বিগত একদশক ধরে পর্যটনক্ষেত্রে অনেকটাই উন্নতি করেছে বাঁকুড়া (Bankura) জেলা। সুন্দরী বাঁকুড়ার লাবণ্যময়ী রূপ দেখলে আপনার চোখ জুড়িয়ে যেতে বাধ্য। ব্যস্তময় জীবন থেকে দু’দিনের জন্য ছুটি কাটানোর আদর্শ জায়গা হল বাঁকুড়া। পাহাড়ি এলাকায় ঘেরা টেরাকোটার স্থাপত্য, গ্রাম্য জনজীবন এবং অজস্র মন্দিরে সেজে উঠেছে ঐতিহাসিক বাঁকুড়া জেলা।
কী কী দেখবেন বাঁকুড়ায়?
মুকুটমণিপুর ড্যাম : দু-একদিনের ছুটিতে আপনি ঘুরে আসতে পারেন মুকুটমণিপুর বা কংসবতী ড্যাম। যেটি এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাটির বাঁধ হিসেবেও পরিচিত। মুকুটমণিপুরের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য তাকে রাঢ়বঙ্গের রানি বলা হয়। জল, জঙ্গল আর পাহাড়ের অপূর্ব মিশেল এই মুকুটমণিপুর পর্যটকেদের কাছে একটি অন্যতম বেড়ানোর জায়গা। এখানে দেখার জন্য রয়েছে মুসাফিরানা ভিউ পয়েন্ট, পরেশনাথ শিবমন্দির, ডিয়ার পার্ক, অম্বিকা মন্দির। পরিবারের সঙ্গে বা প্রিয়জনের সঙ্গে ড্যামের জলে নৌকাবিহার করতে যেন ভুলবেন না। এখানে থাকার জন্য রয়েছে অজস্র হোটেল ও গেস্ট হাউস। সাধ্যমতো আপনি রুম ভাড়া পেয়ে যাবেন। খাবারও পেয়ে যাবেন হোটেল বা রিসর্টে থেকেই। বাঁকুড়া স্টেশনে এসে গাড়ি বা বাসে করে পৌঁছে যেতে পারবেন মুকুটমণিপুরে। দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার বাস ধরেও সরাসরি কলকাতা থেকে মুকুটমণিপুর যাওয়া যায়।
শুশুনিয়া পাহাড় : শাল, মহুয়া, অর্জুন আর পলাশ-ঘেরা জঙ্গল আর পাহাড়-ঘেরা গ্রাম নিয়ে বাঁকুড়ার (Bankura) শুশুনিয়া। প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য শুশুনিয়া পাহাড় বিখ্যাত। স্থানীয় মতে এই পাহাড়টি দূর থেকে দেখলে অনেকটা শুশুকের মতন তাই এই পাহাড়ের নাম শুশুনিয়া পাহাড়। এই পাহাড়েই অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম শিলালিপিটি। পাহাড়ের নিচে ঝরনার মুখে একটি প্রাচীন এক পাথরের নরসিংহ মূর্তি দেখা যায়। সেই ঝরনার উৎস নাকি আজও অজানা। পাহাড়ের পাথর কেটে তৈরি করা নানান ধরনের শিল্পকলার দর্শন মিলবে শুশুনিয়ায়। ট্রেনে করে এলে ছাতনা স্টেশনে নামলে সেখান থেকে টোটো-অটো বা গাড়িতে করে পৌঁছে যেতে পারবেন শুশুনিয়ায়। থাকার জন্য ইকো ট্যুরিজম লজের পাশাপাশি পেয়ে যাবেন একাধিক হোটেল। এ-ছাড়াও পাহাড়ের নিচে আপনি টেন্টেও থাকতে পারেন।
আরও পড়ুন: কানু সান্যালের বাড়ি দখলের অভিযোগ মিলতেই পুলিশকে আইনি পদক্ষেপের নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রীর
বড়দি পাহাড় : বাঁকুড়া (Bankura) জেলার অন্যতম একটি সুন্দর অফবিট জায়গা হল বড়দি পাহাড়। পাহাড়-জঙ্গল-নদী এবং পাহাড়ের ওপর সুদৃশ্য থাকার জায়গাগুলোতে আপনি দু-বা তিনদিন ছুটি কাটিয়ে আসতে পারেন। এককথায় প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য এই বড়দি পাহাড়। এখানে পাবেন শান্ত ঘন শালগাছের জঙ্গল, কংসাবতী নদীর ভিউপয়েন্ট, ঘন জঙ্গলের মধ্যিখানে রয়েছে শিবঠাকুরের মন্দির। বাচ্চাদের জন্য খেলার উদ্যানও রয়েছে এখানে। বড়দি ইকো রিসর্টে বুক করে আপনি এখানে থাকতে পারেন। রুম ভাড়া আপনার সাধ্যের মধ্যেই। বড়দি রিসর্টের নিজস্ব রেস্তরাঁয় আপনি আপনার পছন্দসই খাবার পেয়ে যাবেন। তবে হ্যাঁ, বাঁকুড়ার বিখ্যাত পোস্তর বড়া যেন আবার মিস করবেন না। কলকাতা থেকে ট্রেনে বাঁকুড়া স্টেশনে এসে পি মোড় পর্যন্ত বাসে এলে সেখান থেকে আপনি পৌঁছে যেতে পারবেন বড়দি পাহাড়।
