অধিকার রক্ষা হোক সমাজের সব শ্রেণির মানুষের

গতকাল ছিল সংখ্যালঘু অধিকার দিবস। প্রান্তিক মানুষের অধিকারের দাবিতে সরব হয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। গর্জে উঠেছিল তাঁর কলম। এই লেখার মধ্যে দিয়ে 'হাজার চুরাশির মা'-কে স্মরণ করলেন সুব্রতা ঘোষ রায়

Must read

প্রতিবেদন :—জটিবুড়ি, কথা বুলে যাও কিছু ও আমার সাঁঝ সকালের মা…
—বলব ?
—বুল গো, তোমার বাপ কান্দেরি, তোমরা জেতে বেদিয়া, বুনে ঘুরো, বাদারে ঘুরো, আর আশ্চাজ্জা চিকন পাটি বুনো…
জটিবুড়ি
শরীর এবার খুব খারাপ হয়েছিল, খুব, খুব। আর সেরে উঠতে পারব না জানতাম, এই কিছুদিন আগেও সকালবেলায় বড় মগে চিনি ছাড়া ব্ল্যাক-টি খেতে খেতে সবুজ দেখতে ভালবাসতাম। আজকাল সবুজ বড় কম। বিষণ্ণতা, আজকাল মনের মধ্যে অতীত একসঙ্গে হাত ধরে হাঁটে। একটু আগেই ভাসা ভাসা মনে পড়ছিল তোমার কথা, আমার ‘সাত সকালের মা’ জটিবুড়ির কথা। বেশ কিছুদিন আগেও ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে সকালে থেরাপি নিয়েছি সকাল সকাল স্নানের পর, তারপর সকালের জলখাবার, কোনওদিন ডালিয়া, কোনওদিন রুটি-তরকারি বা অন্যকিছু, সঙ্গে ডিমসেদ্ধ বা একটু ফল। রক্তে শর্করা খুব, তাই বাধ্যতামূলকভাবে ইনসুলিন নিতেই হত, আর লেখাপড়ার টেবিলে বসতে বসতে প্রায় ন’টা। আর শুরু হত ফোন আসা, নানা মানুষের নানা সমস্যা, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পর বেড়ে গিয়েছিল এই ফোন, মাঝে মাঝে মানুষজন ভুলে যায় আমি লেখক, লেখকের সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চয় থাকবে, তবু শনি-রবিবার ছাড়া আর দেখা করতে পারতাম না।
জানি না সারাজীবন কী খই ভেজে গেলাম…
নেই কাজ তো খই ভাজ, এই খই ভাজতে ভাজতে পৌঁছে গিয়েছিলাম লোধাদের কাছে। আত্মহত্যাকারী চুনী কোটাল তথা লোধাসমাজ নিয়ে লিখেছি অনেক, নিজের ‘বর্তিকা’ পত্রিকায়। সেইভাবেই পৌঁছেছি পুরুলিয়ার খেড়িয়া শবরদের কাছে। যাদের বলা হয় ‘খেড়্যা’। ওদের সংগঠন গড়বার পর আদিবাসীদের মধ্যে ঐক্য রচনা করবার জন্য গড়ে তুলেছি ‘আদিম জাতি ঐক্য পরিষদ’। সাঁওতাল, ওঁরাও, ভূমিজ ও অন্যদের সঙ্গে এবার পরিচয় হল নিবিড়। অনেকের চেষ্টায় শবররা কাশফুলের ঘাস, জংলি খেজুরপাতা দিয়ে ঝুড়ি, টুকরি, ওয়েস্টপেপার বাস্কেট বানাতে শেখে। রাজ্য হস্তশিল্পমেলায় আমরা এগুলো বিপণন করেছি। করেছি শবর মেলাও। আনুমানিক পাঁচহাজার মানুষ পাঁচবেলা (২ দিন) একাসনে বসে খেয়েছেন এই মেলায়। সপরিবার। না, কোনও শৌখিন বা দামি আতিথ্য দিতে পারিনি এঁদের, হয়তো মাটির ডাক… খোলা মঞ্চে লোকনৃত্য, দং-নাচ, ঘোড়া-নাচ, বুলবুলি-নাচ, নাচনি-নাচে ভরে উঠেছে মন…১২.