প্রথম পদক্ষেপ
১৯০৪ সালের জুলাই মাসের ২০ তারিখ। বিলেতের বিখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল একটি চিঠি। প্রেরক কানাডার এক গবেষক-মহিলা। চিঠির বক্তব্য, তিনি খুঁজে পেয়েছেন এক নতুন ধরনের তেজস্ক্রিয় ঘটনা। থোরিয়াম নামে এক ধরনের তেজস্ক্রিয় মৌল থেকে বিকিরণের পর যে সম্পূর্ণ নতুন আর এক মৌলকণা উৎপন্ন হয়, এটা তিনিই প্রথম জানালেন। এমনিতে তেজস্ক্রিয় মৌল ক্ষয় হলে তা থেকে পাওয়া যায় আলফা, বিটা বা গামারশ্মি, তবে তাঁর পরীক্ষায় তিনি এই তিন ধরনের রশ্মির চেয়ে আলাদা সম্পূর্ণ নতুন এক নির্গত কণার সন্ধান পেয়েছিলেন। হ্যারিয়েট ব্রুকস (Harriet Brooks) নামের ওই গবেষককে এখন বলা হয় কানাডার প্রথম মহিলা নিউক্লীয় পদার্থবিদ।
তিনি ছিলেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসের আবিষ্কর্তা আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের একমাত্র মহিলা গ্র্যাজুয়েট গবেষক-ছাত্রী। উনিশ শতকের একেবারে প্রথম দিকে ইউরোপে যখন মারি কুরি কাজ করছেন তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে, ঠিক তখন কানাডায় রাদারফোর্ডের সঙ্গে মিলে প্রায় একই কাজ করছিলেন তিনি, পঁচিশ বছরের তরুণী হ্যারিয়েট ব্রুকস (Harriet Brooks)।
সেরা ছাত্রী
তাঁর জন্ম ১৮৭৬-এর ২ জুলাই। কানাডার অন্টারিও প্রদেশের এক্সেটার এলাকায় জন্ম, বাবা জর্জ ব্রুকস ছিলেন একটি কোম্পানির সেলসম্যান। চাকরির কারণে এই পরিবারকে প্রায়ই ঠিকানা বদলাতে হত। ব্রুকস দম্পতির ৯টি সন্তানের মধ্যে তৃতীয় হ্যারিয়েট স্কুলের পড়া শেষ করবার পর বাবা-মায়ের সঙ্গে চলে আসেন মন্ট্রিয়েল শহরে, এখানে আসবার পর তাঁর লাভ হল এই যে, এখানে তিনি ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সুযোগ পেলেন, সেটা ১৮৯৪ সাল। তাঁদের নয় ভাইবোনের মধ্যে হ্যারিয়েট (Harriet Brooks) আর এক বোন এলিজাবেথ, মাত্র এই দু-জন বিশ্ববিদ্যালয় অবধি পড়বার সুযোগ পেয়েছিলেন। এখান থেকে ১৮৯৮ সালে গণিত আর প্রাকৃতিক দর্শন নিয়ে বিএ পাশ করলেন হ্যারিয়েট, সঙ্গে পেলেন অ্যানি মোলসন মেমোরিয়াল প্রাইজ, গণিতে দারুণ ফল করবার জন্য।
আরও পড়ুন-পড়ুয়াদের মন তৈরিতে চালু হচ্ছে বন্ধুমহল
সাফল্যের পথে
ওই বছরেই ইংল্যান্ড থেকে ম্যাকগিলে এলেন নিউজিল্যান্ডের তরুণ বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। এখানে এসেই তিনি তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ শুরু করলেন। তখন হ্যারিয়েট এমএ পাঠরতা। প্রথম গ্র্যাজুয়েট ছাত্রী যাঁকে এমএ-তে পড়িয়েছিলেন রাদারফোর্ড। ক্লাসের পড়াশুনোর বাইরে দু-জনে রেডিয়াম ইমানেশন বা ‘রেডিয়াম নির্গমন’ নিয়ে গবেষণাও শুরু করলেন।
