সংবিধান না-মানাটাই এখন দস্তুর

আজ ভারতীয় সংবিধান দিবস। মহাসমারোহে আজকের দিনটি উদ্‌যাপিত হবে। কিন্তু আজ যাঁরা নানা অনুষ্ঠানে ভাল ভাল কথা বলবেন, তাঁরা কি এই সংবিধান মেনে চলছেন বা চলার ইচ্ছা দেখাচ্ছেন? এই প্রশ্নটাই আজ ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের আকাশে। লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

১৯৪৯-এর ২৬ নভেম্বর গণপরিষদ ভারতীয় সংবিধান গ্রহণ করে। এটি কার্যকর হয় ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০। ২০১৫-তে আজকের দিনে গেজেট নোটিফিকেশন জারি করে ২৬ নভেম্বর সংবিধান দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়। সংবিধানের প্রাণপুরুষ ড. বি আর আম্বেদকরের ভাবধারার প্রচার এবং সংবিধানের গুরুত্ব বিষয়ে জনসচেতনতার প্রসার— মূলত এই দুটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ভারত সরকার দিনটিকে ‘সংবিধান দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেন।

কিন্তু প্রশ্ন হল, গেরুয়া শাসনাধীন ভারতে সংবিধানের মূল বিষয়গুলি কতটা মান্য করা হচ্ছে আর কতটাই বা উপেক্ষিত হচ্ছে?
এই প্রশ্নের অনিবার্য উত্তর একটাই। আর কোনও জমানায় এভাবে সংবিধান লঙ্ঘনের ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেনি।
প্রথমেই আসা যাক সাম্প্রতিককালে রদ হওয়া কৃষি আইনের কথায়।
ভারতীয় সংবিধানের ২৪৬ ধারার অধীন সপ্তম তফসিলে তিনটি তালিকা আছে। যুক্তরাষ্ট্রীয়, কিংবা কে সি হোয়্যারের বক্তব্য অনুযায়ী আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে, কোন কোন বিষয়ে কার আইন প্রণয়নের এক্তিয়ার আছে, সেটা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এই তিনটি তালিকায়।
এর মধ্যে তৃতীয় তালিকা বা যুগ্মতালিকার উল্লিখিত ৪৭টি বিষয়ের মধ্যে ৩৩ নং বিষয়টিতে স্পষ্ট বলা আছে খাদ্য-শস্য, তৈলবীজ, তুলাবীজ, কাঁচাপাট ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়েরই আছে। আর সেটাকে হাতিয়ার করে, লখিন্দরের লৌহবাসরে কালনাগিনীর ছিদ্র খুঁজে নেওয়ার মতো, কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে রাজ্য তালিকায় উল্লিখিত ১৪ নং (কৃষি, কৃষি-বিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণা, গাছপালাকে পতঙ্গের উৎপাত থেকে বাঁচানোর জন্য গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ ও কীটনাশক), ২৬ নং ও ২৭ নং (শেষোক্ত দুটিতে রাজ্যের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে বিভিন্ন জিনিসের বাণিজ্য উৎপাদন ও সরবরাহ সংক্রান্ত বিষয়সমূহ উল্লিখিত) বিষয়ের এক্তিয়ার রাজ্যের থেকে সরিয়ে নিজেদের বৃত্তে নিয়ে এসেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজ্য তালিকার অন্তর্গত ২৬ ও ২৭ নং বিষয়দুটি যুগ্মতালিকার অন্তর্গত ৩৩ নং বিষয়ের সাপেক্ষে প্রযোজ্য। তাই ওই দুটি বিষয়ের ক্ষেত্রে যদি কেন্দ্রের খবরদারি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ধরেও নিই, তা হলেও থেকে যাচ্ছে রাজ্য তালিকাভুক্ত ২৮ নং বিষয়টি। রাজ্য তালিকার ২৮ নং বিষয় হল মান্ডি এবং মেলা। কেন্দ্রীয় সরকার যে কৃষি আইন প্রণয়ন করেছিল তাতে রাজ্য তালিকার ২৮ নং বিষয়টিও কেন্দ্রের ক্ষমতার পরিসরে টেনে নেওয়া হল।
এতে সংবিধান-কর্তৃক নির্ধারিত যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি (কিংবা, আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি) ক্ষুণ্ণ হল বটে, তাতে কার কী? এত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হল, তা নিয়ে মাথা ঘামাতে এঁদের বয়েই গেছে! আসলে, এই সরকার ও তার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ গণতন্ত্রের নতুন চেহারা, নয়া সংজ্ঞা নিয়ে এসেছেন।