৩০ বেজে গেল? আমার দুপুরের খাবার সময় … মোটামুটি সময় বেঁধেই চলতে হচ্ছিল বেশ কয়েক বছর ধরে। ভাল লাগত ডাল, ভাত, সবজি, মাছের ঝোল খেতে, ভাল লাগত পেটির মাছ, ইলিশ মাছও। আর ভাল লাগে কী? বলব ? চিরদিনই অকপটেই সব বলে গেছি, ভালবাসি খৈনি নিতে, ‘রাজা খৈনি’। দুপুরে একটু বিশ্রাম খাবার পর তারপর আবার পড়ার টেবিল। নিজের লেখা, অন্যের লেখা, পত্রিকার কাজ… এই তো চলছিল জীবন…
ফেলে আসা দিন…
মনে পড়ে ছোটবেলাকার কথা। ঢাকায় জন্ম। তখন কল্লোল যুগ। বাবা সেই সময়কার লেখক-কবি মণীশ ঘটক। মা ধরিত্রী ঘটক। মা-ও লিখতেন। মা নিজেকে যুক্ত রাখতেন নানা সামাজিক সহায়তামূলক কাজে। ঢাকা থেকে চলে আসি বিশ্বভারতীতে, গুরুদেবের শিক্ষায়-চেতনায় আমি ধন্য, সমৃদ্ধ। শান্তিনিকেতনে শিখেছি অনেক কিছু। গুরুদেব ফুল কুড়োতে শিখিয়েছিলেন, ফুল ছিঁড়তে নয়। গাছপালা জল জঙ্গল হয়তো তখন থেকেই মিশে গেছে প্রাণেমনে। কেউ ফুল ছিঁড়ছে দেখলে কষ্ট হয় খুব। কাকা স্বনামধন্য লেখক-চিত্রপরিচালক ঋত্বিক ঘটক। দাদা শঙ্খ চৌধুরি প্রখ্যাত ভাস্কর, অন্য দাদা শচীন চৌধুরি ইকনিমিক-পলিটিক্যাল উইকলির ফাউন্ডার এডিটর। বিশ্বভারতী থেকে ইংরেজিতে বিএ করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ। বিয়ে হয়েছিল বিজনের সঙ্গে, বিজন ভট্টাচার্য। আইপিটি-এর জনক। আমার ছেলে নবারুণ, ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, নিজের লেখার নিজস্বতায় ও স্বতন্ত্র। হারবার্ট, ফ্যাতাড়ুর কুম্ভীপাক, কাঙাল মালসাট, হালাল ঝান্ডা— এইরকম অনেক লেখায় ও অনবদ্য। সোভিয়েত নিউজ এজেন্সিতে ও গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বশীল ছিল। ওর স্ত্রী আমার পুত্রবধূ প্রণতি অধ্যাপিকা ছিল। আমার নাতি তথাগত একটি ইংরেজি চ্যানেলের সাংবাদিক। নানা কারণে যদিও আমার বিজনের সঙ্গে বেশিদিন থাকা হয়ে ওঠেনি…
—তুমি কি গো?
—আমাদের বেত্তান্ত বড় আশ্চয্য গো, মোর আদিপুরুষ সেই জারা ব্যাধ।
জরা ব্যাধ?
মোরা বলি জারা ব্যাধ। মোদের জিভে তুমাদের সার লাই ডাক্তার। কোন দেশে য্যান সাগর, কুথায় য্যান দ্বারকাপুরী…জারা ব্যাধ সি দেশে যেঞে বাণ–মারা করে, ই হতে বড় পাপ আর লাই। সি হতে জারার বংশ সি দেশ তেগে ই দেশে এল।
—কোথা ?
—হিজলী, কাঁথি, তমলুক, মেদিনীপুর…
—তারপর ?
