কংগ্রেসের দোষেই দেশে ১ : ১ হল না! নেত্রী মুখ্যমন্ত্রীই, লোকসভায় আসন বাড়বে তৃণমূলের: অভিষেক

Must read

এক নজরে
* তৃণমূলে একজনই নেত্রী, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
* পদ্ধতিগত মতপার্থক্য রাজনীতিতে থাকা স্বাস্থ্যকর
* ডায়মন্ড হারবারে পাঁচ বছরে ৫৮০০ কোটির কাজ হয়েছে
* ক্ষমতা থাকলে অর্ডিন্যান্স এনে পরিবারতন্ত্র বন্ধ করুক বিজেপি
* ভোট ঘোষণার পরেই বলব তৃণমূলের সম্ভাব্য আসন
* ইন্ডিয়া ভোটে জিতলেও কেন্দ্রে আমি মন্ত্রী হব না
* বাংলার রাজনীতিতে টাকার ছবি কলঙ্কিত অধ্যায়
* জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এখনও মন্ত্রী, কাল কী হবে কেউ জানে না
* আমি ৬০ বছর বয়সের আগে রাজনীতি থেকে অবসর নেব
* আমি চাই না আমার সন্তান রাজনীতিতে আসুক

নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী আছেন, থাকবেন। আমার কোনও বাসনা নেই মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার। আমি সংগঠনেই ঠিক আছি। তৃণমূল কংগ্রেসকে সাংগঠনিকভাবে বাড়ানোই আমার একমাত্র লক্ষ্য। আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো পথেই চলছি। আর আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে নিশ্চিতভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের আসন বাড়বে। নির্বাচন ঘোষণার পর এক সপ্তাহের মধ্যে জনসমক্ষে জানিয়ে দেব লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেস ক’টি আসন পাবে। এতে কোনও লুকোচুরি নেই। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনেও বলেছিলাম, তৃণমূল কংগ্রেস ২০০-র বেশি আসন পাবে। পেয়েছিল ২১৩টি। এবারও বলব। শনিবার আনন্দবাজার অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে একথা ফের জানিয়ে দিলেন আত্মবিশ্বাসী তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন প্রায় এক ঘণ্টার সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে রাজ্য রাজনীতি, জাতীয় রাজনীতি, এজেন্সি রাজনীতি ও ব্যক্তিগত বিষয়ে অকপটে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অভিষেক।

আরও পড়ুন- মুখ্যমন্ত্রী-অভিষেকের সঙ্গে কথা হল দেবের

লোকসভা নির্বাচনের আগে জোট সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে আবারও অভিষেক স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, কংগ্রেসের একঘেয়েমি ও দোষের কারণেই দেশের ১ : ১ ফর্মুলা হল না। ইন্ডিয়া জোটের পাটনা বৈঠক থেকেই নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট বলেছিলেন, সবকিছুর আগে আমাদের আসন রফা বা ভাগাভাগি করে নেওয়া উচিত। যাতে বিজেপি সুবিধে না পায়। কিন্তু কংগ্রেস শুনল না। তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ল পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে। কংগ্রেস ভেবেছিল ৫টির মধ্যে অন্তত ৩টিতে জিততে পারলে জোটের মধ্যে তাদের দর কষাকষি করতে সুবিধা হবে। অতি চালাকের গলায় দড়ি। কটাক্ষ অভিষেকের। তাঁর কথায়, যখন রাহুল গান্ধীর সঙ্গে আমাদের বৈঠক হচ্ছে তখন এখানে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে বলছেন, আসুন বহরমপুরে লড়ুন। এর মানে কী? সারা ভারতে কংগ্রেস একরকম আর বাংলায় কংগ্রেস তৃণমূলের বিরুদ্ধে! এ-জিনিস চলতে পারে না। বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস ৪২টি আসনেই প্রার্থী দেবে। নেত্রী তো বলেই দিয়েছেন, এখানে তৃণমূল একাই লড়বে। সাফ কথা অভিষেকের।

প্রশ্নোত্তর পর্বে অভিষেক স্পষ্ট বলেন, নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অতীতে আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা আমি নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করেছি। ভবিষ্যতেও করব। দল পরিচালনার ক্ষেত্রে নেত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে পদ্ধতিগত, মতপার্থক্য-মতানৈক্য থাকলেও কোথাও দ্বিমত নেই। পার্থক্য হয় সমগোত্রীয়ের সঙ্গে। আর আমার নেত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে দ্বিমতের কোনও প্রশ্ন নেই। ফের বলেন অভিষেক। একটা দলে কোনও বিষয়ে মতানৈক্য-মতপার্থক্য থাকলেও সেটা কখনওই ব্যক্তিগত নয়। অভিষেকের কথায়, আমি মনে করি দলে আলোচনা ও মতপার্থক্য থাকা একটা স্বাস্থ্যকর বিষয়। তা বলে তৃণমূলে দুটো দল বলে কিছু নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটাই তৃণমূল কংগ্রেস। কেউ যদি ভেবে থাকেন বিজেপির সঙ্গে আমাকে মেশাবেন, তবে বলব, আমার গলা কেটে দিলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদই বেরোবে। আমার শিরদাঁড়া সোজাই থাকবে। এজেন্সি দিয়ে ভয় দেখিয়ে কিছুই করতে পারবে না।