এই বিষয় নিয়ে দু-জনের যৌথ একটি পেপারও ওই সময় প্রকাশিত হয় ‘ট্রানজাকশন অফ রয়্যাল সোসাইটি অফ কানাডা’য়, ১৮৯৯ সালে। আর ওই বছরেই হ্যারিয়েট এল রয়্যাল ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ক্লাসে পড়ানো শুরু করেন পাশাপাশি নিজের পড়াশুনো করতে থাকেন। ১৯০১ সালে ম্যাকগিলের প্রথম মহিলা হিসেবে এমএ পাশও করে ফেললেন। এই সময় তাঁদের গবেষণার কাজও চলছিল। রাদারফোর্ড ও হ্যারিয়েটের যৌথভাবে একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিতও হচ্ছিল বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নালে। তখন তাঁরা রেডিয়াম ছাড়াও থোরিয়াম মৌলের তেজস্ক্রিয় ক্ষয় নিয়ে কাজ করছিলেন।
মোটামুটি ১৯০০ সালের দিকে সকলেই জেনে গিয়েছিলেন যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে কোনও মৌল থেকে আসলে বেরিয়ে আসে কয়েক ধরনের কণা। কিন্তু ঠিক কী বেরিয়ে আসে? ইউরেনিয়াম থেকে যে বিকিরণ বেরোয়, তা কি ইউরেনিয়ামের বাষ্প, নাকি অন্য কিছু? এই নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ ছিল।
লক্ষ্যে
হ্যারিয়েটদের গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল এটাই। ম্যাকগিলের গবেষণাগারে বসে তিনিই প্রথম দেখেন যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নির্গমনের পর সম্পূর্ণ নতুন মৌল-উপাদানে পরিণত হয় আগেকার পদার্থটির এক-একটি কণা। মানে একটা মৌলের পরমাণু পুরোপুরি অন্য একটা মৌলের পরমাণুতে পরিণত হয়। বলতে গেলে এ এক ধরনের আধুনিক অ্যালকেমি, যা অনেক কাল আগে ছিল বিজ্ঞানীদের ধ্যান-জ্ঞান। তাঁরা ঠিক যে স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করতেন, বিশ শতকের প্রথমে সেই ব্যাপারটাই যে বাস্তবে ঘটছে, তার প্রমাণ মিলল। তবে ওই সময় তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে যে ধাতুর চরিত্র বদল ঘটে, অর্থাৎ সম্পূর্ণ নতুন এক ধাতু তৈরি হয়, এ কথাটাকে কেউই তেমন গুরুত্ব দিতেন না। অথচ ঠিক সেটাই যে ঘটতে দেখা গেল তার পিছনে অবদান রয়েছে হ্যারিয়েট ব্রুকস-এরই। থোরিয়ামের একটা নমুনা থেকে নির্গত হওয়া তেজস্ক্রিয় বিকিরণকে পরীক্ষা করে হ্যারিয়েট বুঝেছিলেন যে এর মধ্যে রয়েছে এক নতুন ধরনের গ্যাসীয় উপাদান, কয়েক বছর পরে যার নাম হয় ‘রেডন’। এই নামটি দিয়েছিলেন জার্মান পদার্থবিদ ফ্রেডরিখ আর্ন্সট ডর্নের নামে। হ্যারিয়েটের কাজের বেশ কয়েক বছর পর জানা যায় যে তাঁরা আসলে যেটা আবিষ্কার করেছিলেন, তার নাম রেডন; সম্পূর্ণ নতুন একটি মৌল, আর যেটা একমাত্র তেজস্ক্রিয় নিষ্ক্রিয় গ্যাস। রেডন ছাড়া আর যে পাঁচটি নিষ্ক্রিয় গ্যাসের সন্ধান মেলে, সেগুলি হল হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন, ক্রিপ্টন আর জেনন।
ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়ার পর হ্যারিয়েট ব্রাইন মায়ার কলেজে চাকরি পান এবং ওখানেই একটি স্কলারশিপও পান। এখানেও রাদারফোর্ড এগিয়ে এলেন তাঁকে সাহায্য করতে, তিনি প্রস্তাব দিলেন ইউরোপে যেতে, এবং তাঁরই চেষ্টায় হ্যারিয়েট সুযোগ পেলেন ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে ইলেকট্রনের আবিষ্কারক জে জে থমসন-এর কাছে গবেষণা করার।
হারিয়ে যাওয়া সফল গবেষক