—মোদের সমাজ বড় ছোট, শ্মশানে-মশানে ঘুরি, সাপ ধরি, শ্মশানের কলসিতে জপল খাই…
—ছিঃ
—মোরা পাখপক্ষী ধরি, মোদের বলে পাখমারা…
হ্যাঁ, এই আদিবাসীদের নিয়েই জীবন কেটে গেল, জীবন। জীবন, লেখক-জীবন, স…ব। এরা আজ অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। সেই ১৪ জানুয়ারি, ১৯২৬-এ আমার জন্ম, অনেক চড়াই, অনেক উৎরাই পেরিয়ে আমি এখনও হয়ত তরুণীই আছি মনে মনে… এ পর্যন্ত লিখেছি অনেককিছু… একসঙ্গে সব মনেও পড়ে না।
ঝাঁসির রানী, হাজার চুরাশির মা, তীতুমীর, অরণ্যের অধিকার, অগ্নিগর্ভ, চেট্টিমুন্ডা এবং তার তীর, বসাই টুডু, রুদালী, আঁধার মানিক, নৈঋতে মেঘ, আই পি এস ৩৭৫, সাম্প্রতিক, প্রতি চুয়ান্ন মিনিটে, ছয় ডিসেম্বরের পর, স্তন্যদায়িনী, যাবজ্জীবন, লায়লী আশমানের আয়না, ঘোরান সিঁড়ি, ঊনত্রিশ নম্বর ধারার আসামী, প্রস্থানপর্ব, ব্যাধখণ্ড, ডাকাতে কাহিনী…আর মনে পড়ছে না…অক্সিজেন চলছে…চলেই যাচ্ছে …আমার কষ্ট হচ্ছে খুব জটিবুড়ি…আমার লেখা নিয়ে চলচ্চিত্র হয়েছে— সংঘর্ষ, রুদালী, হাজার চুরাশি কি মা, গঙ্গোর… আমার লেখা নিয়ে দেশে বিদেশে আজকাল অনেক চর্চা হয়। বলা হয় শুধুমাত্র ব্রাত্য, প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে লেখার কাজ আমার মতো কেউ করেননি। সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিতায় প্রন্তিক মানুষের কথা বলেছন, বিভূতিভূষণ বলেছেন তাঁর লেখায়, তবে তা কিছুটা, এই অবহেলিত মানুষদের নিয়ে এত কাজ নাকি আমিই…কি জানি…ক্যুইন অব ঝাঁসীতে আমি লক্ষ্মীবাঈকে রানি হিসেবে না দেখিয়ে দেখিয়েছি আন্দোলনকারী ও সহযোদ্ধা হিসেবে, হাজার চুরাশির মা আমার কলমের ও চিন্তাভাবনায় হয়ে উঠেছে অতি সাধারণ সহজ-সরল মানুষদের যাপনের চিত্র, আঁধার মানিকে ইংরেজদের নবাবপীড়ন ও নবাবদের ইংরেজতোষণ এবং নবাবির পরিসমাপ্তি…এইসব নানা আলোচনা লেখাপত্র চোখে পড়ে কিছু কিছু…ভালই লাগে…
দিব্যনাথ আর সুজাতার ছেলে ব্রতী, ব্রতী— হাজার চুরাশি…
দিব্যনাথ আর তাঁর মা সকলের মনোযোগ সবসময় আকর্ষণ করে রাখতেন। সুজাতার অস্তিত্বটা হয়ে গিয়েছিল ছায়ার মতো। অনুগত, অনুগামী, নীরব, অস্তিত্বহীন। অন্য ছেলে-মেয়ের বেলায় যা হোক একা ব্রতীর জন্য সুজাতা স্বামীকে শাশুড়ীকে অমান্য করেছেন। বেশি জেদি, বেশি অনুভূতিপ্রবণ ব্রতীকে সুজাতা ছায়ায় মায়ায় বড় করেছিলেন…যেদিন ভোরে কাঁটাপুকুরে ব্রতীর দেহ শনাক্ত করতে যান, বাজারে সেদিন সোনার দর বেড়েছিল, ব্যাঙ্কের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা বহন করে ভারতীয় হাতির বাচ্চা দমদম থেকে টোকিওতে উড়ে গিয়েছিল, কলকাতায় বিদেশি ছবির উৎসব হয়েছিল, সচেতন শহর কলকাতায় সচেতন শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা ভিয়েতনামে বর্বরতার প্রতিবাদে আমেরিকান কনস্যুলেটের সামনে, রেড রোডে, সুরেন ব্যানার্জি রোডের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেছিলেন।
মুক্তির দশক! কলকাতা সেদিন কত সচেতন ছিল!
