অজুহাত যেন পেলেই হল!
যে কোনও ছুতোই সকাল-বিকেল-সন্ধ্যায়, আচারে অনুষ্ঠানে, পাড়ার মোড়ে, রেস্তোরাঁ বা চায়ের দোকানে, ডালপুরির স্টলে, খেলার মাঠে, এমনকী হাসপাতাল ও শ্মশানে… যে কোনও সুযোগে একটু ফাঁক পেলেই ছোট-বড় সকলের চাই এনার্জি ড্রিংক্সের সন্তুষ্টি! কাজের শুরুতে কিংবা কাজের ফাঁকে কিংবা কাজের শেষে, পড়ার অবসরে,আড্ডার ফুরসতে, বিকেলের মরশুমে, বৃষ্টির সন্ধ্যায়, অফিসের বিশ্রামে কিংবা স্টেশনে, সুযোগ পেলেই চাই চা বা কফিতে (Coffee) চুমুক। কেতাদুরস্ত সভ্যতার বাহানায় অতিথি সৎকার হোক কিংবা মৃতদেহ সৎকার, জয়ের সেলিব্রেশন কিংবা জন্মদিনের পার্টি— সব ক্ষেত্রেই এই সফ্ট ড্রিংক্সের অবাধ বিচরণ। আর এভাবেই আবালবৃদ্ধবনিতার শরীরে ঢুকছে মাত্রাতিরিক্ত ‘ক্যাফেইন’।
আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে সকাল-বিকেল-সন্ধ্যায় ও অনেকের আবার রাতে শোবার আগে, পড়তে পড়তে, কাজের ফাঁকে চা ও কফি (Coffee) পানের বিশেষ মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা প্রায় চিরাচরিত। তার উপর আধুনিক মানুষের চমকদার স্বাস্থ্য সচেতনতার দরুন নানারকম ক্ষুধা নিবৃত্তিকারক ওষুধ, শক্তিবর্ধক বড়ি, ডায়েটের উপযোগী কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণযোগ্য কৃত্রিম খাদ্য এবং আরও নানা প্রকার সাপ্লিমেন্টস যা মানুষ সৌন্দর্য পরিস্ফুটনের জন্য গ্রহণ করে, সবেতেই রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ‘ক্যাফেইন’।
ক্যাফেইন-ই নেশা
দিনে দিনে মানুষ ‘ক্যাফেইন’ নামক একটি নেশার শিকার হচ্ছে। জ্ঞানে-অজ্ঞানে মানব শরীরের মধ্যে জমা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ‘ক্যাফেইন’। সচরাচর মানুষ চা ও কফি (Coffee) পানের মধ্য দিয়ে এই বিশেষ ধরনের উদ্দীপক বস্তুটিকে গ্রহণ করে; সাময়িক ভাবে এক অভিনব উত্তেজক অনুভূতি উপভোগ করে। চা-পানের পর এই অনুভূতিটি মৃদু ও মনোরম, কিন্তু এক কাপ কফি পানের পর এই উত্তেজনা যেন একজন সামরিক কমান্ডান্টের আদেশের মতো— বেশ দ্রুত এবং দৃঢ়!