 

জম্মু-কাশ্মীরে এক তরুণকে গুলি করে মেরে ফেলার জন্য জনৈক মানবাধিকার কর্মী কেন্দ্রীয় বাহিনীর উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল বলে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এই প্রসঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল সুস্পষ্টভাবে পুলিশ কর্তাদের জানান, ‘সুশীল নাগরিক সমাজ’ জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কর্মে লিপ্ত হতে পারে, তাই পুলিশ বাহিনীর কাজ হল সুশীল সমাজকে ওই রকম কোনও কর্মে লিপ্ত হতে না দেওয়া। অজিত ডোভাল সেদিন সাজিয়ে-গুছিয়ে যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ একটাই। সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজের ওপর নজরদারি চালানোটাই পুলিশের কাজ। ডোভাল আরও বলেন, গণতন্ত্রে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের গুরুত্ব কম। আসল গুরুত্ব বিষয় হল, জনগণের ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তিদের প্রণয়ন করা আইন। আর এই আইন কীভাবে পুলিশকর্মীরা প্রয়োগ করছেন সেটার ওপরেই গণতন্ত্রের সার্থকতা নির্ভর করে।
শুনতে ভাল লাগলেও, ডোভাল বা তাঁর সঙ্গে সমমনস্ক যাঁরা, তাঁরা সুকৌশলে একটা বিষয় এসব ক্ষেত্রে এড়িয়ে যান। সেটা হল, যে আইনের কথা ডোভালরা বলেন, সেই আইনগুলোর বেশির ভাগই ঔপনিবেশিক শাসনকালে প্রণীত হয়েছে। তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিকতার ছিটেফোঁটাও নেই। এ-প্রসঙ্গে দেশদ্রোহিতার আইনটার কথা বলা যেতেই পারে। দ্বিতীয়ত, স্বাধীন ভারতেও যে আইনগুলি প্রণীত হয়েছে সেগুলোর মধ্যেও এমন বহু আইন আছে যেগুলো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে আলাপ-আলোচনা তর্ক-বির্তকের মধ্যে দিয়ে গৃহীত হয়নি। সেগুলো সুস্পষ্টভাবে প্রণীত হয়েছে, এমনটাও নয়। তবে, এ-বিষয়ে সব চেয়ে বড় কথা হল, প্রণীত আইনের পুলিশ-কর্তৃক প্রয়োগ তাকে সার্থক বা ব্যর্থ করে তোলে না, আদালতে সেই আইনের বৈধতা বা সাংবিধানিকতা মান্যতা পেলে তবেই তা সার্থক। ডোভালদের বক্তব্যে এই সহজ সত্যটা সদা অস্বীকৃত।

আসলে ডোভালরা যা বলেন ও ভাবেন তা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভাবনাচিন্তারই প্রতিফলন। অক্টোবর মাসে মানবাধিকার বিষয়ে একটি সম্মেলনে ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘কেউ কেউ মানবাধিকারের নামে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চায়।… রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির অঙ্কে মানবাধিকারকে বিচার করলে আখেরে ক্ষতি কেবল মানবাধিকারের নয়, গণতন্ত্রেরও।’’
এ-জন্যই ত্রিপুরার বুকে সত্য ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশের দায়ে সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হয়। বিরোধী পক্ষের নেতা-নেত্রীদের ওপর হামলা হয় পুলিশের সামনে, থানার সামনে— কিন্তু কোনও মানবাধিকার কমিশন কিংবা মহিলা কমিশনের পা সেখানে পড়ে না। ২৬ জানুয়ারি আন্দোলনরত এক কৃষক পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছেন— যে-সাংবাদিক এই মর্মে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তাঁকে দেশদ্রোহিতার অপরাধে কারারুদ্ধ করা হয়।
এ-সব কার্যকলাপই বলে দিচ্ছে, দেশেরে বর্তমান শাসকেরা সংবিধানের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল!

Latest article