সেইসময় মুনাফাখোর স্বার্থান্ধ নেতাদের ওপর যারা বিশ্বাস হারিয়েছিল— সেইসব বালক, কিশোর, যুবক— তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যু। সবাই তাদের হত্যা করতে পারে! সব দল ও মতের লোকেদের এই দলছাড়া তরুণদের হত্যা করার অধিকার আছে! আইন অনুমতি বিচার লাগে না! একা অথবা যূথবদ্ধ তরুণদের হত্যা করা চলে! বুলেট, ছুরি, দাঁ, বর্শা, সড়কি যে কোনও অস্ত্রে, যে কোনও সময়ে, শহরের যে কোনও অঞ্চলে, যে কোনও দর্শক বা দর্শকদের সামনে! কলকাতার কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এই রক্ত উৎসবকে উপেক্ষা করেছিল— এরাই নিশ্চয় সঠিক ছিল!

আরও পড়ুন : শীতের নিউমার্কেট

সুজাতা কে? তিনি তো শুধু মা। যাদের হাজার হাজার হৃদয়ে এই প্রশ্ন আজ কুরে কুরে খাচ্ছে, তারা কে? তারা শুধু মা হাজার চুরাশির মা,…আরেক মা কোরমি
রোজ সকালে কোমতার বউ ওকে হাতে হাত ধরে নিয়ে আসে, এখানে বসিয়ে দিয়ে যায়। দুপুরে কোমতার বউ ওকে এখানে খাবার এনে খাইয়ে যায়। রোজ বিকেলে নদীতে বাঘের জলখাবার খাওয়ার সময় হলে কোমতার বউ নয় সুগানা অর হাত ধরে তুলে নিয়ে যায়। ওর স্থির বিশ্বাস একদিন তুমি ফিরে আসবে বলে ও অপেক্ষা করতে করতে পাথর হয়ে যাবে। সেদিন ওকে ঘরে ফিরতে হবে না। মুন্ডা রায়ট কেসে বাঙালি ক্রিশ্চান অমূল্য আব্রাহাম কেন কষ্ট পায়? কেন কেসের সমাপ্তিতে চাকরি ছাড়ে? সে আর কিছু ছাড়তে পারে না তাই? কেন বুঝতে চেষ্টা করে বিরসা তোমাকে? তোমার আন্দোলনকে? মুণ্ডারা কি অরণ্যের অধিকার পাবে? খুটকাটি গ্রামে স্বীকৃত হবে তাদের জন্ম-অধিকার? তাদের জীবন থেকে মহাজন, বেনে, জোতদার, জমিদার, হাকিম, আমলা, থানা, বেঠ বেগারির পাষাণভার নেমে যাবে?… অমূল্য বিরসাকে দেশের, গ্রামের, বনের গল্প বলত। মিশন স্কুলে পড়বার সময় ওরা সাহেবকে বলে ক’য়ে শহরে বেড়াতে গিয়েছিল, অমূল্য বৃত্তি পেত, চার আনা ওর কাছে ছিল, ওরা আখ কিনল, তিলুয়া কিনল গরম গরম…
বিরসা বলল— দোকানে কত নুন দেখেছ?