অভিষেককে বলা হয় লোকসভায় জিতে ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে তিনি কেন্দ্রে মন্ত্রী হবেন। এটা নিশ্চিত। প্রশ্নকর্তাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, লিখে রাখুন, কেন্দ্রে আমাদের জোট ক্ষমতায় এলেও আমি মন্ত্রী হব না। একইসঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক অতীতে বলা রাজনীতিকদের অবসরের বয়সসীমা প্রসঙ্গ ফের উঠে এলে এদিনও সপাটে জবাব দিয়ে অভিষেক জানিয়ে দেন, তিনি মনে করেন ৬৫ বছরের উপরে কারও রাজনীতি করা উচিত নয়। এমনকী এদিন তিনি ঘোষণা করে দেন, ৬০ বছর বয়সের আগে তিনি নিজেও রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াবেন। তাঁর কথায়, একটা সময় পর বয়সের কারণেই মানুষের ‘প্রোডাক্টিভিটি’ কমে। তখন তাঁর সরে দাঁড়ানো উচিত। এই প্রসঙ্গে তিনি টেনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাও। তাঁর স্পষ্ট জবাব, অনেকে এ-নিয়ে অপব্যাখ্যা করেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বয়স অনুযায়ী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে পরিশ্রম করতে পারেন তা কুর্নিশযোগ্য। প্রধানমন্ত্রীর প্রসঙ্গও টেনে বলেন, তাঁরও অনেক বয়স। তিনি বিরোধী দলের হলেও তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনিও অনেক পরিশ্রম করেন। একই সঙ্গে উঠে আসে ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক মহেন্দ্র ধোনির প্রসঙ্গও। অভিষেকের কথায়, ধোনির যে বয়স সে তুলনায় ধোনি অনেক বেশি পরিশ্রম করতে পারেন। ফলে এটা ব্যক্তি বিশেষে নির্ভর করে। কিন্তু আমি মনে করি একটা সময় পর সরে যাওয়া উচিত। এই প্রসঙ্গে নবজোয়ার কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার বয়স ৩৬। তাই টানা ৬০ দিন রোদে-জলে রাস্তায় পড়ে থেকে এই কর্মসূচি করতে পেরেছি। কিন্তু ৬০ বছর বয়সে পৌঁছে এটা স্বাভাবিক কারণেই আমার পক্ষে করা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন অভিষেক। ১) কর্মক্ষমতা। ২) দলকে সমৃদ্ধ করার মতো দক্ষতা। ৩) জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা। এদিন রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠলে অভিষেক বলেন, আমি পারিবারিক সূত্রে এলেও মানুষ জিতিয়েছেন। দায়িত্ব দায়িত্ব দিয়েছেন। তাই এগোতে পেরেছি। ডায়মন্ড হারবার সিপিএমের জমানায় গত ৩৫ বছরে কী ছিল আর এখন কী হয়েছে তা সকলে দেখছে। ২০১৪ সালে সাংসদ হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত ৫,৮০০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। তার মানে প্রতি মাসে ৪৫-৫০ কোটি টাকার উন্নয়নের কাজ হয়েছে। বিজেপির যদি পরিবারতন্ত্র নিয়ে এতই সমস্যা থাকে তবে সংসদে একটি অর্ডিন্যান্স এনে বন্ধ করুক না! ওরা অনেক কথা বলে কিন্তু বাংলার প্রাপ্য বকেয়া দেয় না। অজুহাত খাড়া করছে ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট দেওয়া নিয়ে। বলুন তো। আমি সাংসদ। বছরে ৫ কোটি টাকা পাই। প্রতি বছর ইসি সার্টিফিকেট না দিলে পরের বারের টাকা আসে কোথা থেকে? প্রশ্ন অভিষেকের।