এখানে হ্যারিয়েট (Harriet Brooks) এক বছর কাটিয়ে ১৯০৩ সালে তিনি চলে এলেন ম্যাকগিলে, রাদারফোর্ডের কাছে। পাশাপাশি রয়্যাল ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ানোর কাজটাও আবার শুরু করে দিলেন। এরপর ১৯০৫ সালে হ্যারিয়েট চলে এলেন নিউ ইয়র্কের বার্নার্ড কলেজে। কিন্তু হ্যারিয়েটের এখানে বেশিদিন চাকরি করা হল না কারণ এখানে আসার পর বারগেন ডেভিস নামে এক গবেষকের সঙ্গে হ্যারিয়েটের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ডেভিসকে বিয়ে করতে চলেছেন এই খবর কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানাতে তাঁরা হ্যারিয়েটকে সাফ জানালেন, যদি তিনি বিয়ে করেন, তবে তাঁকে চাকরি ছাড়তেই হবে। কিন্তু হ্যারিয়েট এর প্রতিবাদ করলেন, কোনও মহিলাকে শুধুমাত্র বিয়ে করবার জন্য চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা যায় না।
কিন্তু শেষ অবধি বিয়েটা হল না, আর হ্যারিয়েটও চাকরিটা সেই ছেড়ে দিলেন। কিন্তু কেন তিনি এই সিদ্ধান্ত নিলেন, তা জানা যায় না। যেমন এটাও এক রহস্য যে এর বছর দুই পরে হ্যারিয়েট হঠাৎ করেই বিয়ে করে নিলেন ফ্র্যাঙ্ক পিচার নামে এক পুরনো গবেষক-বন্ধুকে। কিন্তু এর পরে হ্যারিয়েট যেন পুরোপুরি হারিয়ে গেলেন তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণার মানচিত্র থেকে। স্বামী আর তিন সন্তানকে নিয়ে সংসার করতে লাগলেন ওই ম্যাকগিল শহরেই। অবশ্য এরপরেই তাঁর জীবনে আসে পরপর দুই চরম শোকের ধাক্কা; তাঁদের এক সন্তান চার্লস মেনিঞ্জাইটিস রোগে মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে মারা যায় আর চার্লসের কয়েক বছর পরে আর এক মেয়ে বারবারা, তখন তাঁর আঠেরো বছর, হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। সেটা ১৯২৯ সাল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সপ্তাহকয়েক পর তাঁর ডুবন্ত দেহ পাওয়া যায়। এর পর হ্যারিয়েট আর বেশি বছর বাঁচেননি। ১৯৩৩ সালের সতেরোই এপ্রিল মন্ট্রিয়েল শহরে মৃত্যু হয় হ্যারিয়েটের, মৃত্যুর কারণ হিসেবে মনে করা হয় অতিরিক্ত তেজস্ক্রিয় রশ্মির শরীরে প্রবেশ। তখন তাঁর বয়স মাত্র ছাপ্পান্ন। ‘নেচার’ পত্রিকায় হ্যারিয়েটের (ব্র্যাকেটে মিসেস ফ্র্যাঙ্ক পিচার) একটি প্রয়াণ-সংবাদ লিখলেন তাঁর প্রিয় শিক্ষক রাদারফোর্ড।
আজ হ্যারিয়েটকে অনেকেই ভুলে গিয়েছেন। তাঁর কর্মক্ষেত্র ম্যাকগিলে রাদারফোর্ডের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির যে প্রদর্শনীটি হয়, সেখানে হ্যারিয়েটের নাম পর্যন্ত নেই প্রায় কোত্থাও। অথচ দুজনের একত্রে লিখিত প্রচুর গবেষণাপত্র এক সময় ছাপা হয়েছিল ও দেশের বেশ কিছু জার্নালে। তেজস্ক্রিয়তার ফলে কৃত্রিম মৌলান্তর, এই বিষয়টির আবিষ্কর্তা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে রাদারফোর্ড আর তাঁর এক ছাত্র ফ্রেডারিখ সডি-র নাম। থোরিয়াম থেকেই যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে তৈরি হয় রেডিয়াম, সেটাও কিন্তু লেখা থাকে। তবে হ্যারিয়েটই যে এই ধরনের ঘটনা প্রথম দেখেছিলেন, তা লেখা থাকে না কোথাও।