পাহাড় থেকে সাগর— আমাদের রাজ্যের বৈচিত্র আর বিশালতা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি বাংলার মেধাবী শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব। সাম্প্রতিক একের পর এক সমীক্ষায় উঠে আসছে এমন চিত্র। এই সমীক্ষাগুলি পরিচালনা করেছেন কেন্দ্রীয় সরকার, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন কোনও স্বশাসিত সংস্থা অথবা মান্য কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সবক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে বিদ্যালয়স্তরে পশ্চিমবঙ্গের (Education of West Bengal) শিশুরা অন্যান্য রাজ্যগুলির তুলনায় এগিয়ে থাকছে, এগিয়ে আসছে। বিস্ময়কর এই সাফল্যের খতিয়ান নিতে নিতে একথা মনে রাখতে হবে, পার্বত্য অংশ, জঙ্গলমহল, সুন্দরবন থেকে কোচবিহার বহু প্রত্যন্ত এলাকায়, অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জনপদের শিশুরাও কিন্তু মেধার বর্ণচ্ছটায় উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিচ্ছে। সরকারি বিদ্যালয় এবং সরকারি বোর্ড শহর-গ্রাম-মফসসলে সুষ্ঠুভাবে এই শিক্ষার অগ্রগতিকে লালন করছে। অন্যান্য বোর্ডের বেসরকারি বিদ্যালয়গুলির সঙ্গে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা পাল্লা দিচ্ছে। রাজ্য বোর্ডের অধীনস্থ বিদ্যালয়ে শিক্ষা একটি অধিকার, শিক্ষা কোনও পণ্য নয়। সাধারণ ঘরের ছাত্রছাত্রীদের এই বোর্ডই প্রধান আশ্রয়। এই বিদ্যালয়ের মাননীয় শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ সযত্নে তাদের এগিয়ে দিচ্ছেন দীপ্তির দিকে, সারস্বত সমুজ্জ্বলতার দিকে।
আরও একটু মন দিয়ে লক্ষ করলে দেখা যাবে রাজ্যের শিক্ষাদফতর এবং রাজ্য বোর্ডের এই সাফল্য ২০১১ সালের পর থেকে ধাপে ধাপে ক্রমোন্নতির দিকে যাচ্ছে। পূর্ববর্তী আমল নিয়ে অতিকথার ছড়াছড়ি, শিক্ষাক্ষেত্র নিয়ে নানা আকাশচুম্বী ঢক্কানিনাদ, কিন্তু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এমন সাফল্যের নজির কিংবা তথ্য, বহু পরিশ্রমেও সেই চৌত্রিশ বছরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার বর্তমানের উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, অসম তো বটেই, কেরল কিংবা কর্নাটকও আমাদের রাজ্যের বিদ্যালয়শিক্ষার সামগ্রিক অগ্রগতির পাশে বেশ ম্লান। রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে নতুন সরকার গঠনের পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রে কয়েকটি অভিনব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষায় সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনাগুলি এই এক দশকে ফলপ্রসূ হয়ে উঠেছে নানা ক্ষেত্রে। বিদ্যালয়শিক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ (Education of West Bengal) আজ সর্বভারতীয় মানচিত্রে এত চমকপ্রদ ফলাফল করছে তাঁরই সুদূরপ্রসারী সংস্কারের জন্য।
সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় যেমন দেখা যাচ্ছে জাতীয়স্তরের ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষায় (NEET-UG) রাজ্য বোর্ডের পরীক্ষার্থীদের সাফল্যের হার ক্রমবর্ধমান। তারা এমনকী সিবিএসই বোর্ডের শিক্ষার্থীদের শতকরা সাফল্যের হারের কাছাকাছি এসে গিয়েছে। পূর্ববর্তী বছরগুলির তুলনায় ক্রমে ক্রমে দ্রুত এগোচ্ছে রাজ্য বোর্ডের পড়ুয়ারা। ক্রমে এই ফারাক কমছে। রাজ্য বোর্ডের ৬৪,৪০০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে সফল হয়েছে ১১,০০৭ জন। সাফল্যের হার ১৬.৯%। অন্যদিকে এই রাজ্যের সিবিএসই বোর্ডের ১৫,০৯৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে সফল ৩,৬৯৮ জন। (সাফল্যের হার ২৪.৫%)।
আরও পড়ুন-শোকপ্রকাশ করে তৃণমূল বলল, সাহস থাকলে প্রধানমন্ত্রী বাংলায় বলা সেই চারটি লাইন গুজরাতেও বলুন
শুধু তাই নয়, ন্যূনতম তালিকাভুক্ত নম্বর ৩২৪ থেকে সর্বোচ্চ ৭২০ নম্বর পর্যন্ত আটটি স্তরেই সিবিএসই বোর্ডের সঙ্গে কড়া প্রতিযোগিতা বজায় রেখেছে রাজ্য বোর্ডের ছাত্রছাত্রীরা।