—নুন তো দোকানেই থাকে।
—মাটির তেলই বা কত।
—বড় হলে আমি মাকে বোরা বোরা নুন কিনে দেব, ওই তেল নিয়ে যাব গ্রামে, মা বাতি জ্বালাবে।
—বোরা বোরা নুন? অমূল্য অবাক হয়ে গেল।
—হ্যাঁ, নুন দিলে ঘাটোর স্বাদ হয় কত? মা সবটুকু নুন আমাদের দেয়, নিজে আলুনি ঘাটো খায়, তাতেই তো মার শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে… একটু নুন চিনা ঘাসের দানা সেদ্ধ বা ঘাটো, আর মহুয়ার বিচি কুটে পিষে তেল— সেই তেলে বাতি জ্বলবে ঘরে— এইটুকু চেয়েছিল বিরসা। হাট থেকে সবগুলো নুনের বোরা, তেলের জালা এনে মা করমিকে রানি করে দিতে সাধ যেত…
উলঅগুলানের শেষ নাই, বিরসার মরণ নাই…সংগ্রামের শেষ নাই…
আদিবাসী বিদ্রোহের ক্রম অনুযায়ী বিরসা আধুনিক মানুষ। সেই সময় মিশন স্কুলে সে কিছুটা পড়েছিল। অরণ্যসচেতন বিরসা তার জীবৎকালে হয়ে উঠেছিল কিংবদন্তি। একটি মুখে মুখে ফেরা নাম— জনচেতনা। অরণ্য যে এক লুণ্ঠিতব্য সম্পদ, ইংরেজ ও তাদের প্রসাদধন্য ভারতীয়রা তা ভালই বুঝেছিল। এখনকার শাসকরা তা ভালই বোঝেন। তার অভ্যুত্থান দমন করতে ইংরেজ সরকার তাই এত আগ্রহী হয়েছিল, হয়েছিল ধরতি-আবা নিধনে। কিন্তু এই সংগ্রাম ফুরোয় না, পরাজয়ে সংগ্রাম শেষ হয় না। উলগুলানের শেষ নাই, বিরসার মরণ নাই, সংগ্রামের শেষ নাই…এই ‘অরণ্যের-অধিকার’ লিখে পেয়েছিলাম সাহিত্য আকাদেমি, তারপর পদ্মশ্রী, জ্ঞানপীঠ, ম্যাগসাসে, অনারিজ কজা, পদ্মবিভুষণ, যশবন্তরাও জাতীয় পুরস্কার, বঙ্গবিভূষণ…কিন্তু আদিবাসীদের মুখের ‘মা’ ডাক ‘দিদি’ ডাক…এর চেয়ে বড় পুরস্কার…জানি না…
বিশালাক্ষী প্রশ্ন করেছিল, ছেলেদের কাজ শুধু মেয়েদের পতিত করা, ত্যাগ করা, দোষ ধরা, শাস্তি দেওয়া। মেয়েদের আগলে রাখা, সামলে রাখা— সেটা তাদের কাজ নয়?

আরও পড়ুন : ছাঁটাই হাবাস, কোচ বদলের ভাবনা লাল হলুদেরও

বিশ্বকর্মার কর্মযজ্ঞশালা এই কলকাতা। কলকাতায় আজও আছে আপাত তুলনামূলক নিশ্চিন্ত আশ্রয়, জীবন-জীবিকার প্রতিশ্রুতি— তার শক্তিও কম নয়। আলিবর্দি চেয়েছিলেন তাঁর সুবেদারির বুনিয়াদ শক্ত করতে। চেয়েছিলেন কলকাতায় ইংরেজরা তাঁর অধীনস্ত বিদেশি বণিক হয়ে যে সুশাসন ও নিরাপত্তার প্রলোভন দেখাচ্ছে তা দূরে রেখে লক্ষ লক্ষ চাষীকে, গৃহস্থকে, ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতকে, জেলে, জোলা, তাঁতি, কুমোর, শাঁখারি, কাঁসারি সকলকে নিজের জীবিকায় পুনর্বাসিত করতে। এক সুদৃঢ় সমাজ তুলে দিতে চেয়েছিলেন দৌহিত্র সিরাজের হাতে। দীর্ঘ নয়, দশ বছর ব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন বর্গীয় হামলায় রাঢ়বঙ্গ ভাগীরথীর পশ্চিম উপকূল অত্যাচারে জনশূন্য, ধনশূন্য । ঘোড়সওয়ারি বর্গিরা নদী পার হতে চাইত না। ফলে গঙ্গার অপর পার বর্গীয় অত্যাচারে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আবার