জয়পুর ফরেস্ট : আপনি যদি নিরিবিলিতে দুই বা তিনদিনের ছুটি কাটাতে চান তাহলে ঘুরে আসতে পারেন সবুজ জঙ্গলে ঘেরা জয়পুর ফরেস্ট। এখানে দেখতে পাবেন শাল-সেগুনের ঘন সবুজ জঙ্গল। এ-ছাড়াও দেখেতে পাবেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহার হওয়া এরোড্রোম। ঘুরে দেখতে পারেন মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুর, যেটি টেরাকোটার অন্যতম একটি পীঠস্থান ও একটি ঐতিহাসিক স্থানও বটে। এখানে থাকার জন্য রয়েছে বনলতা ও বনফুল রিসর্ট। এখানে কটেজ বা এমনি রুম আপনার সাধ্যের মধ্যেই ভাড়া পেয়ে যাবেন। খাওয়াদাওয়া করতে পারেন এই রিসর্টেই। খাবার মান অত্যন্ত ভালই। ট্রেনে করে বিষ্ণুপুর স্টেশন থেকে গাড়ি, টোটো বা অটোতে করে পৌঁছে যেতে পারবেন জয়পুর ফরেস্টে।
ঝিলিমিলি : জঙ্গলের মধ্যে নিরিবিলিতে এবং ট্রি হাউসে থাকতে চাইলে দু-তিনদিনের জন্য ঘুরে আসতে পারেন বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রাম জেলার সীমানায় অবস্থিত ঝিলিমিলিতে। এখানের পাহাড়-জঙ্গল খুব সুন্দর ও মনোরম। এখানের জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে আপনার সময় কেটে যাবে। জঙ্গেলের মধ্যে রয়েছে অসম্ভব সুন্দর তালবেড়িয়া ড্যাম ও সুতান ফরেস্ট। থাকার জন্য পেয়ে যাবেন রিমিল লজ। সাধারণ রুম বা ট্রি হাউসে আপনি থাকতে পারবেন। খাওয়াদাওয়া করতে পারেন রিসর্টের রেস্তরাঁয়। এখানেও খাবারের মান খুব সুন্দর। ট্রেনে ঝাড়গ্রামে এসে সেখান থেকে ঝিলিমিলি পৌঁছে যেতে পারবেন। বাঁকুড়া থেকেও বাসে এখানে পৌঁছে যেতে পারবেন।
জয়রামবাটি-কামারপুকুর : পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম পবিত্র দর্শনীয় স্থান জয়রামবাটি ও কামারপুকুর। দু’টি স্থানের মধ্যে ১০ কিলোমিটারের দূরত্ব থাকলেও, এই দু’টি জায়গা একটি অপরটির থেকে আলাদা নয়। কামারপুকুরের খ্যাতি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বাসভূমি হিসাবে। কামারপুকুর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত জয়রামবাটি স্থানটিও বেশ ঐতিহ্যমণ্ডিত, কারণ এটি সারদা দেবীর জন্মস্থান। প্রতি বছরই এই দুই স্থান দর্শনের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী আসেন। জয়রামবাটি এবং কামারপুকুর— উভয় জায়গাতেই দুপুরে ও রাতে ঠাকুরের ভোগ পাওয়া যায়। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সকল পুণ্যার্থীর উদ্দেশ্যেই এই নিরামিষ ভোগ বিতরণ করা হয়। তবে এর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভোগের কুপন কাটতে হয়। তারকেশ্বর রেলস্টেশন থেকে গাড়ি বা বাসে করে পৌঁছে যেতে পারবেন এই দুই পবিত্র স্থানে।
বিহারীনাথ পাহাড় : বিহারীনাথ পাহাড়কে পশ্চিমবঙ্গের আরাকু ভ্যালি বলা হয়। এই পাহাড় এখনও অনেকটাই আদিম রূপে আছে এবং ঘন জঙ্গলে ঘেরা। সবুজে ঘেরা এই পাহাড়ে অনেকরকম বিরল প্রাণীর বাস। পাহাড়ের নিচে আছে বিখ্যাত বিহারীনাথ মন্দির। বিহারীনাথ পাহাড়ের নিচের অংশটিই হল এখানের মূল পর্যটন কেন্দ্র। বিহারীনাথ ধাম নামেই এই মন্দির প্রসিদ্ধ। এখানে শিবের নাম বিহারীনাথ এবং তাঁর নামেই এই পাহাড়ের নামকরণ। সরকারি এবং বেসরকারি কিছু থাকার জায়গা আছে এখানে। আগে থেকে বুকিং করে যাবেন। বাঁকুড়া (Bankura) বা ছাতনা থেকে অনায়াসে গাড়ি করে পৌঁছে যেতে পারবেন বিহারীনাথ পাহাড়ে।
এ-ছাড়াও বাঁকুড়ার অন্যতম দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে হল গাংদুয়া ড্যাম, কোরোপাহাড়, জয়চণ্ডী পাহাড়, ছাতনার বাঁশুলী মায়ের মন্দির, এক্তেশ্বর শিব মন্দির, সিদ্ধেশ্বর শিবমন্দির।