প্রাকৃতিকভাবে ক্যাফেইন নির্দিষ্ট কয়েকটি গাছের ফল, পাতা ও শুঁটি থেকে পাওয়া যায়। গোটা বিশ্ব জুড়ে সাধারণত ছয় প্রকার গাছ থেকে এই ক্যাফেইন পাওয়া যায়। যথা : কফিগাছ, চা-গাছ (ক্যামেলিয়া সাইনেন্সিস), কোলাগাছ (কোলা অ্যাকুমিনাটা), ক্যাকাও গাছ (থিওব্রোমা ক্যাকাও); এছাড়াও ব্রাজিল ও অ্যামাজন অববাহিকা অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত গুয়ারানা গাছ ও দক্ষিণ আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত ইয়ার্বা মেট (আইলেক্স প্যারাগুয়ারিয়েন্সিস) গাছের শুঁটি থেকেও ক্যাফেইন পাওয়া যায়। গোটা বিশ্বের চল্লিশ শতাংশ ক্যাফেইন তথা কফি উৎপাদন হয় ব্রাজিলে, প্রতিবছর প্রায় পঁচিশ লক্ষ বিরানব্বই হাজার মেট্রিক টনের মতো। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম যেখানে বিশ্বের প্রায় কুড়ি শতাংশ কফি উৎপাদন হয়। এ-ছাড়াও কলম্বিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতেও প্রচুর পরিমাণে এই বস্তুটির উৎপাদন হয়ে থাকে। ভারতবর্ষে কর্নাটক, কেরল ও তামিলনাড়ু রাজ্যে এর উৎপাদন সর্বাধিক হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: ২৪৫০ মেট্রিক টন ইলিশ দুর্গাপুজোয় পাঠাচ্ছেন হাসিনা
ক্যাফেইন হল
‘ক্যাফেইন’ হল পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক ব্যবহৃত মনো-উত্তেজক পদার্থ। এটি মানুষের সাময়িক বিরক্তি দূর করে মন চাঙ্গা করে তোলে ও কিছু সময়ের জন্য একটি মনোরম আমেজ অনুভূত হয়। ঘুম ঘুম ভাব কেটে গিয়ে চট করে কাজটি শেষ করার তাগিদ জোগায় এই বিশেষ পদার্থটি! এক কাপ চায়ে এই পদার্থটি প্রায় ২০-৬০ মিলিগ্রাম পরিমাণে পাওয়া যায়, আবার এক কাপ কফিতে (Coffee) এর পরিমাণ প্রায় ১০০-৩০০ মিলিগ্রাম। প্রায় প্রত্যেকেই আমারা প্রতিদিন চার-পাঁচবার চা-কফি (Tea- Coffee) পান করেই থাকি; তবে যারা বদ্ধ জায়গায় কিংবা বিরক্তিকর কাজের সঙ্গে যুক্ত, যাদের কাজের চাপ অনেক বেশি, আবার নিছকই সময় কাটানোর জন্য বহুবার আমরা এই ধরনের পানীয় পান করে থাকি।
রাত জেগে কাজ বা পড়াশোনা করার জন্য আমরা যে সব ওষুধ খাই তার মধ্যে, হাঁপানি ও শ্বাসকষ্ট দূর করতে যে ব্রঙ্কোডায়ালেটার ব্যবহার করি তার মধ্যেও প্রচুর পরিমাণে ‘ক্যাফেইন’ মজুত রয়েছে।
সারাদিনে আমরা প্রায় অনেকটাই গ্রহণ করে ফেলছি এই পদার্থটিকে।
‘ক্যাফেইন’ হল একপ্রকার ক্ষারীয় মিথাইল-জ্যানথাইন গোত্রীয় এক প্রকার উত্তেজক রাসায়নিক পদার্থ। আট অণু কার্বন, দশ অণু হাইড্রোজেন, চার অণু নাইট্রোজেন ও দুই অণু অক্সিজেন দিয়ে তৈরি ক্যাফেইনের রাসায়নিক নাম হল ১, ৩, ৭-ট্রাইমিথাইলপিউরিন-২,৬-ডাই-ওন। এটি সরাসরি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপিত করে। মস্তিষ্কে থেকে প্রসূত অ্যাডিনোসিন নামক রাসায়নিক প্রাকৃতিক জৈবিক নিউরোট্রান্সমিটারটির কার্যকলাপ বন্ধ করে শরীরকে চাঙ্গা করে তোলে এই বিশেষ পদার্থটি। অ্যাডিনোসিন হল রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড প্রস্তুতকারক চারটি রাসায়নিক-এর মধ্যে অন্যতম, যা জীবনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। ‘ক্যাফেইন’ মানুষের শরীরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে পাকস্থলীর দ্বারা শোষিত হয়ে প্রায় ২০-৪০ মিনিটের মধ্যে ‘এন-ডিমিথাইলেশন’, ‘অ্যাসিটাইলেশন’, ও ‘অক্সিডেশন’ প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে যকৃৎ দ্বারা বিপাকিত হয় এবং খুব দ্রুত বিষক্রিয়া শুরু করে দেয়।