করমণ্ডল উপকুল দাক্ষিণাত্যে ফরাসি ও ইংরেজ আধিপত্য শুরু হয়ে গিয়েছিল। টাকার থলির হাতছানি। দিল্লির বাদশা, পুণার পেশবা, ভোঁসলা শাসক, দাক্ষিণাত্যের নিজাম, বাংলার আলিবর্দি— অর্থের প্রয়োজন নেই কার? তবু আলিবর্দি চেয়েছিলেন… আলিবর্দির মৃত্যু যেন একটা যুগের অবসান। কিন্তু ১১৪৯ সনে বর্ধমানের অন্তর্গত আঁধারমানিক গ্রাম ছিল নির্মল সুখশান্তির। একসময় শৈশবে এই গ্রামে সুরকণ্ঠ রায়, আনন্দীরাম মুখোটি আর নরপতি মিশ্র বাল্যের সাথী ছিলেন। তারপর ক্রমে কাল পরিবর্তনের ফলে তিনজনের জীবনের গতি তিনদিকে চলে যায়। ‘আঁধার মানিকে’ চেয়েছিলাম সুরকণ্ঠ, আনন্দীরাম, নরপতি, ফুলেশ্বরী, জগৎপতি, মহীপতী, কুন্দ, পাতনি-পিসি, কাশীশ্বর, বিশালাক্ষী, নির্মলা, বাচস্পতি এই রকম বহু চরিত্রের চলাচল বর্ধমান, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর, বাংলাদেশ তথা সারা ভারত জুড়ে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগসূত্র এক করতে। সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে রামাই বাগদি বলেছিল, স্ত্রী যদি নির্দোষ হয় তবে সে তাকে ত্যাগ করবে না। বিশালাক্ষী প্রশ্ন করেছিল, ছেলেদের কাজ শুধু মেয়েদের পতিত করা, ত্যাগ করা, দোষ ধরা, শাস্তি দেওয়া। মেয়েদের আগলে রাখা সামলে রাখা— সেটা তাদের কাজ নয়? প্রতাপশালী শিবকালী গাঙ্গুলি ও তাঁর দুই স্ত্রী— তিনজনের সুসম্পর্ক, কিন্তু বর্গিদের হাতে শিবকালীর হত্যা এবং বিশালাক্ষীর নকশাতোলা শাড়ি পরে স্বামীর সহমরণে যাবার প্রেম ও মনের জোর কিংবা কাশীশ্বরের সঙ্গে নির্মলার দীর্ঘ অদর্শনের পর দেখা পাওয়া… ‘আমি তোমায় নিয়ে যাব’ কাশীশ্বরের এই উক্তি কিন্তু ঘটনা পরম্পরায় নির্মলার আত্মহত্যা… সব মিলিয়ে পাওয়া না পাওয়া গল্পের বুননে ‘আঁধার মানিক’ গ্রাম আস্তে আস্তে চলে আসে কলকাতায়…আমিও…আমরাও?
এইভাবেই কি চলে পুনরাবৃত্তি? না নতুন? অন্যরকম? বিচিত্র? কী জানি!
জটিবুড়ি, অনেক সংগ্রাম করেছি, কিন্তু এবার থামতে হবে মনে হয়েছে, থেমেও গিয়েছি…স্মৃতি সাথ দিচ্ছে না, মাঝে মাঝে আসছে চলে যাচ্ছে আবার, রক্তে সংক্রমণ, মূত্রনালিতেও সংক্রমণ ধরেছিল। ফুসফুসেও ব্যাকটেরিয়াঘটিত সংক্রমণ… প্রবল শ্বাসকষ্ট, জটিবুড়ি…বাংলা শিল্প-সাহিত্য জগতে মেয়েদের মধ্যে যে ‘দেবী’ ঘরানা ছিল… গিরিবালা দেবী, রাধারানী দেবী আশাপূর্ণা দেবী…কেউ কেউ বলছেন আমার পর আর সেই ধারা আর থাকবে না… হয়ত ‘দেবী’ বিশেষণ তেমন শোনা যাবে না, কিন্তু থেকে যাবে ঘরে-ঘরে সমাজে-সমাজে মেয়েদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, প্রতিবাদ। মেয়েরা ‘দেবী’ হয়ে নাই বা থাকল কিন্তু তাঁরা যে সামান্যও নন— এই বোধ ছড়িয়ে পড়বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, আমিও থেকে যাব মহাশ্বেতা হয়েই…

Latest article