্যুয়েলের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না। কতগুলো এলোমেলো সিল্যুট ছবি যেন চলে যাচ্ছিল পরপর, চোখের সামনে দিয়ে। এদের দেখা যায়, হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায় না। সেই সব দিন! উত্তপ্ত রাজনীতি আর প্রেম, ডাল দিয়ে ভাত মেখে খাবার মতো খেয়ে ফেলছিলাম আমি। পাঁচ আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছিল সেই ভাতের লেই, চেটেপুটে নিচ্ছিলাম তাও। বহরমপুর থেকে ডাক এল। ‘কমরেড, হাইড ইওরশেল্ফ’। পুলিশের হাতের তালিকায় প্রথম পাঁচটা নামের মধ্যে একটা অম্লান মুখার্জি। একদিন বরানগরের গৌতমের বাড়িতে নিয়ে গেলাম কুমারিকাকে। জরুরি মিটিং শেষে সবাই বিদেয় হলে ছিটকিনি তুলে দিয়ে বললাম,
—‘চলো।’
—‘কোথায়?’
—‘পাল্টা প্রশ্ন নয়। আমার সঙ্গে যাবে তুমি ব্যস।’
—‘কিন্তু…’
—‘বাইরে গৌতম পাহারা দিচ্ছে। যে কোনও সময় পুলিশ চলে আসতে পারে। সময় নেই।’
—‘আমি যাব না।’
—‘যেতে তোমাকে হবেই।’
—অনেকটা কাছে সরে আসায় ওর জোড়া পাপড়ির কম্পন দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। থিরথির। থিরথির।
—‘আমি আপনার ক্যাডার নই। জোর করে নিয়ে যাবেন বুঝি?’

গৌতমের বিছানার চাদরটা সেদিন দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল। ক্লান্ত শরীরে একটা অস্বস্তি শুয়েছিল মরা সাপের মতো। অন্তর্বাসটা হাতে তুলে নিতে নিতে কুমারিকা বলেছিল, ‘আপনি যান। কলেজ শেষ করে আমি পিএইচডি করব। ততদিনে নিশ্চয় আপনার এই নাচনকোঁদন শেষ হয়ে যাবে।’
দরজায় ক্রমাগত কড়া নড়ে উঠছে। আমি লাফিয়ে উঠলাম। পুলিশ কি গন্ধে গন্ধে…। অভেসমতো চশমাটা চোখে গলিয়েই দেখি তিনতলার রোদ আমার বিছানার চাদর তোশক সব ছুঁয়ে যাচ্ছে। ইস্‌স। স্বপ্ন দেখছিলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেলা আটটা বেজে গেছে। দরজা খুলতেই ভৌমিকবাবু, ‘আপনি তো ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন মশাই। ভাবলাম বিশ্বম্ভরবাবুর মতো…। সেই কখন থেকে কড়া নাড়ছি। কাল অনেক রাত অবধি লিখেছিলেন বুঝি?’
—‘হ্যাঁ, ঐ আর কী।’
—‘তাহলে ঠিকই ভেবেছি। চা তো ওদিকে জল। মিন্তির মা’কে বলছি আপনার জন্য ফের চায়ের জল চড়াতে। ভাল কথা, হাত-মুখ ধুয়ে নিন, একজন আসছেন আপনার সঙ্গে আলাপ করতে।’
—‘কে ক্কে?’ আচমকাই গলা শুকিয়ে এল আমার।
—‘আপনার পাশের ঘরের বাসিন্দা। কাল এসেছেন। টের পাননি বোধ হয়? আজ সকালেই আপনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিলেন। বলছিলেন অম্লানবাবু কোথা থেকে এসেছেন, কী করেন এটসেট্রা।’
—হঠাৎ? আমার নাম জানলেন কী করে উনি?’
—‘সেটা আবার বড় কথা কী? সবার দরজার বাইরে তো নেমপ্লেট ঝোলে। তবে হ্যাঁ। ভারি সুন্দর ভদ্রমহিলা। সকালেই সবার সঙ্গে দেখা করে আলাপ জমিয়ে নিয়েছেন। যাক গে যাক, আপনি মুখ ধুয়েফুয়ে রেডি থাকুন। উনি এলেন বলে। আমি যাই, অনেক কাজ বাকি। ভোলাটা যে সক্কাল সক্কাল কোথায় কেটে পড়ল। এত ফাঁকিবাজ হয়েছে ছোকরা।’
গজগজ করতে করতে ভৌমিকবাবু নেমে গেলেন। আমি দরজাটা বন্ধ করে বসে থাকলাম বিছানায়। হাত-পায়ের সাড় পাচ্ছি না কেমন যেন। একটু পরেই যদি দরজা খুলে… যদি সে হয়! নিজেকে প্রবোধ দিলাম, হতেও তো পারে অন্য কেউ, অন্য কুমারিকা নিয়োগী। এক নামের তো গন্ডায় গন্ডায় পাওয়া যায় এই দেশে। আর সে কী করে হবে? বহরমপুর থেকে ফিরে আর তো তার দেখা পাইনি। সুহাসিনী বলেছিল, ‘বিয়ে হয়ে গেছে’। এই তিনটে শব্দ বহুকাল অনেক অনুভূতিকে লেপমুড়ি দিয়ে রেখেছিল। শীতঘুম ভাঙছে কী?
একটা চড়াই জানলার শিক গলে ভেতরে এসে ইতিউতি তিড়িংবিড়িং করে বেড়াচ্ছে। এদিক ওদিক চেয়ে একটা বিস্কুটের ছোট্ট টুকরো পড়েছিল কোথাও, সেটাই ঠোঁটে নিয়ে ফুড়ুৎ। আমি কান পাতলাম। হুম। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি। খুব ধীরে একটা শব্দ উঠে আসছে দোতলা থেকে তিনতলায়। আমি তড়িৎগতিতে গিয়ে দরজার ছিটকিনি আটকে দিয়ে ফের বিছানায় এসে বসলাম। নাঃ। আমাকে উপন্যাসটা শেষ করতে হবে। এই সময় ডিস্টার্বেন্স একেবারেই ভাল কথা নয়। তা ছাড়া চিনি না, জানি না, হুট করে আলাপ করব বললেই হয় বুঝি? যত্তসব!
দরজার সামনে এসে পায়ের আওয়াজটা থামল। এইবার দরজার কড়া নড়ে উঠেছে। একবার, দুবার। নাঃ, আমি কিছুতেই খুলব না। কিন্তু… আচ্ছা, মিন্তির মা-ও তো হতে পারে। চা নিয়ে এসেছে। কিন্তু যদি সে হয়! খুললেই যদি সামনে সেই দুটো কম্পনরত পাপড়ি চোখে পড়ে যায়!
এই মুহূর্তে দরজার পাল্লাটা খুলে হাট করে দিতে ভীষণ চাইছে আমার হাতদুটো। কিছুতেই তাদের আর নিজের বশে রাখতে পারছি না।

Latest article