চায়ের মধ্যে
চায়ের মধ্যে উপস্থিত ‘ক্যাফেইন’ ও সমগোত্রীয় ‘থিওফাইলাইন’, ‘থিওব্রোমাইন’ ও ‘এল-থিয়ানাইন’ একই রকমভাবে শরীরের মধ্যে কাজ করে। ‘থিওফাইলাইন’ দেহস্থিত মাংসপেশিগুলোকে আরাম দেয় ও শ্বাস নিতে সুবিধা হয়; ‘থিওব্রোমাইন’ হার্ট ভাল রাখতে সাহায্য করে, রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে এবং রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। আবার ‘এল-থিয়ানাইন’ সরাসরি মস্তিষ্কে প্রবেশ করে ‘আলফা তরঙ্গে’র উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং মস্তিষ্ককে শান্ত রাখে। মস্তিষ্কপ্রসূত ‘গামা-অ্যামিনোবিউটারিক অ্যাসিড’-4এর উপর প্রভাব ফেলে ও মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।
উপরোক্ত সমস্ত রাসায়নিক উদ্দীপক পদার্থগুলো যা আমরা নানারকম ভাবে গ্রহণ করে থাকি সেগুলো মাত্রাতিরিক্ত হলেই হিতে বিপরীত হয়। বর্তমানে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক সকলের মধ্যেই ‘ক্যাফেইনে’র কুপ্রভাব দেখা গেছে। এফডিএ-নির্ধারিত ‘ক্যাফেইনে’র সর্বোচ্চ গ্রহণ মাত্রা হল ১২০০ মিলিগ্রাম/দিন; কিন্তু দেখা যাচ্ছে আমরা প্রতিদিন নানারকম ভাবে এর চাইতে বেশি পরিমাণে গ্রহণ করে ফেলছি। ফলে আমাদের শরীরে বিরক্তি, মাথাব্যথা, বদহজম, ঘুমের সমস্যা, স্নায়বিক দুর্বলতা, বুকে ব্যাথা, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, জ্বর, ট্যাকিকার্ডিয়া, ব্র্যাডিকার্ডিয়া, হাইপারটেনশন, ইপোটেনশন, মিড্রিয়াসিস, হ্যালুসিনেশন, বিচ্ছিন্ন মনোযোগের মতো নানারকম সমস্যা দেখা দেয়।
মাত্রাতিরিক্ত হলে
মাত্রাতিরিক্ত ‘ক্যাফেইন’ গ্রহণের ফলে ‘এ১’ ও ‘এ২’ প্রতিক্রিয়াধর্মী অ্যাডিনোসিন গ্রাহকের আণবিক, মৌলিক ও দৈহিক ক্ষতি হয় ফলে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অ্যাডানোসিন মনোফসফেট ও আন্তঃকৈশিক ক্যালসিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায়। সোডিয়াম রিটেনশন ও ওয়াটার রিটেনশনের হার বৃদ্ধি পায়।
২০১৬ সালে আমেরিকার পয়জন কন্ট্রোল সেন্টার ৩৭০২ জন মারাত্মক ভাবে ‘ক্যাফেইন’ আক্রান্তের তথ্য পেশ করেছিল। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের সংখ্যা প্রায় সমান ছিল; দুঃখজনকভাবে অনেক শিশুর মৃত্যু হয়েছিল এই ঘটনায়। তবে বর্তমানে এই পরিস্থিতির শিকার হতে চলেছি আমরা বহু ভারতীয়। বর্তমানে ভারতীয় সভ্যতায় এই ধরনের ‘ক্যাফেইন’-জনিত পানীয়ের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছে, যা আগামী দিনে আমাদের সামনে ভয়ংকর বিপদ টেনে আনবে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে লক্ষণীয় যে ভারতবর্ষের বাচ্চাপার্টিরাও মারাত্মকভাবে এই এনার্জি ড্রিংক্সের প্রতি আকৃষ্ট! এ বিষয়ে আমাদের অভিভাবকদের সকলের সচেতন হওয়া উচিত এবং যতটা সম্ভব এই ধরনের মৃদু নেশা এড়িয়ে চলাই ভাল।