ভারতীয় সিনেমার নিজস্ব ইউনিভার্স ‘অস্ত্রাভার্স’ তৈরি হল। আর তা হল, ‘ব্রহ্মাস্ত্র : পার্ট ওয়ান— দ্য শিবা’-কে দিয়ে। ট্রিলজি-র জন্য ভাবা হয়েছিল শুরু থেকেই। আর সেই শুরুটা প্রায় এক যুগ আগে! পরিচালক অয়ন মুখোপাধ্যায় ছবির কনসেপ্ট নিয়ে ভাবা শুরু করেছিলেন ২০১০-এ, ভাবনার কথা ঘোষণা করেছিলেন ২০১১-তে। ছবি রিলিজ হল ২০২২-এ। দীর্ঘ জার্নি, তার চেয়েও দীর্ঘ, ওঠা-পড়া-থামা-ফের চলার গল্প। ছবির মেকিং নিয়েও অনায়াসে যুগোপযোগী একটা কাহিনি তৈরি করতেই পারেন অয়ন, যা পুরাণের গল্পের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে অনায়াস। আর অয়ন যে এ-ব্যাপারে দক্ষ ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ই (Brahmastra) তার প্রমাণ। সেই অয়ন যাঁর বলিউড ডেবিউ ‘ওয়েক আপ সিড’ (২০০৯) দর্শক আজও মনে রেখেছেন। প্রায় চার বছরের ব্যবধানে তৈরি করেছিলেন, ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’। সে-ও সফল সমানরকম। দর্শক বুঝেছিলেন এই বাঙালি ছেলেটির ব্যতিক্রমী চিন্তাধারা একদিন বলিউড শাসন করবেই, শুধু সময়ের অপেক্ষা। সেই সময় এল।
আসলে সময়সাপেক্ষ হবে তা জানতেন অয়ন। তবে তা নিজের প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, একটা আলাদা ইউনিভার্স তৈরির জন্য! ‘অস্ত্রাভার্স’ তো শুধুই সময় দাবি করে না, বিপুল পরিমাণ অর্থও দাবি করে। নিখুঁত রিসার্চ দাবি করে। অয়ন রিসার্চ, পুরাণ, লোকগাথা, কল্পনা, অ্যাডভেঞ্চার সব মিলিয়ে যুক্তি-যোগ্য বিন্যাস তৈরি করলেও তার যথোপযুক্ত ভিস্যুয়াল, উপস্থাপনা, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, লোকেশন যে-স্তরের প্রযুক্তি ও যে- স্তরের ইনভেস্টমেন্ট দাবি করে, তা এক জায়গায় আনা সহজ ছিল না। কারণ ছবির বাজেট দাঁড়িয়েছিল ৪১০ কোটি! অয়নকে ধন্যবাদ, সাহস হারাননি আর কে না জানে, ভাগ্য সাহসীদেরই সাহায্য করতে ভালবাসে। তৈরি হল মৌলিক ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ সিরিজের প্রথম ছবি। ট্রেলার রিলিজেই ক্রেজ তৈরি হয়েছিল। হল-এ পৌঁছে ছবিকে ভালবাসায় ভরিয়ে দেওয়ার জন্য অয়ন দর্শকদের উদ্দেশ্যে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন, কিন্তু বলিউড অয়নকেই ধন্যবাদ জানাচ্ছে, তাদের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।
আরও পড়ুন-আবার শীর্ষে বাংলা, শিক্ষাঙ্গনেও অগ্রগতি অপ্রতিরোধ্য