আলাদা করে একথা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন যে, সিবিএসই বোর্ডের অধিকাংশ পড়ুয়াই বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত। পাশাপাশি, নিট পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য তাদের সিংহভাগই নানা বেসরকারি কোচিং সেন্টার থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেয়। এরজন্য প্রয়োজন বেশ মোটা অঙ্কের অর্থবল। রাজ্য বোর্ডে যে অর্থনৈতিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের প্রাধান্য, তারা এই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার কথা ভাবতেও পারে না। তাদের সম্বল নিজস্ব পাঠক্রম, পাঠ্যসূচি, পাঠ্যপুস্তক এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সহায়তা। এবছর নিট পরীক্ষায় তারা বাংলায় উত্তর দেবার সুযোগ পেয়েছে। সেটা একটা বাড়তি সুবিধা। যদিও গণিত, রসায়ন বা পদার্থবিদ্যার একটা নিজস্ব ভাষা আছে। যেটা রাজ্য বোর্ডের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী নিপুণ ভাবে রপ্ত করেছে। অর্থসম্পন্নতা নয়, বিদ্যার জৌলুসই তাদের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’ গঠন করেন। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু এই কমিটিকে প্রভূত সহায়তা করেন। এই কমিটি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠক্রম, পাঠ্যসূচি এবং পাঠ্যপুস্তকের আমূল পরিবর্তন এবং আধুনিকীকরণের কাজ ধাপে ধাপে সম্পন্ন করে। নতুন এই দিশা এবং উদ্ভাবনী অভিমুখ রাজ্য বোর্ডের শিক্ষার্থীদের পক্ষে বিশেষ ফলদায়ী হয়েছে। একেবারে বুনিয়াদি স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ পড়ুয়াদের জ্ঞানবিজ্ঞানের নতুন নতুন প্রয়োগ এবং তত্ত্বগুলিকে বিশ্লেষণ করে এগিয়ে দিয়েছেন এই নবনির্মিত পাঠক্রম, পাঠ্যপুস্তককে নির্ভর করেই। বাংলার (Education of West Bengal) প্রতিটি অঞ্চলেই বিদ্যালয়শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য উত্তরণ দেখা গিয়েছে। ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’র উদ্যোগে প্রশ্নের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে, শিক্ষক-প্রশিক্ষণে সেই পরিবর্তিত শিক্ষাপ্রয়োগের বিষয়ে নানা বিশ্লেষণও শিক্ষকসমাজের কাছে পরিবেশিত হয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ সেই শিক্ষা পরিকল্পনার বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে, বিশেষত বিজ্ঞান শাখায়, সিবিএসই এবং অন্যান্য বোর্ডের সঙ্গে পাঠ্যক্রমের নিরিখে পার্থক্য বা ফারাক খুবই সামান্য। সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ধাঁচে আমাদের রাজ্য বোর্ডের শিক্ষার্থীরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। ফলে একদিকে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার আদানপ্রদানের পদ্ধতি পাল্টেছে, অন্যদিকে আধুনিক পাঠ্যক্রম এবং পাঠ্যপুস্তকের নতুন বিজ্ঞানক্ষেত্রগুলি চর্চার কেন্দ্রে এসেছে। সেইসঙ্গে বাংলার অগণিত মেধাবী ছাত্রছাত্রীর অকল্পনীয় অনুসন্ধিৎসা আর পরিশ্রম, নিজেদের ধী-শক্তিকে প্রমাণ করার অদম্য জেদ এই শিখরের দিকে যাত্রাকে নিশ্চিত করেছে। বিদ্যালয় শিক্ষা দফতর পুরো ব্যবস্থাটিকেই পরিচালনা করেন। এ কৃতিত্বে তাঁদের অবদানও কম নয়।
বিদ্যালয় শিক্ষার পটভূমিতে অবশ্য আরও কয়েকটি প্রভাব এরাজ্যে সক্রিয়। তার কথাও গুরুত্বপূর্ণ। পাঠক্রম, পাঠ্যসূচি, পাঠ্যপুস্তক শেষপর্যন্ত শিক্ষার উপকরণ মাত্র। তাকে প্রয়োগ করতে হয় যথার্থ পরিকল্পনায়। শিক্ষার্থীর অনুসন্ধিৎসু মনকে নিরন্তরভাবে উৎসাহিত করাও প্রয়োজন। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাশাপাশি শিক্ষা পরিচালনায় তার চিহ্ন স্পষ্টভাবে থাকা জরুরি। তবেই কাম্য সফলতার স্বাদ পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে তার উপস্থিতি সর্বত্র। একদিকে ‘কন্যাশ্রী’, অন্যদিকে ‘সবুজশ্রী’, পাশাপাশি সাম্প্রতিককালে ‘তরুণের স্বপ্ন’, অন্যদিকে স্বামী বিবেকানন্দ ‘মেধাবৃত্তি’— সমবেতভাবে বিজ্ঞান এবং অন্যান্য বিদ্যাচর্চায় শিক্ষার্থীদের বিপুলভাবে উদ্বোধিত করেছে।
এ রাজ্যের বিদ্যালয়শিক্ষায় যে সাফল্যের চিহ্নগুলি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে, সেগুলি আগামিদিনে আরও গরিমায় সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দৃষ্টিগোচর হবে। নতুন নতুন শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপায় ভূষিত হবে বাংলার বিদ্যালয়শিক্ষা। দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সে ছুটছে শিখরের দিকে। নানা প্রতিকূলতাকে জয় করে, নানা বাধা-বিপত্তিকে পরাস্ত করে তার দৌড় আমরা মুগ্ধচোখে নিরীক্ষণ করছি। বর্তমান এবং আগামিদিনের সেই ছাত্রছাত্রীদের জন্য কুর্নিশ আর করতালি।