এদিন এজেন্সি রাজনীতি নিয়েও ফের সরব হয়েছেন অভিষেক। তিনি বলেন, আমাকে যতবার ডেকেছে ততবার গিয়েছি। সহযোগিতা করেছি। ভবিষ্যতেও করব। লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রসঙ্গে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, ২০০৯ সালে এই সংস্থা শুরু করি। প্রথমে একটি পার্টনারশিপ কোম্পানি ছিল। পরে এটি প্রাইভেট লিমিটেড হয়। ২০১৪ সালে নির্বাচনে দাঁড়ানোর আগে এই সংস্থা থেকে আমি ইস্তফা দিই। তবে আমার বাবা-মা আছেন। এই সংস্থা ব্র্যান্ডিং, শেয়ার ট্রেডিং-সহ একাধিক বিষয়ের উপর কাজ করে থাকে। একটি জলের বটলিং প্ল্যান্ট এই সংস্থার আছে। যার জমি ২০০২ সালে কেনা। তখন বাম জমানা। তৃণমূলের অবস্থা বুঝতেই পারছেন। অভিষেকের সংযোজন, আমার বিরুদ্ধে অনেক কথা বলা হয়। এই সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রে কথা বলা হচ্ছে। তার ভয়েস রেকর্ডিং নিয়ে এতো বিষয়। অভিষেকের প্রশ্ন, ইডি যদি সবই জানে তবে সেই তথ্য-প্রমাণ আদালতে পেশ করুক। আমার কাছে যা নথি চেয়েছে, গত ১০ বছরের নথি আমি দিয়েছি। এর আগে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের নাম গরু-কয়লা কেসে বিজেপি বলেছিল। এখন বলছে এসএসসি স্ক্যামে। অপরাধ যাই হোক না কেন লক্ষ্য ওদের একটাই। সবেতেই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের নাম তুলে আনছে। আমাকে সকাল-বিকেল সময় পাঠায়। শুধু তাই নয়, আমার বাবা-মা, স্ত্রী, আপ্তসহায়ক সকলকেই সমম পাঠিয়েছে। তাতেও কাজ হয়নি। আমার ছেলে এবং মেয়ে নেহাত ছোট, তা না হলে এজেন্সি ওদেরও সমম পাঠাতো। কটাক্ষ অভিষেকের।
কথা প্রসঙ্গে দলবদলু গদ্দারের প্রসঙ্গ উঠে এলে অভিষেক বলেন, উনি বলে থাকেন দলে সম্মান পাইনি। আবার কখনও বলেন, হাত-পা ধরে ওকে আটকানোর চেষ্টা হয়েছিল। আসলে নিজেই স্ববিরোধী মন্তব্য করছেন। অভিষেকের কথায়, মাথার উপর ইডি-সিবিআইয়ের খাঁড়া ঝুললে বিজেপির পদলেহন করে সে দলে যাওয়া ছাড়া আর উপায় কি! এক্ষেত্রে মানুষের সামনে দুটি পথ খোলা থাকে। হয় লড়াই চালিয়ে যাব নয়তো পদলেহন করে চলে যাব। উনি পদলেহন করে চলে গিয়েছেন। এই প্রসঙ্গেই এজেন্সি রাজনীতি নিয়ে অভিষেক বলেন, আমাকে জোর করে জেলে ঢোকালে আমি কী করতে পারি? যেখানে অনেক ক্ষেত্রেই বিচারব্যবস্থা একপেশে হয়ে পড়ে। কিন্তু কতো দিন আটকে রাখবে? একদিন না একদিন তো বেরবোই। তারপর? দুর্নীতি প্রসঙ্গে অভিষেকের স্পষ্ট বক্তব্য, কেউ অন্যায় করে থাকলে আইন আইনের পথে চলবে। দোষীদের সাজা পাওয়া উচিত। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতার ও টাকার ছবি প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে অভিষেক স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ওই ঘটনা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে কালোদিন। সে সময় উনি মন্ত্রী থাকলেও দল ও সরকার তাকে রেয়াত করেনি। কিন্তু জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বা বাকিদের বিষয়টি স্বতন্ত্র। ইডি কাউকে জোর করে গ্রেফতার করলেও তাকে তৎক্ষনাত সরিয়ে দিতে হবে তা কেন? পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তার বিপক্ষে ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টি অন্য। সারদা তদন্তের কথা উল্লেখ করে অভিষেক বলেন, ১০ বছরেরও বেশি এই তদন্ত চলছে। কী উঠে এসেছে?
প্রশ্ন ছিল রাজনীতির আঙিনায় অভিষেকের সন্তানদের নিয়ে কী বক্তব্য? তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পরিস্কার জানিয়ে দেন, আমি চাই না আমার সন্তানরা রাজনীতিতে আসুক। তবে ওরা যদি একান্তই আসে, সেটা ওদের ব্যক্তিগত বিষয়। আমার বিষয়টি স্বতন্ত্র ছিল। আমি ছোট থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়তে দেখেই বড় হয়েছি। আমার নিজেরও আগ্রহ ছিল রাজনীতিতে আসার। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সোশ্যাল মিডিয়ায় খুবই সক্রিয়। প্রধানমন্ত্রীও তাঁকে এক্স হ্যান্ডেলে ফলো করে বলায় তিনি বলেন, উনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। উনি আমায় ফলো করেন। তাই আমিও করি।

দল পরিচালনার ক্ষেত্রে কর্পোরেট স্টাইল বা কর্পোরেট সংস্থার যুক্ত থাকার প্রসঙ্গে অভিষেকের বক্তব্য, এরা ভ্যালু অ্যাড করে ঠিকই। কিন্তু শেষকথা বলেন জনতাই।

Latest article