আদতে প্রেমেরই গল্প। কিন্তু আখ্যান সাজানো হয়েছে আরও নানা উপাদানে। ব্রহ্মাস্ত্রের (Brahmastra) কথা কম-বেশি সকলেই জানেন পুরাণ-কথায়। যে-অস্ত্র চরম শক্তিশালী, যে-অস্ত্রের প্রয়োগ প্রলয় সৃষ্টিকারী এবং যা কখনও ব্যর্থ হয় না। দ্বাপর যুগে মহাভারতের যুদ্ধে এর প্রয়োগের কথা সর্বজনবিদিত। এহেন অস্ত্রের সংরক্ষণ যতটা জরুরি, ততটাই জরুরি সঠিক সময়ে তার প্রয়োগ। এ-জন্যই একটি সম্প্রদায় তৈরি হয় যারা ব্রহ্ম-শক্তি সংরক্ষণে দক্ষ। কারণ সৃষ্টির আদিকাল থেকেই ব্রহ্মশক্তি থেকে তৈরি হয়েছে একাধিক সব মারণাস্ত্র। যুগের পর যুগ ধরে এই সম্প্রদায়ই রক্ষা করছে সেসব। এরা রক্ত মাংসেরই মানুষ কিন্তু প্রত্যেকেই একেকরকম সুপার পাওয়ারের অধিকারী। কলিযুগে অর্থাৎ বর্তমানে এই ব্রহ্মাংশের গুরুর চরিত্রে অমিতাভ বচ্চন। কিন্তু এর অধিকারী হওয়ার লড়াই জারি থাকে পর্দা জুড়ে। ফলস্বরূপ ব্রহ্মাস্ত্র তিন টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। একটি খণ্ডের অধিকারী হয় ‘জুনুন’ (মৌনি রায়), যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, বাকি দুটি খণ্ড জড়ো করে ব্রহ্মাস্ত্র ফের সম্পূর্ণ করে তার অধিকারী হওয়া।
অয়ন পুরাণেই থেমে থাকেননি। গল্পকে নিয়ে এসেছেন এ-যুগে। নিয়ে এসেছেন ‘শিবা’কে (রণবীর কাপুর), এনেছেন ‘ইশা’কে (আলিয়া ভাট)। শিবা অনাথ, ডিজে-র কাজ করে এক পাবে, যেখানে তার দেখা হয় ঈশার সঙ্গে এবং প্রথম দেখাতেই কী এক অমোঘ টানে ঈশার প্রেমে পড়ে সে। যেহেতু ‘রোমান্স’ অয়নের সবচেয়ে প্রিয় বিষয় আর সে-কারণে তিনি খুব সচেতনভাবেই এই উপাদানটিকে ফ্যান্টাসির সঙ্গে ব্লেন্ড করেছেন। শিবা যে নিজে এক বিশেষ শক্তির অধিকারী প্রথমে সেটা বুঝতই না। যখন জানল সে নিজেই প্রভূত আশ্চর্য। আগুন তাকে ছোঁয় না। সে নিজেই এক আগুন-অস্ত্র। কিন্তু এই শক্তি তখনই জাগ্রত হয় যদি ঈশা তার সঙ্গে থাকে, নচেৎ নয়! তাদের বিচ্ছিন্ন করা যে শত্রুদের উদ্দেশ্য হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
রিয়েল লাইফ জুটিতে রণবীর-আলিয়া এমনিতেই তুমুল জনপ্রিয়। রিলেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই গল্পে তাঁদের রোমান্স অংশ খুব প্রয়োজনীয় না হলেও তা ছিল তুরুপের তাস। দর্শক মুখিয়ে ছিল দুজনকে পর্দায় দেখার জন্য। অভিনয়ে নিজেদের দক্ষতা দুজনেই আগে তাঁদের মতো করে প্রমাণ করেছেন। দেখার ছিল তাঁদের অন স্ক্রিন কেমিস্ট্রি। সেখানে দর্শক একশোয় একশো দিয়েছেন। এ-ছাড়াও শাহরুখ খান, দীপিকা পাডুকোন, নাগার্জুন, ডিম্পল কাপাডিয়া একাধিক বিগ শটকে ক্যামিও চরিত্রে দেখা যায়। তবে ‘ব্রহ্মাস্ত্র’-র (Brahmastra) আসল অস্ত্র হল, ‘ভিএফেক্স’। চোখ ধাঁধানো ‘ভিস্যুয়াল স্পেক্টাকল’ এই প্রথম বলিউড দেখাল অয়নের সৌজন্যে। এর অন্যতম কারণ পর্দায় ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ উপস্থাপনের দায়িত্ব নিয়েছিল ইন্দো-ব্রিটিশ ভিএফএক্স সংস্থা ‘ডিএনজি’, যাঁদের ঝুলিতে আছে সাতটি অস্কার! সব মিলিয়ে ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ পয়সা উশুল ছবি শুধু নয়, বিশুদ্ধ বিনোদন, নিঃসন্দেহে।